উন্নতির পূর্বশর্ত সহনশীলতা by আলমগীর মহিউদ্দিন
ক্রমবর্ধমান
সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্ঘাত এবং অনাচারের ফলে সৃষ্ট অশান্তি ও ভীতিতে
শঙ্কিত হয়ে মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল হেলথ (এনআইএমএইচ)
২০০১-০৩ সালে কয়েকটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। কারণ, তারা খেয়াল করেন, সাধারণ
মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারেও যেন পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অপর দিকে অনাচার ও
অশান্তির ধারার কোনো পরিবর্তন তো নয়ই, বরং তা বেড়ে চলার ধারায় রয়েছে। তাই
তারা অনুসন্ধানে জোর দেন কারণ ও প্রতিকারের ওপর। দীর্ঘ ও ব্যাপক
অনুসন্ধানের ফল তাদের যেমন শঙ্কিত করে, তেমনি তাদের নতুন চিন্তার দুয়ার
খুলে দেয়। তারা অনুভব করেন, সাধারণ মানুষের ব্যবহারগুলো বহুলপ্রচলিত মানসিক
ব্যাধির ধারণার কাছাকাছি। তাই তারা এই মানসিক ব্যাধির সংজ্ঞার ওপরও
সমীক্ষা ও অনুসন্ধান চালান। মার্কিন সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন
মানসিক ব্যাধির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ১৯৫২ সালে প্রথমে একটি ম্যানুয়েল
প্রকাশ করে। এর নাম দেয়া হয় ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল
ম্যানুয়েল ফর মেন্টাল ডিসঅর্ডার (ডিএসএম)। এই ডিএসএম-১এ এই উপসর্গের সংখ্যা
দাঁড়ায় ১০৬টি। ডিএসএম-২এ এই সংখ্যা বেড়ে যায় এবং পরবর্তীকালে অনুসন্ধান ও
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬৫-তে। অর্থাৎ মানসিক
ব্যাধির প্রকারভেদ এত ব্যাপক। এই সংজ্ঞা অনুসারে এনআইএমএইচ বলেছিল, ২০০১
সালে ৪৬ শতাংশ মার্কিনি বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত। ২০১১ সালে এটা বেড়ে
যায় প্রায় ৪০০ শতাংশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ
কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ঘোষণা করে, মানসিক ব্যাধির মহাসংক্রমণ
(এপিডেমিক) শুরু হয়েছে। তবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ
(এনআইএমএইচ) ডিরেক্টর থমাস ইনসেল ডিএসএমের এই ব্যাপক সংজ্ঞায়নকে অনাবশ্যক
বলেছেন। অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন, মার্কিনিদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিশাল
অবনতি ঘটেছে, যা সাধারণত দৃষ্টিগোচর হয় না। এর প্রধান কারণ হিসেবে তিনি
যেমন রাজনৈতিক কারণগুলোকে দায়ী করেছেন, সেই সাথে ওষুধ কোম্পানিগুলোকেও দায়ী
করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের সাহায্যের
জন্য সাপ্লিমেন্টাল সিকিউরিটি ইনকাম (এসএসআই) এবং সোস্যাল সিকিউরিটি
ডিসঅ্যাবিলিটি ইনসিওরেন্স (এসএসডিআই) ব্যবস্থা আছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়,
১৯৮৭-২০০৭ সালে এর ব্যয় বেড়ে যায় প্রায় আড়াই গুণ।
দেখা যায়, ১৮৪ জনের একজন
থেকে বেড়ে ৭৬ জনের একজনে পৌঁছে। মার্সিয়া অ্যাঞ্জেল নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক
বুক রিভিউতে লিখেছেন- এই বিস্তৃতি নিরবচ্ছিন্ন চলছে। অনেক কারণের মধ্যে
তারা তিনটি কারণকে প্রধান বলেছেন এবং এগুলো একযোগে সামাজিক ও রাজনৈতিক
ব্যবস্থা সৃষ্টি করছে। এ তিনটি হলো উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা (অ্যাংজাইটি),
বিষাদগ্রস্ত বা মনমরা (ডিপ্রেশন) এবং কর্মক্ষমহীনকে (ডিসফাংশন)। এগুলো
সৃষ্টির পেছনে ক্ষমতা ও অর্থের লোভ ক্রমাগত কাজ করে চলেছে। রাষ্ট্রের
নিয়ামকেরাও এগুলো সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। যেমন-
জনকল্যাণের জন্য সৃষ্টি করছে নানা সংস্থা, দল ও কর্মকাণ্ড। ব্যবহার করছে সব
প্রচারণার মাধ্যম। এ কর্মকাণ্ডগুলো শুধু নিয়ামকদের কাজে লাগতে দেখা গেলে
তা নিয়ে আলোচনা ও প্রতিবাদ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এমন গোষ্ঠী বা
প্রতিবাদকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী, মৌলবাদী ইত্যাদি আখ্যায়িত করে,
তাদের স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ফলে এ ত্রিবিধ ব্যাধি নানা আকার ধারণ করায়
মার্কিন বিশেষজ্ঞরা এর সংজ্ঞা এত বাড়িয়েছিলেন। তারা শঙ্কার সাথে লক্ষ করেন,
ওষুধ কোম্পানিগুলো এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে বিশাল ব্যবসায় শুরু করেছে।
সিডিসি ২০১৩ সালেই (অর্থাৎ প্রথম বছরে) ঘোষণা করে, আগের দুই বছরের মধ্যে
মানসিক ওষুধের (অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট) ব্যবহার ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে
এর ব্যবহার নারীদের মধ্যে বেড়েছে বেশি। তখন তারা শিশুদের ওপর অনুসন্ধান
চালান। তারা দেখতে পান, ১৩-২০ শতাংশ শিশুও মানসিক রোগে আক্রান্ত। তারা
দেখতে পান, এই বেশির ভাগ রোগের ক্ষেত্রে নানা মানসিক ব্যাধির ওষুধ
(অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট) ব্যবহারের কারণে বাড়ছে এবং এ ওষুধের ব্যবহার এবং তার
সাথে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিশাল প্রচার এক অপ্রতিরোধ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সাংবাদিক রবার্ট হুইটেকার অনুসন্ধান শেষে একটি বই লেখেন ‘এনাটমি অব এন
এপিডেমিক’। এ বইতে তিনি প্রমাণ করেন, মানসিক ব্যাধি সম্পর্কিত বিশাল ওষুধের
বহর মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যাধির বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। এ ওষুধগুলোর
বিস্তৃতির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এগুলো স্বল্প সময়ের জন্য সুস্থতা দেয়।
তবে এর ব্যবহারকারীরা পৌনঃপুনিক ব্যবহার করে এর বিস্তৃতি ঘটায়। ফলে এগুলো
নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায় এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোও প্রচারে নেমে যায়। এর সাথে
সাথে শিশুদের ওপর ব্যবহৃত এসব ওষুধের প্রসারও লক্ষণীয়। যার ফলে শিশু-কিশোরও
এই অপব্যবহারের আওতায় পড়ে যাচ্ছে। পরিণামে দৃষ্টির বাইরে সমাজ মানবিক
রোগের আওতায় এসে পড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষ মানবিক সমস্যাকে কোনো সমস্যাই মনে
করছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে এর আশ্রয় নিচ্ছে। বিপদ হচ্ছে এখানেই। বিপদ এ
জন্য যে, মানুষ কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন
সমাজবিজ্ঞানী লুইস মাশফোর্ড। তিনি বলেন, ‘এখন সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষ
রয়েছেÑ হুকুমদাতা ও হুকুমগ্রহীতা। গুটিকয়েক হুকুমদাতা নিজেদের
স্বার্থ-খায়েশ পূর্ণ করার সব সুযোগ পাচ্ছে, কিন্তু অপর অংশের জীবন নিয়ে
ভাবনার সময়ও দেয়া হচ্ছে না প্রথম অংশের দাবি মেটাতে গিয়ে। এর ফলে অলক্ষ্যে
তারা হয়ে পড়ছে মানসিক ব্যাধির শিকার। বেশির ভাগ মানুষ হয়ে পড়ছে অসহায়,
আশাহীন, উৎসাহহীন, শ্রদ্ধাহীন ও ভীত। অনুসন্ধানীরা বলছেন, সামাজিক এ অবস্থা
সৃষ্টিতে সমাজপতি ও রাজনীতিবিদেরা সবচেয়ে বেশি দায়ী।
যেমন- মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে এক নিরীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে আমেরিকান সোসিওলজিক্যাল
রিভিউ। বেশির ভাগ উত্তরদাতা জীবনকে ক্লান্তিকর (বোরিং) বলেছেন এবং ২৫ শতাংশ
বলেছেন- ‘তাদের বন্ধু নেই’। সমাজবিজ্ঞানী ব্রুস ই লেভিন এক অনুসন্ধান শেষে
মন্তব্য করেছেন- ‘এমন অসহায়, আশাহীন ও বিরক্তিকর জীবনধারীদের নানা অন্যায়
কাজে যেমন- মাদকাসক্ত অথবা ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত হওয়া খুবই সহজ।’ এর ফলে
দেখা যাচ্ছে, সমাজের এক বৃহৎ অংশ অতি সহজেই ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
চতুর ও কৌশলী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী এদের ব্যবহার করছে কখনো স্বীয় স্বার্থ
উদ্ধারে, মুনাফা লুটতে অথবা বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে। এই
শেষোক্ত কর্মকাণ্ডে উৎসাহী হলে এবং এই শ্রেণী ক্ষমতারোহণ করলে
রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন অশান্তি দেখা দেয়। বর্তমান সময়ে বিষয়টি আর
একটু জটিল হয়েছে প্রযুক্তির কারণে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যায়কারীরা যত
দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করতে পারে, অন্য কোনো উপায়ে তা সম্ভব ছিল না। এ জন্য
প্রতিটি যুগে চিন্তাবিদ ও জনকল্যাণকামীরা দু’টি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন- তা
হলো সভ্যতা ও সহনশীলতা। সভ্যতাকে আবার বিশেষভাবে চিত্রায়িত করেছেন সভ্য ও
সভ্যতাকে দিয়ে। সমস্যা এখানেও। যুগে যুগে যারা ক্ষমতাসীন তারা সভ্যতার
সংজ্ঞা দিয়েছেন। তারা রাজ্য, রাষ্ট্র ও জনপদ দখল করে ঘোষণা দিয়েছেন- তারা
যেমন ভাবেন, বলেন ও করেন সেটাই সভ্যতা। যেমন এখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর
রাষ্ট্র মার্কিনিরা বলছেন। তাদের নীতি-কর্মকাণ্ড-বক্তব্যই সত্যিকারে
সভ্যতার প্রকাশ। এর আগে ব্রিটিশ, রোমান, গ্রিকরাও এমন দাবি করেছিল এবং সে
মোতাবেক ক্ষমতা প্রয়োগও করত। অধ্যাপক লরেন্স ডেভিডসন বলেছেন, ‘এসব দাবি
কোনোটিই ঠিক নয়।’ কারণ, এরা ক্ষমতায় যেতে যে ধ্বংসলীলা ও অন্যায় করেছেন, তা
কখনো সভ্য ও সভ্যতা বলা যাবে না। তিনি বলেছেন- ‘ভাষা, ব্যবহার বা জাতীয়তা
এত বেশি ও পৃথক যে তাকে কখনো সভ্যতার প্রতীক বলা যাবে না। তেমনি ক্ষমতা
দখলের জন্য যে রক্তপাত ও ধ্বংস হয় তা কখনোই সভ্যতা হতে পারে না। তাই আলোচনা
ও আন্দোলন হয়েছে- উন্নতি করতে হলে, জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে,
মানুষে-মানুষে বিশ্বাস সৃষ্টি ও শান্তি স্থাপন করতে হলে কোন বিষয়টি হবে
প্রধান। দু’টি মহাযুদ্ধের পর আন্দোলনও হয়েছিল ব্যাপক এবং এখনো এ নিয়ে
আলোচনা চলে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে দু’টি আইন প্রণীত হয়েছে। একটি হলো
অসহিষ্ণুতাকে বেআইনি বলা এবং অপরটি হলো যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করা। এটা সত্য,
দু’টি নীতি বা আইন বারবার পদদলিত হচ্ছে; কিন্তু বিশ্বের মানুষ এ
কর্মকাণ্ডগুলোকে ঘৃণা করে এবং এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এখন এটা
সার্বজনীন সত্য যে, উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে সহনশীলতা। সব কাজেই বাধা আছে,
সমস্যা আছে। সেগুলো সমাধান করতে হলে যেমন সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি সেই
সহযোগিতা গড়ে তুলতে হলে সবাইকে কিছু ছাড় দিতেই হবে এবং সময়ও একটি বড় বিষয়।
তাই সহনশীল না হলে সময় পার করা হবে কঠিন এবং সহনশীল না হলে সহযোগিতাও গড়ে
উঠবে না, বিশ্বাসের ভিত্তি রচিত হবে না এবং কোনো কর্মকাণ্ডই সামনে এগিয়ে
যাবে না। এ জন্যই আজকের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো সহনশীলতা। অর্থাৎ উন্নতির
পূর্বশর্ত হচ্ছে সহনশীলতা, যা গড়বে সহযোগিতার বিরাট সাঁকো; যার ওপর দিয়ে
চলবে উন্নয়নের বাহন।
No comments