চীনে আজীবন একনায়ক by কামাল আহমেদ
চীনা
কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে যখন সি চিন পিংয়ের রাজনৈতিক ভাবনাকে সি-র
চিন্তাধারা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তখনই ধারণা করা হয়েছিল এ রকম কিছু
একটা ঘটতে যাচ্ছে। চীনা বিপ্লবের নেতা ও পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে-তুংয়ের
রাজনৈতিক ভাবনা যেভাবে মাওয়ের চিন্তাধারা হিসেবে দলে স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং
অনুসৃত হয়েছিল, দলের সেক্রেটারি জেনারেল সি-র রাজনৈতিক দিশার অনুরূপ
স্বীকৃতিলাভ ইঙ্গিতবহ ছিল বৈকি। মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ১৫ বছরের
কিশোর সি দলের নির্দেশে লাখো তরুণের মতোই দেশকে জানতে প্রত্যন্ত
গ্রামাঞ্চলে ফিরে গিয়েছিলেন। বলা হয়, তিনি গুহায় জীবন যাপন করেছেন। শাংসি
প্রদেশের লিয়াংজিয়াহে সাত বছর অবস্থানের পর ২২ বছর বয়সে তিনি বলেছিলেন,
তিনি আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এবং তাঁর জীবনের লক্ষ্য তিনি ঠিক করে ফেলেছেন।
তাঁর জীবনের সেই লক্ষ্য কী ছিল, তা আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। কিন্তু
ধারণা করি, ১১ মার্চ রোববার চীনের পার্লামেন্ট বা পিপলস কংগ্রেস তাঁর সেই
লক্ষ্য পূরণ করেছে। দেড় শ কোটি মানুষের দেশে তিনি এখন একচ্ছত্র ক্ষমতার
অধিকারী। ঊনবিংশ কংগ্রেসেই তাঁর ভাবধারার যে মূল কথাটি আমরা জেনেছিলাম তা
হলো, তিনি বলেছিলেন চীনকে মহান জাতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন।
প্রেসিডেন্ট পদে পাঁচ বছরের দুটি মেয়াদের অবসান ঘটানোর সংশোধনী অনুমোদনের
পর পিপলস কংগ্রেসের চেয়ারম্যান ঝ্যাং দেজিয়াং দলের সবার প্রতি আহ্বান
জানিয়ে বলেছেন, চীনকে আবার মহান জাতিতে রূপান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট সি-র
পেছনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। চীনকে আবার মহান বানানোর বিষয়টি অনেকটা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট
অ্যাগেইন’-এর মতো। চীনকে আবারও মহান জাতিতে রূপান্তরে প্রেসিডেন্ট সি-র
ভাবধারাকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি উগ্র সংস্করণ থেকে খুব একটা আলাদা করা
যাবে কি না, তা আগামী দিনগুলোতে নিশ্চয়ই আরও স্পষ্ট হবে।
মাওয়ের জীবদ্দশায়
চীন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। দারিদ্র্যের
বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে তাদের লড়তে হয়েছে। কিন্তু একুশ শতকে চীনে শিল্প
ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেছে। দেশটি গত কয়েক দশকে ‘বিশ্বের কারখানা’র খ্যাতি
অর্জনের পর এখন নজর দিয়েছে সৃজনশীল অর্থনীতির দিকে। বিশ্বে এখন তারা
দ্বিতীয় প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। স্বভাবতই, প্রেসিডেন্ট সি-র ভাবধারার
প্রচারে এখন আলো ঝলমলে শহরগুলো রঙিন বিলবোর্ডে ভরা। রাজনীতির পণ্ডিতেরা বলে
থাকেন যে চীনের অভাবিত অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ তরুণ
নেতৃত্ব। দলের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে কেউ দুই মেয়াদের বেশি থাকতে না পারায়
নতুন নেতারা নতুন উদ্দীপনা ও উদ্যোগ নিয়ে দলে নতুন জীবনীশক্তি যোগ
করেছিলেন। স্পষ্টতই এখন সেই ধারার অবসান ঘটছে। তবে গত কংগ্রেসে সর্বোচ্চ
নীতিনির্ধারণী কমিটি পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে যাঁদের ওই বিধির
কারণে সরে যেতে হয়েছিল, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী হয়, এখন সেটাও অবশ্য দেখার
বিষয়। সি-র এই আজীবন ক্ষমতায় থাকার বিরোধিতা দেশটির ভেতরের কেউ খুব একটা
করার সাহস পাবেন বলে মনে হয় না। তবে অবসরে থাকা সংবাদপত্রের একজন সাবেক
সম্পাদক লি দাতং, যিনি এর আগে উদারপন্থী সমালোচক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন,
তিনি একটি খোলা চিঠিতে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গার্ডিয়ান তাঁর
চিঠি উদ্ধৃত করেছে। লি দাতং বলেছেন, ‘এই পদক্ষেপ চীন ও চীনা জনগণকে ধ্বংস
করে দেবে। সুতরাং আমি চুপ থাকতে পারি না। আমি তাদের (পার্টি) জানাতে চাই যে
প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করার মতো লোক আছে।’ হংকং থেকে প্রকাশিত সাউথ চায়না
মর্নিং পোস্ট-এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্যারি হুয়াং লিখেছেন, ‘ইতিহাস দেখিয়ে
দিয়েছে যে আজীবন দায়িত্বে থাকার চেষ্টা করেও অনেক নেতাই সফল হননি। অনেকে
ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, অন্যরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে নিহত
হয়েছেন।’ প্রেসিডেন্ট সি-র জীবনীকার এলিজাবেথ ইকোনমির ভাষায় বৈশ্বিক
বিষয়গুলোর কেন্দ্রে চীনকে প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি যে
বিশ্বাস করেন, ক্ষমতার সব চাবি নিজের দখলে নেওয়ার মধ্যে তাঁর সেই
প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটেছে। দল ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব একক কেন্দ্রে
কেন্দ্রীভূত থাকার আরেকটি বিপদের কথাও এলিজাবেথ মনে করিয়ে দিয়েছেন, যেটি
আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যদি কমতে
থাকে কিংবা কোনো একটি বড় দুর্যোগ দেখা দেয়, তাহলে সম্ভাব্য ব্যর্থতার দায়ও
এককভাবে তাঁর কাঁধেই বর্তাবে। সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র রাশিয়ার লৌহমানব
পুতিন গত ২০ বছর একটানা ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে সামান্য কৌশলী হয়ে কিছুকাল
প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু চীনে প্রেসিডেন্ট সি সে রকম
কোনো রাখঢাকের ধার ধারেননি। চীনের এই পরিবর্তনের প্রভাব শুধু যে চীনের
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির পরিধিতে আবদ্ধ থাকবে, তা নয়। পুরো এশিয়া
এবং বাকি বিশ্বকেও এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।
No comments