রাজনীতিতে নারীর অবস্থান কোথায়? by বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি
আমরা বহু ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছি। এই দিবস পালন করতে
গিয়ে আমাদের কাছে আবারও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে বাংলাদেশের নারীরা
বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও আমাদের সমাজে তাঁরা এখনো ব্যাপকভাবে বঞ্চিত,
নিগৃহীত, নির্যাতিত ও অবহেলিত। এই বঞ্চনা ও নিগ্রহের অন্যতম কারণ হলো,
সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাষ্ট্রীয় থেকে পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত নারীদের ব্যাপক
পশ্চাৎপদতা। আর এই পশ্চাৎপদতা কার্যকরভাবে অবসান করতে হলে প্রয়োজন নারীর
রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। তবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশের
অবস্থান এখনো খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের
কমিটি থেকে শুরু করে সংসদ ও প্রশাসনে নারী-পুরুষের অনুপাত দেখলেই তা
দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ
মূলত জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীরা ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান। এ ধরনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নারীদের জন্য সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে, যা মূলত আলংকারিক। তবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটে সংসদের সাধারণ আসনে নারীর প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে, যে ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও এখনো গর্ব করার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে নারী প্রার্থীর হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ-মোট ১ হাজার ৫৬৬ জনের মধ্যে মাত্র ৫৭ জন, জয়লাভ করেন মাত্র ১৯ জন। তবে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী নারী প্রার্থীর সংখ্যা কমে যায়। নির্বাচনে ২৭টি আসনে নারী প্রার্থী ছিলেন ২৮ জন (৩০০ আসনে মোট প্রার্থী ৫৪৩ জন)। জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী হিসেবে মাত্র ৬ (৩০০ জনের মধ্যে ১৮ জন) শতাংশ আসনে নারীদের বিজয়ী হওয়া রাজনীতিতে নারীর সম্মানজনক অবস্থানের প্রতিফলন নয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ
সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চার হাজার ইউপিতে মাত্র ২৯ জন নারী চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন। পক্ষান্তরে ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ২২৬ জন, জয়ী হন ২৩ জন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। এসডিসির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ ৪৮ শতাংশ কমেছে (প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০১৬)। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯০০; আর ২০১৪ সালের ৪৫৮টি উপজেলা নির্বাচনে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০৭ জনে। এই হিসাবে ২০০৯ সালে প্রতি উপজেলায় ৭ থেকে ৯ জন নারী প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৪ সালে এই হার গড়ে দাঁড়ায় ৩ থেকে ৪ জনে। একইভাবে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ নারী মেয়র পদে জয়লাভ করেন।
রাজনৈতিক দলে নারীর প্রতিনিধিত্ব
রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলে নারীরা দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। প্রসঙ্গত, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরে ২০২০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করার বিধান ২০০৯ সালে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ যুক্ত করা হয়, যাতে রাজনীতিতে নারীর দৃশ্যমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। আমরা মনে করি, প্রতীকী প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে এ ধরনের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব ভবিষ্যতে নারীর জন্য ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, লক্ষ্যপূরণের আর মাত্র তিন বছর বাকি থাকলেও বর্তমানে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় স্তরে বা কমিটিতে নারীর এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব নেই। ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে মাত্র চারজন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন মাত্র একজন নারী। আওয়ামী লীগের ৪০ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে দুজন মাত্র নারী আছেন। ৭৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদে মাত্র ছয়জন নারী রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আটজনের মধ্যে একজনও নারী নেই। অন্যদিকে বিএনপিতে একই পদে ১০ জনের বিপরীতে নারী আছেন মাত্র দুজন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে চারজনের বিপরীতে নারী মাত্র একজন। কিন্তু বিএনপিতে একই পদে কোনো নারী সদস্য নেই (মোট সদস্য: আটজন)। ৭৮ সদস্য নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে নারী আছেন মাত্র ১৫ জন, যেখানে বিএনপিতে আছেন মাত্র ৬৫ জন (মোট সদস্য: ৫০২ জন)। ২০২০ সাল পূর্ণ হতে আর দুই বছর বাকি। এই অবস্থায় দলে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জানতে চেয়ে ইসির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। ৪০টি দলের মধ্যে ১০টি দল নারী নেতৃত্বের বিষয়ে বর্তমানে দলের কী অবস্থান, তা ইসিকে জানিয়েছে। দলগুলোর প্রদত্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে একটিমাত্র দল (গণফ্রন্ট) তাদের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি আনতে পেরেছে। প্রতিবেদন থেকে আরও দেখা যায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৮১ জনের মধ্যে ১৫ জন নারী; শতকরা হারে তা ১৮ শতাংশ। সংসদে দলের সরাসরি আসনে বিজয়ী ১৬ জন নারী রয়েছেন। বিএনপির সব স্তরের কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। আর জাতীয় পার্টির সব পর্যায়ের কমিটিতে নারী রয়েছেন ২০ শতাংশ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ মার্চ ২০১৮)। অনেকের মতে, দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী সহিংসতা এবং সংঘাতের দিকে হাঁটার কারণেই দলের কার্যক্রমে ও নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। প্রসঙ্গত, সরকার পরিচালনায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনো তা আশাব্যঞ্জক নয়। দশম সংসদে সর্বমোট ৫১ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন (৯ দশমিক ৮ শতাংশ) নারী মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে সংরক্ষণ-পদ্ধতি থাকলেও তা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মূল কারণ হলো পদ্ধতিটিই ত্রুটিপূর্ণ। এতে নারীর প্রতিনিধিত্ব মূলত প্রতীকী।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ
মূলত জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীরা ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান। এ ধরনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নারীদের জন্য সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে, যা মূলত আলংকারিক। তবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটে সংসদের সাধারণ আসনে নারীর প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে, যে ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও এখনো গর্ব করার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে নারী প্রার্থীর হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ-মোট ১ হাজার ৫৬৬ জনের মধ্যে মাত্র ৫৭ জন, জয়লাভ করেন মাত্র ১৯ জন। তবে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী নারী প্রার্থীর সংখ্যা কমে যায়। নির্বাচনে ২৭টি আসনে নারী প্রার্থী ছিলেন ২৮ জন (৩০০ আসনে মোট প্রার্থী ৫৪৩ জন)। জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী হিসেবে মাত্র ৬ (৩০০ জনের মধ্যে ১৮ জন) শতাংশ আসনে নারীদের বিজয়ী হওয়া রাজনীতিতে নারীর সম্মানজনক অবস্থানের প্রতিফলন নয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ
সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চার হাজার ইউপিতে মাত্র ২৯ জন নারী চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন। পক্ষান্তরে ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ২২৬ জন, জয়ী হন ২৩ জন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। এসডিসির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ ৪৮ শতাংশ কমেছে (প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০১৬)। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯০০; আর ২০১৪ সালের ৪৫৮টি উপজেলা নির্বাচনে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০৭ জনে। এই হিসাবে ২০০৯ সালে প্রতি উপজেলায় ৭ থেকে ৯ জন নারী প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৪ সালে এই হার গড়ে দাঁড়ায় ৩ থেকে ৪ জনে। একইভাবে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ নারী মেয়র পদে জয়লাভ করেন।
রাজনৈতিক দলে নারীর প্রতিনিধিত্ব
রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলে নারীরা দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। প্রসঙ্গত, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরে ২০২০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করার বিধান ২০০৯ সালে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ যুক্ত করা হয়, যাতে রাজনীতিতে নারীর দৃশ্যমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। আমরা মনে করি, প্রতীকী প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে এ ধরনের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব ভবিষ্যতে নারীর জন্য ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, লক্ষ্যপূরণের আর মাত্র তিন বছর বাকি থাকলেও বর্তমানে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় স্তরে বা কমিটিতে নারীর এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব নেই। ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে মাত্র চারজন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন মাত্র একজন নারী। আওয়ামী লীগের ৪০ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে দুজন মাত্র নারী আছেন। ৭৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদে মাত্র ছয়জন নারী রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আটজনের মধ্যে একজনও নারী নেই। অন্যদিকে বিএনপিতে একই পদে ১০ জনের বিপরীতে নারী আছেন মাত্র দুজন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে চারজনের বিপরীতে নারী মাত্র একজন। কিন্তু বিএনপিতে একই পদে কোনো নারী সদস্য নেই (মোট সদস্য: আটজন)। ৭৮ সদস্য নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে নারী আছেন মাত্র ১৫ জন, যেখানে বিএনপিতে আছেন মাত্র ৬৫ জন (মোট সদস্য: ৫০২ জন)। ২০২০ সাল পূর্ণ হতে আর দুই বছর বাকি। এই অবস্থায় দলে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জানতে চেয়ে ইসির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। ৪০টি দলের মধ্যে ১০টি দল নারী নেতৃত্বের বিষয়ে বর্তমানে দলের কী অবস্থান, তা ইসিকে জানিয়েছে। দলগুলোর প্রদত্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে একটিমাত্র দল (গণফ্রন্ট) তাদের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি আনতে পেরেছে। প্রতিবেদন থেকে আরও দেখা যায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৮১ জনের মধ্যে ১৫ জন নারী; শতকরা হারে তা ১৮ শতাংশ। সংসদে দলের সরাসরি আসনে বিজয়ী ১৬ জন নারী রয়েছেন। বিএনপির সব স্তরের কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। আর জাতীয় পার্টির সব পর্যায়ের কমিটিতে নারী রয়েছেন ২০ শতাংশ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ মার্চ ২০১৮)। অনেকের মতে, দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী সহিংসতা এবং সংঘাতের দিকে হাঁটার কারণেই দলের কার্যক্রমে ও নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। প্রসঙ্গত, সরকার পরিচালনায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনো তা আশাব্যঞ্জক নয়। দশম সংসদে সর্বমোট ৫১ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন (৯ দশমিক ৮ শতাংশ) নারী মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে সংরক্ষণ-পদ্ধতি থাকলেও তা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মূল কারণ হলো পদ্ধতিটিই ত্রুটিপূর্ণ। এতে নারীর প্রতিনিধিত্ব মূলত প্রতীকী।
তবে নারীর
রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংরক্ষণ-ব্যবস্থার মধ্যে উৎকৃষ্টতর
পদ্ধতি হতে পারে ঘূর্ণমান পদ্ধতি, যা ভারতের পঞ্চায়েত প্রথায় বিরাজমান। এই
পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব আসন থেকে পর্যায়ক্রমে একজন নারী
সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পান। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমাদের জাতীয়
সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে এবং এগুলো ঘূর্ণমান
পদ্ধতিতে পূরণের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে প্রথম টার্মে লটারি কিংবা অন্য কোনো
পদ্ধতিতে ১০০ আসন চিহ্নিত করে এগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। এসব
নির্ধারিত ১০০ আসনে শুধু নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্য ২০০ আসন
নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে। পরবর্তী
নির্বাচনে আগেরবারের ২০০ উন্মুক্ত আসনের মধ্য থেকে লটারি কিংবা অন্য কোনো
পদ্ধতিতে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। অন্য ২০০ আসন, যার মধ্যে
প্রথমবারের ১০০ সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত, নারী-পুরুষ উভয়ের
প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তৃতীয় টার্মে অবশিষ্ট
এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত হবে এবং অন্য ২০০ আসন উন্মুক্ত হয়ে যাবে। যত দিন
পর্যন্ত নারী পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে জিতে আসার মতো
অবস্থানে না আসবে, তত দিন এই সংরক্ষণ-পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে। ঘূর্ণমান
পদ্ধতি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। এই
পদ্ধতিতে নারীর জন্যও একই ধরনের নির্বাচনী এলাকা থাকে, যেগুলো থেকে তাঁরা
সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন; ফলে যোগ্য ও কর্মদক্ষ নারীরা তাঁদের নির্বাচনী
এলাকাকে গড়ে তোলার সুযোগ পান, যা পরবর্তী নির্বাচনে পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সক্ষমতা সৃষ্টি করে। তাই একসময়
নারীর সমপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সংসদে আসন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাই
ফুরিয়ে যায়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক
No comments