বিমান দুর্ঘটনা : ও জীবন–মৃত্যুর ম্যানেজার এত মরছি কেন বাংলাদেশিরা?
একসঙ্গে
আজ কাঁদছে বাংলাদেশ ও নেপাল। কাঠমান্ডুর ট্যাক্সিচালকদের যদি জিজ্ঞাসা
করেন, বাংলাদেশে গেছেন? ডু ইউ নো বাংলাদেশ? বেশির ভাগই বলবেন, খুব চিনি। আই
নো বাংলাদেশ, আই লাভ বাংলাদেশ। আরেকটু জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবেন,
বাংলাদেশ বলতে তাঁদের বেশির ভাগই বোঝেন আমাদের প্রধান আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরটিকেই। কেউ কেউ হয়তো আশপাশের সস্তা হোটেল পর্যন্ত গেছেন। নেপালের
শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ট্রানজিট বাংলাদেশ। সমুদ্রহীন নেপালের জন্য
এটাই সহজ ও সস্তা রুট। আকাশ থেকে দেখা বাংলাদেশকে তাঁদের ভালো লেগে যায়।
বাংলাদেশের বিশাল নদীগুলিকে মনে হয় সমুদ্র। ঠিক যেভাবে মাউন্ট এভারেস্টের
বিশালতা ও শুভ্র সোনালি রূপ সমীহ ও বিস্ময় জাগায় আমাদের মনে। কাঠমান্ডুর এক
ভদ্রলোক চাঁদপুরে মেঘনার মোহনাকে সমুদ্র বলে ভেবেছিলেন! নাগরকোটে পাহাড়ে
চড়তে চড়তে ক্ষীণ ঝরনা দেখিয়ে সঙ্গের নেপালি বন্ধুকে বলেছিলাম, এই চিকন
জলধারাই আমাদের দেশে গিয়ে বিশাল নদী হয়ে যায়। তোমাদের হিমালয়গলা পানিই
বাংলাদেশকে বাঁচায়। নেপাল থেকে সব সময় জীবনই আসত, এবার এল মৃত্যুর ঢল। কেন?
বিমান বাংলাদেশে করে ঢাকায় ফেরার পথে পরিচয় হয় নেপালি যুবক রাজুর সঙ্গে।
কাতারে শ্রমিকের কাজ করেন। পরিচয়ের পর কী তাঁর খাতির-যত্ন। ঢাকায় নামার পর
বিদায়ের সময় তাঁর চোখ ছলছল। সেই ত্রিভুবন বিমানবন্দর আজ আবারও কাঁদাল।
গতকালের ভয়াবহ ঘটনাটির পর ছবিতেও দেখলাম, পাশাপাশি শুয়ে আছে বাংলাদেশি ও
নেপালিদের লাশগুলো। তার কিছুক্ষণ আগেও যখন পাশাপাশি বসে ছিল প্লেনে, তখন
হয়তো কথা হয়েছিল, গল্প হয়েছিল। বিপ্লব ও নির্বাচনের পর নেপালে এখন আশাবাদের
জোয়ার। রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়ি যেতে চাওয়া ১৩ নেপালি
ছাত্রছাত্রী, কিংবা প্রশিক্ষণে আসা ১৬ পর্যটনকর্মীরা হয়তো নতুন নেপাল নিয়ে
উচ্ছ্বসিতই ছিল। হয়তো সেসব কথা বলছিল বাংলাদেশি সহযাত্রীদের। সেই
সহযাত্রীদের মধ্যে হয়তো ছিল ৩ মার্চে বিয়ে করে হানিমুনে যাওয়া চট্টগ্রামের
মিনহাজ ও আঁখি। মেহেদি হাসান রোমিও নামের বরের সঙ্গে তৃতীয়বারের হানিমুনে
যাচ্ছে নেপালে। আলোকচিত্রী প্রিয়ক গেছেন স্ত্রী অ্যানি ও সন্তান
প্রয়ন্ময়ীকে নিয়ে। সঙ্গে বন্ধু স্বর্ণা। তাহসিন ও তানিম দুই বন্ধু আর নেই,
নেই সরকারি কর্মকর্তা উম্মে সালমা ও নাজিয়া আফরিন চৌধুরী। কারও বাবা-মা
মারা গেছেন, কেউবা মারা গেছে পরিবারসুদ্ধ। স্মৃতি হয়ে গেছে রফিক জামান,
সানজিদা হক ও তাঁদের সন্তান অনিরুদ্ধ। পাশাপাশি হলুদ লাশের ব্যাগে তাঁরা
শুয়ে ছিলেন নেপালি মানুষদের সঙ্গে। একসঙ্গে কাঠমান্ডু যেতে গিয়ে একসঙ্গে
চলে গেলেন জীবনের ওপারে। গন্তব্য বদলায়নি তাঁদের। কেন, কার দোষে? রহস্য
কাটেনি। ইউএস-বাংলার অভিজ্ঞ পাইলটের সঙ্গে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল
টাওয়ারের কথোপকথনের রেকর্ড প্রকাশের পর প্রশ্ন আরও জটিল হয়েছে। যাঁরা
সবকিছু খুলে বলতে পারতেন, সেই তিন পাইলটই মারা গেছেন। বিমানের ব্ল্যাকবক্সই
কেবল ভরসা। কিন্তু সত্য জানতে লেগে যাবে অনেক দিন। তদন্ত হোক, সত্যটা জানা
হোক। মৃত্যুর বিরুদ্ধে সত্য একটা সান্ত্বনা ও রক্ষাকবচ। গাফিলতি কার তা
জানা গেলে অন্তত ভবিষ্যতে সতর্ক হওয়ার সুযোগ থাকবে।
কিন্তু আরও সহজ-সরল
সত্য হলো, অবিশ্বাস্য অবহেলা। যে দেশে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের
নাট-বল্টু আলগা করা থাকে, সেই দেশে জননিরাপত্তার অবস্থা কোন রসাতলে নেমেছে,
ভাবা যায়! এ দেশে সবই খরচযোগ্য হয়ে গেছে। মানুষ খরচযোগ্য, জীবন সস্তা,
জবাবদিহিটাই শুধু দামি। অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। নিয়মিতভাবে হুতাশে মরে
যাচ্ছে একেকজন। এই মৃত্যুগুলো ব্যক্তিগত না, আমাদের যৌথ মৃত্যুরই অংশ।
ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার বলেছিলেন, আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো
শোকযাত্রা উদ্যাপন করে চলেছি (We are each of us celebrating some
funeral)। তিনি কথাটা বলেছিলেন আধুনিক সময়ে ব্যক্তি মানুষের কথা ভেবে।
আধুনিকতা আমাদের দূরে নিয়ে যায়, বিদেশ–বিভুঁইয়ে মরে যান স্বদেশিরা। শুধু
ব্যক্তিগত না, জাতীয়ভাবেও সামষ্টিক মৃত্যুর শোকমিছিল করে চলেছি। গত ১৫ দিনে
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জন শ্রমিক নিহত হলেন, আহত কমপক্ষে
১৫ জন। তার পরে নারায়ণগঞ্জে বাস-লরির সংঘর্ষে নিহত হন ৯ জন। একই সময়ে
সিলেটে পাথরের কেয়ারি ধসে মারা যান বেশ কয়েকজন শ্রমিক। বছরে প্রায় আট হাজার
মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। গরিব মানুষের মৃত্যুর শোক আমাদের অনেককে না
ছুঁলেও মধ্যবিত্তের অপঘাতের মৃত্যু ঠিকই দম চেপে ধরে। মনে হয়, আমাদের একটা
অংশের মৃত্যু হলো। মনে হয়, এভাবে তো আমরাও মরে যেতে পারি! গরিব মানুষের
জীবন যেমন ঝুঁকির কিনারা দিয়ে চলে, মধ্যবিত্ত জীবনের কাছেও চলে এসেছে
মৃত্যুর সেই কুৎসিত সাঁড়াশি। তার চাপ এড়াতে পারি না আমরা। হয়তো আমরা এখন
বুঝতে পারছি, সব জীবনই সমান, সব রক্তই মানুষের, সব অশ্রুই সমান নোনা। যার
যায়, তার সবটাই যায়। জীবন তুচ্ছ হয়ে গেছে এ দেশে। তুচ্ছ মানুষেরা এতই তুচ্ছ
যে তাদের মৃত্যুকেও তুচ্ছ করে দেওয়া যায়। তুচ্ছ মানে ফালতু, সস্তা,
খরচযোগ্য, এমনকি হত্যাযোগ্যও। যেমন গতকাল পুলিশের রিমান্ডে থাকার পরই মরে
গেলেন ছাত্রদলের এক নেতা।
রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এ ধরনের মানুষকে বলা হতো
‘হোমো সাসের’। তারা স্বাধীন নাগরিকও ছিল না, আবার তাদের দাসও বলা যেত না।
তাদের হত্যায় অপরাধ হতো না। আত্মপক্ষ সমর্থনের যোগ্যতা ছিল না তাদের। তাদের মৃত্যু কখনো পবিত্রতার মর্যাদা তথা শহীদি সম্মান পেত না। অবহেলা আর
নিষ্ঠুরতায় আমরা কি সম্মিলিতভাবে হোমো সাসের দশায় পড়ে যাচ্ছি? দুর্ঘটনাই
বলি আর অপঘাতই বলি, জীবনের চেয়ে মৃত্যুই এখানে বেশি সাবলীল ও গতিশীল।
স্বজনদের কাটা ঘায়ে বিচার না হওয়ার লবণ লাগে বারবার। কমে যাচ্ছে জবাবদিহি
চাইবার সাহস। সর্বশেষ, মিরপুরে আগুনে লেগে বা লাগিয়ে পুড়ে বা পোড়ানো হয়েছে
২৫ হাজার বস্তিবাসীর ঘরবাড়ি-সহায়সম্পদ। ২৫ মার্চের কালরাতেও বস্তি পোড়ানো
হয়েছিল, মনে পড়ে কি? আগুন লাগার সময়গুলো চমৎকার। রাজনৈতিক ডামাডোল, জাতীয়
বা আন্তর্জাতিক শোরগোল কিংবা অন্য কোনো হট্টগোলের মধ্যে অবলীলায় আগুন লেগে
যায় মিরপুরে বা কালশীতে বা করাইল বস্তিতে। এগুলো দুর্ঘটনা, না পরিকল্পিত
কাজ, তা জানা যায় না। যেমন জানা যায় না, এত দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার পরও
দেশের বিমান চলাচল ব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্য কবে জীবনবান্ধব হবে, মানুষবান্ধব
হবে। মৃত্যুগুলো যেমন আলাদা নয়, সমস্যাগুলোও তেমন বিচ্ছিন্ন না। বাঁচতে হলে
তাই জানতে হবে। জানতে হবে সত্য, আর চাইতে হবে জবাবদিহি। ওপরঅলা
জীবন–মৃত্যুর মালিক। কিন্তু জীবন ও অধিকারের ম্যানেজার তো সরকার। তাঁদের
কাছে দাবি তোলাই জীবনের পয়লা শর্ত এখনকার বাংলাদেশে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
No comments