'সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন' এই ধুয়াটির নেপথ্যের রহস্য কী? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আজ
এমন একটি লেখা লিখছি, যা পাঠ করে আমার একশ্রেণির পাঠক হয়তো এই ভেবে দুঃখ
পাবেন যে, দেশময় যখন দেশি-বিদেশি শক্তিশালী মহল থেকে 'সবার অংশগ্রহণে
সুষ্ঠু নির্বাচন' অনুষ্ঠানের দাবি উঠেছে, তখন আমি এই দাবির উদ্দেশ্য
সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করছি কেন? আমি সহৃদয় পাঠকদের আশ্বস্ত করতে
চাই যে, আমি নিজেও এই দাবিটির সমর্থক। দেশের সব ছোট-বড় দেশপ্রেমিক দলের
অংশগ্রহণে সুষ্ঠু এবং পরিচ্ছন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক- এটার বিরোধিতা কেউ
করতে পারে না। বিএনপি এই নির্বাচনে যোগ দিক এবং জয়ী হলে ক্ষমতায়
প্রত্যাবর্তন করুক- এটা সবার সঙ্গে আমারও আন্তরিক কামনা। কিন্তু আমার
সন্দেহ, 'সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন'- এই স্লোগান অথবা দাবিটি দেশি-বিদেশি
বিশেষ মহল তাদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে।
দাবিটি এতই নির্দোষ এবং নিরপেক্ষ মনে হয় যে, সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারবে
না, এর ভেতর কোনো রাজনৈতিক কূটকৌশল লুকানো আছে। ২০১৮ সালের প্রত্যাশিত
সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণে কোনো নিবন্ধিত দলেরই (নির্বাচন কমিশন কর্তৃক
অযোগ্য ঘোষিত দল বা দলগুলো ছাড়া) কোনো রকমের বাধা নেই। বিএনপির তো নেই-ই।
সুতরাং আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যে প্রত্যাশিত, তাতে কোনো সন্দেহ
নেই। একমাত্র বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার কথা বলছে। এটা
তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এ অবস্থায় আমাদের একটি সুশীল সমাজ এবং তাদের
পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা কয়েকটি দেশ 'সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন' অনুষ্ঠানের
স্লোগানটি হঠাৎ এত বেশি লুফে নিয়েছেন কেন? তাদের দাবি তো সরকারের কাছে
একটাই হওয়া উচিত, নির্বাচন যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। তাহলে অন্যান্য পশ্চিমা
দেশের মতো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপির ধুয়া, এই
সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। এটা তাদের সন্দেহ, কোনো
প্রমাণ নেই। তথাপি নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য
জাতিসংঘের মাধ্যমে কঠোর পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিএনপির ওপরই
নির্বাচনে যোগ দেওয়ার চাপ দেওয়া উচিত পশ্চিমা দেশগুলোর। তা না করে কিছু
পশ্চিমা দেশ এবং আমাদের একটি সুশীল সমাজ স্লোগান তুলেছে, 'সব দলের
অংশগ্রহণে নির্বাচন'। আমার ধারণা, 'সব দল' কথাটা এখানে স্মোকস্ট্ক্রিন; আসল
কথায় বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন যেন না হয়। আর বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হবে
আওয়ামী লীগ সরকারকেই। সেটা হাসিনা সরকার কীভাবে করতে পারে? একমাত্র তাদের
দাবি মেনে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তাদের পছন্দমতো তথাকথিত নির্বাচন সহায়ক সরকার
গঠন করে সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা দ্বারা।
তাই নয়
কি? এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি মহলগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে আন্তরিক ও
নিরপেক্ষ হলে তাদের উচিত, এই নির্বাচন আরও অবাধ ও সুষ্ঠু করার ব্যাপারে
তাদের তদারকির ব্যবস্থা সম্পর্কে বিএনপিকে আশ্বস্ত করে নির্বাচনে
অংশগ্রহণের জন্য চাপ দেওয়া। অন্যদিকে বিএনপিরও উচিত, অন্যান্য দেশের মতো
ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক ব্যবস্থা মেনে নিয়ে
সরকারের কাছে জোর দাবি তোলা, তাদের শান্তিপূর্ণ সভা-শোভাযাত্রায় পুলিশের
হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, গ্রেফতারকৃত কর্মী ও নেতাদের বিরাট অংশকে মুক্তি দেওয়া
এবং অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরির নিশ্চিত ব্যবস্থা করা। খালেদা
জিয়াকে মুক্ত করার জন্য তারা একদিকে লিগ্যাল ব্যাটেল এবং পাশাপাশি
শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাতে পারেন। তাতে আওয়ামী লীগ সরকার বাধা দিলে জনগণই
এই সরকারের ওপর বিগড়ে যাবে এবং নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে। বিএনপি নেতারা
তো স্বীকার করছেন, তাদের নেত্রী জেলে যাওয়ার পর দল আরও ঐক্যবদ্ধ ও
শক্তিশালী হয়েছে। আসলে কিছু পশ্চিমা দেশ এবং তাদের অনুগ্রহপুষ্ট দেশি
বুদ্ধিজীবী ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা অসম্ভব
করার জন্য যে খেলাটি খেলেছিলেন, এখন আবার সেই খেলাটিই অন্যভাবে খেলতে চান।
সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান- এটা সবার কাছেই মনে হবে একটি নির্দোষ ও
নিরপেক্ষ দাবি। সরল জনমনে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি দ্বারা তারা চান, সব দল নয়,
বিএনপিকে নির্বাচনে টানতেই হবে এবং সে জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবস্থা
গ্রহণ করুক। সেই ব্যবস্থা হলো বিএনপির সব ন্যায়-অন্যায় দাবি মেনে
নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের দৃশ্যত পরাজয় মেনে নেওয়া। এই আসল কথাটা মুখে
বলতে না পেরে তারা সবার অংশগ্রহণের আপ্তবাক্যের আড়ালে নতুন খেলাটি খেলছেন।
তা না হলে এই দেশি-বিদেশি মহলগুলো বিএনপির ওপরই চাপ দিত নির্বাচনে
অংশগ্রহণের জন্য। অন্যদিকে সরকারকেও পরামর্শ দিত, কীভাবে সুষ্ঠু ও অবাধ
নির্বাচন অনুষ্ঠান আরও নিশ্চিত করা যায়। আমাদের সুশীল সমাজের কেউ কেউ
ঠারেঠোরে বলার চেষ্টা করছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনটি বৈধ হয়নি। কারণ, তাতে
সবার (বিএনপির) অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু তারা ভুলে যান, কোনো দেশে
ক্ষমতাসীন দল যখন কোনো বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয় না, তখন
সেই নির্বাচন সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয় না। ২০১৪ সালে বিএনপিকে নির্বাচনে যোগ
দিতে বাধা দেওয়া হয়নি। তারা কিছু অবাস্তব দাবি তুলে নিজেরাই নির্বাচনে
যায়নি। অথচ সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন
পরিষদ সব নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভও করেছে। কোনো
দল নিজেদের ইচ্ছায় নির্বাচনে না গেলে সেই নির্বাচন যদি অবৈধ হয়, তাহলে ১৯৭০
সালে ইয়াহিয়া সরকারের আমলে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে মওলানা
ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মতো একটা বড় দল (কারও কারও মতে,
তখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল) 'ভোটের আগে ভাত চাই' এই
দাবি তুলে নির্বাচন বয়কট করা সত্ত্বেও সেই নির্বাচন বৈধ বিবেচিত হলো
কীভাবে? একশ্রেণির ব্রিটিশ ও মার্কিন কূটনীতিকও বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে
নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধুয়ায় কণ্ঠ মিলিয়েছেন। তারা ভুলে গেছেন, রোডেশিয়ায় যখন
ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন ব্রিটিশ সরকার সেখানে নির্বাচন
দেয়, যাতে তারা একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে তারা কৌশলে দেশটির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল রবার্ট
মুগাবের দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করে। অতঃপর তাদের তাঁবেদার
একটি দলকে নির্বাচনে জিতিয়ে এনে দলটির নেতা বিশপ মুজারেওয়াকে সরকার গঠন
করতে দিয়েছিলেন। মুজারেওয়া অবশ্য বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। কিন্তু
ব্রিটিশ সরকার ওই নির্বাচন ও মুজারেওয়া সরকারকে বৈধ বলে চালাতে চেয়েছিল।
একই ঘটনা ঘটেছে কয়েক বছর আগে আফগানিস্তানে কারজাই সরকারকে নিয়ে। এ রকম
উদাহরণ অনেক আছে। আমার যতদূর মনে পড়ে, এখন যারা বাংলাদেশে প্রচ্ছন্নভাবে
২০১৪ সালের নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাদের মধ্যে একজন ড. কামাল
হোসেন তখন পাপেট কারজাই সরকারের পরামর্শদাতা হয়ে সম্ভবত জাতিসংঘের পক্ষে
কাবুলে গিয়েছিলেন।
কারজাইকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট করার জন্য যে
নির্বাচনটি হয়েছিল, তা ছিল নির্বাচনের নামে এক নির্লজ্জ প্রহসন। আর সে
ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের ইচ্ছায় নির্বাচনে না আসায়
২০১৪ সালে তাদের ছাড়া নির্বাচন হওয়ায় এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত
থাকায়, দেশ-বিদেশের এই গণতন্ত্রপ্রেমীদের রাতে সুনিদ্রা হয় না। খালেদা
জিয়ার দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হওয়া আদালতের ব্যাপার। তাতে নাক গলানো কারও
উচিত নয়। এটা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলও বলেছে। আর সাধারণ
নির্বাচন রাজনৈতিক ব্যাপার। এ সম্পর্কে সবারই কথা বলার অধিকার আছে। এ দুটি
বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। নিম্ন আদালতের রায়ে যদি কোনো ভুল থাকে, তাহলে
তা সংশোধনের জন্য হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট আছে। উচ্চ আদালতে মামলা চালানোর
জন্য বিএনপি তো তাদের অনুগত এক ঝাঁক আইনজীবী থাকা সত্ত্বেও ড. কামাল
হোসেনের কাছে ধর্ণা দিয়েছে। তিনি নাকি পরামর্শ দিতে রাজিও হয়েছেন (যদিও
তিনি ক্রিমিনাল কেসের আইনজীবী নন)। তাহলে বিএনপি কেন আদালতের এখতিয়ার আর
রাজনৈতিক অধিকার- এ দুটি আলাদা বিষয়কে গুলাচ্ছে? খালেদা জিয়াকে ছাড়া
নির্বাচনে যাব না- এই দাবি তোলার অবকাশ তাদের কোথায়? এখন প্রশ্ন, সবার
অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কি সরকারকে আদালতের রায়ে হস্তক্ষেপ করে
খালেদা জিয়াকে জেল থেকে মুক্ত করে দিতে হবে? আওয়ামী লীগের উচিত, সাধারণ
নির্বাচনের ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক দাবি-দাওয়ার কাছে মাথানত না করে
দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরও নিশ্চিত পরিবেশ তৈরি করা
এবং অনাবশ্যক ধরপাকড় বন্ধ করা। অন্যদিকে বিএনপিরও উচিত, নানা দাবি-দাওয়ার
আড়ালে আসন্ন নির্বাচন বানচালের চেষ্টা না করে নির্বাচনে যোগ দেওয়া এবং দেশে
গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার ব্যবস্থা করা। আর আমাদের বিদেশি
হিতৈষীরা যদি সত্যই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক
হন, তাহলে ২০০১ সালের খেলা না খেলে বিএনপি যাতে নির্বাচনে আসে, তার চেষ্টা
এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে হয়, সে জন্য সরকারকে সহযোগিতা করা।
No comments