উত্তরের মানুষের স্বপ্নের ক্যাম্পাস হবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়:বিশেষ সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক ড. মু. আবদুল জলিল মিয়া
২০০৯ সালের ১১ মে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. মু. আবদুল জলিল মিয়া। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন-প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাবিউর রহমান
কালের কণ্ঠ : উত্তর জনপদের অনগ্রসর মানুষের জন্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আবদুল জলিল মিয়া : উত্তর জনপদের মানুষ সব সময় অবহেলিত, উপেক্ষিত হয়ে আসছে। একটা কথা না বললেই নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে প্রথম রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, যা পরে এই জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চিন্তা না করে বাতিল করা হয়। আবারও বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতে তাঁরই নামে 'বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর' একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন। পরিবর্তনশীল বিশ্বের চাহিদা মেটাতে শিক্ষা এবং গবেষণালব্ধ তথ্য ও উপাত্তগুলো সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যে সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ এবং বহুমুখী সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর উত্তর জনপদের মানুষের জন্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি।
কালের কণ্ঠ : আপনি উপাচার্য হিসেবে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করছেন, এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং অপরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
বর্তমানে ২০টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডের সঠিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাস্তবায়ন কৌশল হিসেবে শিক্ষাদান পদ্ধতি, লাইব্রেরি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের উন্নয়ন বিবেচনায় নিয়মিত পাঠক্রমের আধুনিকায়ন, শিক্ষার গুণগত মান রক্ষার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান, দ্রুত ও ফলপ্রসূ জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণের জন্য সর্বাধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার, উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষমতা সৃষ্টি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি। সেমিস্টারভিত্তিক সেশনজটমুক্ত পড়ালেখার পাশাপাশি সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ এবং সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ক্রীড়া, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানামুখী কর্মসূচি প্রতিবছর নেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রাণপুরুষ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতিকে স্মরণীয় করার জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট। গবেষণা সহায়ক হিসেবে এখানে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেল তৈরি করা হয়েছে এবং সেগুলো তথ্যসমৃদ্ধ করার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এমফিল ও পিএইচডিসহ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই জনপদে প্রতিষ্ঠিত ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট একটি গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক হিসেবে দিকনির্দেশনা দেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আওতায় উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ‘Improvement of Teaching-Learning in Economics’_শিরোনামে একটি প্রকল্প অর্থনীতি বিভাগ পরিচালনা করছে।
বর্তমান সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় অবকাঠামো উন্নয়নের প্রথম ধাপে ২০০৯-২০১২ সালের মধ্যে সর্বমোট ২২টি অবকাঠামোর কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের পরামর্শ অনুযায়ী আইনকানুন, রুলস-রেগুলেশন এবং যে অ্যাক্টের মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আন্তরিক হয়েছে। অভিভাবকদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেছে। স্থানীয় সুধীজন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবীদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করেছি। কোনো অবস্থাতে যাতে ক্লাস ও পরীক্ষা বিঘি্নত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আমরা সব সময় সচেষ্ট আছি।
কালের কণ্ঠ : এসব কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। আমি সরকারের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, যখন যেভাবে চেয়েছি তা দ্রুতগতিতে সহায়তা পেয়েছি।
কালের কণ্ঠ : নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বর্তমানে কোন সমস্যাগুলো আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বলে মনে হচ্ছে?
আবদুল জলিল মিয়া : কোনো সমস্যা সমস্যা নয়, আমরা সবাই মিলে একটি পরিবার। সবার চিন্তা হওয়া উচিত গঠনমূলক। সবাই শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। মতাদর্শ যা-ই থাকুক না কেন, দলাদলি, হানাহানি ভুলে গিয়ে শিক্ষার উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এটাই কাম্য।
কালের কণ্ঠ : গত ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়টি তিন বছর পূর্ণ করেছে, ইতিমধ্যেই এখানে ২০টি বিভাগ খোলা হয়েছে। এত অল্প সময়ে এতগুলো বিভাগ চালু করে তা সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে কিভাবে?
আবদুল জলিল মিয়া : হ্যাঁ, গত ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। আমি আগেই বলেছি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক সহযোগিতা আছে বলেই সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : প্রায় প্রতিটি বিভাগই তরুণ শিক্ষকরা পরিচালনা করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতার অভাব একাডেমিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে কি না?
আবদুল জলিল মিয়া : না। একাডেমিক কার্যক্রমে তেমন প্রভাব ফেলছে না। কারণ আমাদের এখানে ক্রেডিট ও সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। যারা প্রথম বছর ভর্তি হয়েছে, তারা এখন তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। কাজেই তরুণ শিক্ষক হলেও তৃতীয় বর্ষের বিষয়ে পাঠদানে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া প্রায় প্রতিটি বিভাগেই দুই-একজন করে সিনিয়র শিক্ষক রয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্বাহী হিসেবে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : এখানে মোটামুটি সবাই অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। আপনি চারদিকে যা দেখছেন তা তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। তবে নতুন হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈড়হপবঢ়ঃ বুঝে উঠতে সময় লাগবে। ইতিমধ্যে সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। যেটুকু সমস্যা রয়েছে, আমার বিশ্বাস তা অল্পদিনের মধ্যেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ : নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে স্থানীয় প্রশাসন বা সাধারণ মানুষের কাছে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন। তাদের কাছে আপনি কেমন সহযোগিতা আশা করেন?
আবদুল জলিল মিয়া : আমি আগেই বলেছি, স্থানীয় প্রশাসন, সুধীজন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবীদের যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি। সহযোগিতার এই ধারা অব্যাহত থাকলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন করতে সামনে আরো কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : শিক্ষার্থীরা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোমল মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চার, দেশপ্রেম তৈরিসহ সর্বোপরি দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ক্যাম্পাসে একটি শহীদ মিনার ও একটি স্বাধীনতা ভাস্কর্য নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আপামর জনসাধারণ স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষা ও একাত্তরের মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে দেশের কল্যাণে গড়ে তোলার এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করার শপথ নেবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে অনুমোদিত ২০টি বিষয় ছাড়াও আরো নতুন বিষয় অনুমোদন প্রয়োজন। বিষয় না পেলে হয়তো বিল্ডিং খালি পড়ে থাকবে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরেই দ্বিতীয় পর্যায়ের অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্যায়েও ২২টি অবকাঠামো আছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের কিছু অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?
আবদুল জলিল মিয়া : কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নিয়োগ বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে পরীক্ষা সম্পন্ন করে সিন্ডিকেটের অনুমোদনের মাধ্যমে স্থায়ী নিয়োগ প্রদান করা হয়। তা ছাড়া এযাবৎ বিভিন্ন পদে যাঁরা কর্মরত আছেন, প্রতিটি পদই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত এবং যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই পদগুলো পূরণ করা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আবদুল জলিল মিয়া : শিক্ষা ও গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং Research Think Tank--গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের আধুনিক মানসম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক_এটাই আমার স্বপ্ন। আমি বিশ্বাস করি উত্তর জনপদের অবহেলিত মানুষের স্বপ্নের ক্যাম্পাস হবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ
আবদুল জলিল মিয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।
আবদুল জলিল মিয়া : উত্তর জনপদের মানুষ সব সময় অবহেলিত, উপেক্ষিত হয়ে আসছে। একটা কথা না বললেই নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে প্রথম রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, যা পরে এই জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চিন্তা না করে বাতিল করা হয়। আবারও বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতে তাঁরই নামে 'বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর' একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন। পরিবর্তনশীল বিশ্বের চাহিদা মেটাতে শিক্ষা এবং গবেষণালব্ধ তথ্য ও উপাত্তগুলো সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যে সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ এবং বহুমুখী সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর উত্তর জনপদের মানুষের জন্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি।
কালের কণ্ঠ : আপনি উপাচার্য হিসেবে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করছেন, এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং অপরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
বর্তমানে ২০টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডের সঠিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাস্তবায়ন কৌশল হিসেবে শিক্ষাদান পদ্ধতি, লাইব্রেরি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের উন্নয়ন বিবেচনায় নিয়মিত পাঠক্রমের আধুনিকায়ন, শিক্ষার গুণগত মান রক্ষার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান, দ্রুত ও ফলপ্রসূ জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণের জন্য সর্বাধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার, উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষমতা সৃষ্টি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি। সেমিস্টারভিত্তিক সেশনজটমুক্ত পড়ালেখার পাশাপাশি সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ এবং সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ক্রীড়া, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানামুখী কর্মসূচি প্রতিবছর নেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রাণপুরুষ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতিকে স্মরণীয় করার জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট। গবেষণা সহায়ক হিসেবে এখানে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেল তৈরি করা হয়েছে এবং সেগুলো তথ্যসমৃদ্ধ করার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এমফিল ও পিএইচডিসহ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই জনপদে প্রতিষ্ঠিত ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট একটি গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক হিসেবে দিকনির্দেশনা দেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আওতায় উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ‘Improvement of Teaching-Learning in Economics’_শিরোনামে একটি প্রকল্প অর্থনীতি বিভাগ পরিচালনা করছে।
বর্তমান সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় অবকাঠামো উন্নয়নের প্রথম ধাপে ২০০৯-২০১২ সালের মধ্যে সর্বমোট ২২টি অবকাঠামোর কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের পরামর্শ অনুযায়ী আইনকানুন, রুলস-রেগুলেশন এবং যে অ্যাক্টের মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আন্তরিক হয়েছে। অভিভাবকদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেছে। স্থানীয় সুধীজন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবীদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করেছি। কোনো অবস্থাতে যাতে ক্লাস ও পরীক্ষা বিঘি্নত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আমরা সব সময় সচেষ্ট আছি।
কালের কণ্ঠ : এসব কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। আমি সরকারের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, যখন যেভাবে চেয়েছি তা দ্রুতগতিতে সহায়তা পেয়েছি।
কালের কণ্ঠ : নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বর্তমানে কোন সমস্যাগুলো আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বলে মনে হচ্ছে?
আবদুল জলিল মিয়া : কোনো সমস্যা সমস্যা নয়, আমরা সবাই মিলে একটি পরিবার। সবার চিন্তা হওয়া উচিত গঠনমূলক। সবাই শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। মতাদর্শ যা-ই থাকুক না কেন, দলাদলি, হানাহানি ভুলে গিয়ে শিক্ষার উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এটাই কাম্য।
কালের কণ্ঠ : গত ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়টি তিন বছর পূর্ণ করেছে, ইতিমধ্যেই এখানে ২০টি বিভাগ খোলা হয়েছে। এত অল্প সময়ে এতগুলো বিভাগ চালু করে তা সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে কিভাবে?
আবদুল জলিল মিয়া : হ্যাঁ, গত ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। আমি আগেই বলেছি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক সহযোগিতা আছে বলেই সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : প্রায় প্রতিটি বিভাগই তরুণ শিক্ষকরা পরিচালনা করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতার অভাব একাডেমিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে কি না?
আবদুল জলিল মিয়া : না। একাডেমিক কার্যক্রমে তেমন প্রভাব ফেলছে না। কারণ আমাদের এখানে ক্রেডিট ও সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। যারা প্রথম বছর ভর্তি হয়েছে, তারা এখন তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। কাজেই তরুণ শিক্ষক হলেও তৃতীয় বর্ষের বিষয়ে পাঠদানে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া প্রায় প্রতিটি বিভাগেই দুই-একজন করে সিনিয়র শিক্ষক রয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্বাহী হিসেবে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : এখানে মোটামুটি সবাই অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। আপনি চারদিকে যা দেখছেন তা তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। তবে নতুন হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈড়হপবঢ়ঃ বুঝে উঠতে সময় লাগবে। ইতিমধ্যে সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। যেটুকু সমস্যা রয়েছে, আমার বিশ্বাস তা অল্পদিনের মধ্যেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ : নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে স্থানীয় প্রশাসন বা সাধারণ মানুষের কাছে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন। তাদের কাছে আপনি কেমন সহযোগিতা আশা করেন?
আবদুল জলিল মিয়া : আমি আগেই বলেছি, স্থানীয় প্রশাসন, সুধীজন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবীদের যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি। সহযোগিতার এই ধারা অব্যাহত থাকলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন করতে সামনে আরো কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আবদুল জলিল মিয়া : শিক্ষার্থীরা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোমল মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চার, দেশপ্রেম তৈরিসহ সর্বোপরি দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ক্যাম্পাসে একটি শহীদ মিনার ও একটি স্বাধীনতা ভাস্কর্য নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আপামর জনসাধারণ স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষা ও একাত্তরের মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে দেশের কল্যাণে গড়ে তোলার এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করার শপথ নেবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে অনুমোদিত ২০টি বিষয় ছাড়াও আরো নতুন বিষয় অনুমোদন প্রয়োজন। বিষয় না পেলে হয়তো বিল্ডিং খালি পড়ে থাকবে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরেই দ্বিতীয় পর্যায়ের অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্যায়েও ২২টি অবকাঠামো আছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের কিছু অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?
আবদুল জলিল মিয়া : কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নিয়োগ বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে পরীক্ষা সম্পন্ন করে সিন্ডিকেটের অনুমোদনের মাধ্যমে স্থায়ী নিয়োগ প্রদান করা হয়। তা ছাড়া এযাবৎ বিভিন্ন পদে যাঁরা কর্মরত আছেন, প্রতিটি পদই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত এবং যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই পদগুলো পূরণ করা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আবদুল জলিল মিয়া : শিক্ষা ও গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং Research Think Tank--গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের আধুনিক মানসম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক_এটাই আমার স্বপ্ন। আমি বিশ্বাস করি উত্তর জনপদের অবহেলিত মানুষের স্বপ্নের ক্যাম্পাস হবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ
আবদুল জলিল মিয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments