রোহিঙ্গাদের পোড়া বাড়িতে সেনা অবকাঠামো, হেলিপ্যাড, সড়ক
উদ্বেগজনক
হারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে সামরিকীকরণ করা হচ্ছে। সেখানে পুড়িয়ে দেয়া
রোহিঙ্গাদের বসতভিটা, সম্পত্তি গ্রাস করছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর জন্য
নানা রকম ঘাঁটি নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে। কয়েক মাস আগে যেসব স্থানে
রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তা বুলডোজার দিয়ে সমান করে দেয়া
হচ্ছে। সেখানে এক সময় জনবসতি ছিল- এমন চিহ্ন পর্যন্ত রাখা হচ্ছে না। এসব
স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে সেনা ঘাঁটি, হেলিপ্যাড। পুড়িয়ে দেয়া গ্রামগুলোর
ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে সড়ক। ‘রিমেকিং রাখাইন স্টেট’ শীর্ষক সর্বশেষ
রিপোর্টে এসব কথা বলেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল। ২৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে সোমবার।
এতে ব্যবহৃত হয়েছে স্যাটেলাইটে তোলা সর্বশেষ ছবি। যুক্ত করা হয়েছে
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য। সবকিছু বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স পরিচালক তিরানা হাসান বলেছেন, রাখাইনে
আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো নাটকীয় গতিতে সেনাবাহিনী ভূমি গ্রাস করছে।
যেসব বাহিনী সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের জন্যই
ওই সব স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে ঘাঁটি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের যেসব
গ্রাম বা জমি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার ওপর দিয়েই নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন
নতুন সড়ক ও অবকাঠামো। এর ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা
তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আরো কমে গেছে। তিরানা হাসান বলেন, এর ফলে
রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফেরত যাওয়া এখন
সুদূরপরাহত। শুধু তাদের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এমন নয়। এখন সেখানে নতুন
নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, রাখাইনে কীভাবে
রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম খেয়াল খুশিমতো এবং টার্গেট করে সেনাবাহিনী পুড়িয়ে
দিয়েছে তা প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও
অন্যরা। সোনবাহিনী শিশু, নারী, পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। গণহারে
ধর্ষণ করেছে বালিকা ও নারীদের। এ ছাড়া তাদের ওপর চালানো হয়েছে অন্যান্য যৌন
সন্ত্রাস। পর্যায়ক্রমিকভাবে তারা পুড়িয়ে দিয়েছে শত শত গ্রাম। ঘটিয়েছে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এর ফলে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে
আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। অ্যামনেস্টি তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে প্রকাশ
করেছে, কীভাবে জানুয়ারি থেকে বুলডোজার দিয়ে রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘর
মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। এমন কি ওইসব বাড়ি বা গ্রামগুলোর চারপাশের
গাছপালা ও সবজি ক্ষেতও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ এলাকা এমন করে
দেয়া হয়েছে যে, কেউ এখন আর তা চিনতে পারবে না। এর ফলে মারাত্মক উদ্বেগ দেখা
দিয়েছে। উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো অপরাধের
প্রমাণ কর্তৃপক্ষ একেবারে মুছে দিচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে তদন্তে কিছুই ধরা না
পড়ে। তিরানা হাসান বলেন, পুরো গ্রামকে বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে
দেয়া অবিশ্বাস্য রকম উদ্বেগের বিষয়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মানবতার বিরুদ্ধে
অপরাধের সব প্রমাণ মুছে দিচ্ছে। তবে তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো সেখানে
এখন দ্রুতগতিতে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে
অবকাঠামো। নির্মাণ করা হচ্ছে সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের জন্য
আবাসন। নির্মাণ করা হচ্ছে হেলিপ্যাড। যে গতিতে এই নির্মাণকাজ চলছে তা আরো
উদ্বেগজনক। স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে হাতেগোনা দু’এক
মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওইসব গ্রামে নতুন নতুন অবকাঠামো গজিয়ে উঠছে। এসব
অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পুরো গ্রাম, আশেপাশের বন কেটে জায়গা বানানো হয়েছে।
স্যাটেলাইটের ছবিতে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে নিরাপত্তা
রক্ষাকারীদের জন্য কমপক্ষে তিনটি ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি
নির্মাণ করা হয়েছে মংডু এলাকায়। একটি নির্মাণ করা হয়েছে বুথিডংয়ে। দৃশ্যত
এসব অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে জানুয়ারিতে। সবচেয়ে বড় অবকাঠামো বা
ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে বুথিডং এলাকায় আহ লেল চুং গ্রামে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সেখানকার নির্ধারিত
এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদেরকে জোর করে উচ্ছেদ করেছে সেনাবাহিনী। জানুয়ারিতে ওই
এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন ৩১ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তিনি বলেছেন,
ওই অঞ্চলের মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত। তারা সেখানে থাকতে চাইছে না। কারণ, তাদের
ওপর আরো সহিংসতা চালানো হতে পারে। মংডু শহরের বাইরে কান কাইয়া নামের একটি
গ্রামের স্যাটেলাইট ছবি ধারণ করেছে অ্যামনেস্টি। আগস্টের দু’মাস পরে ওই
গ্রামের ধারণ করা ছবিতে দেখা যায় বসতি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মার্চের
শুরুতে ধারণ করা ছবিতে দেখা যায়, ওই সব জমির ওপর ভবন দৃশ্যমান। অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বাস করছে, এটা হতে পারে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর
জন্য নতুন ঘাঁটির অংশ। একই রকম ভবন বা ভবন নির্মাণের তৎপরতা দেখা গেছে ইন
ডিন গ্রামে। এই গ্রামেই ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছিল মিয়ানমার।
উল্লেখ্য, ২৫শে আগস্ট রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা শুরুর পরে বাধ্য হয়ে
প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এর বেশির
ভাগই মুসলিম। তাদের ওপর চালানো এই নৃশংসতাকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ জাতি
নিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার। তারা দাবি
করে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ওপর আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা)
চালানো হামলার জবাবে তারা অভিযান চালায় রাখাইনে। কিন্তু সমালোচকদের অভিযোগ
সেনাবাহিনী আরসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নামে অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি
প্রয়োগ করেছে। এটা জাতি নিধন। এর পর থেকে ওই এলাকায় কোনো মানবাধিকারকর্মী
বা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে যেতে দেয়া হয় নি। অনুমতি পান নি জাতিসংঘের
তদন্তকারীরাও। জানুয়ারিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা
ছিল। কিন্তু মৌলিক অধিকার বা নিরাপত্তার বিষয়ে গ্যারান্টি ছাড়া বেশির ভাগ
রোহিঙ্গা ফিরে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে। এ অবস্থায় অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে
উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বলেছে, রোহিঙ্গারা যে জায়গা-জমি ফেলে এসেছেন তা
জাতিগত বৌদ্ধ ও অমুসলিম গ্রুপগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হবে। এর মধ্য দিয়ে
রাখাইনে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রমাণ মুছে দেয়া হবে। এ বিষয়ে মিয়ানমার
কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
No comments