নতুন ‘আফগানিস্তান’ : যেখানে যুদ্ধ শেষ হবে না
আমলাতান্ত্রিক
দৃষ্টিকোণ থেকে সিরিয়া ‘সবার বিরুদ্ধে সবার’ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এ
ব্যাপারে সর্বশেষ প্রমাণ হলো- মার্কিন বিমান সম্প্রতি কোনো এক স্থানে ২০০
জন রুশ ‘ভাড়াটে সেনাকে’ হত্যা করেছে। এই সংবাদের কয়েক দিন আগে, ইসরাইল
সিরিয়া থেকে আসা একটি ইরানি ড্রোনকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে, এরপর ইরানি
লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালায় এবং এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের একটি এফ-১৬
যুদ্ধবিমান হারালো। এর মাত্র কয়েকদিন আগে তুরস্ক মার্কিনসমর্থিত সিরিয়ান
কুর্দিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু করে দেয়। সম্ভবত, এই লোকেরাই
রাশিয়ানদের বিমান হামলা চালাতে বলেছিল। সিরিয়া নিয়ে পর্যায়ক্রমিক আলোচনা
বর্তমানে যে বিশৃঙ্খল পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তাতে এর ফলাফল সম্পর্কে আগ
বাড়িয়ে কিছু বলা খুব কঠিন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য সমাধানে
পৌঁছা কখনো খুব সহজ হবে না। একটি দেশ একবার বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সঙ্ঘাতের
ঘটনাস্থলে পরিণত হলে প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এর সমাধান করা
সুস্পষ্টভাবে অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। আফগানিস্তানে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত
আগ্রাসন থেকে এ পর্যন্ত এটা একটা পরিপূর্ণ বা যথাযথ উদাহরণ হয়ে আছে। এমনকি
১১ সেপ্টেম্বরের আগে এবং আমেরিকার আগ্রাসনের আগেও বারনেট রোবিন যেমন যুক্তি
প্রদর্শন করে এর বিরোধিতা করেছিলেন, বাস্তবেও সেটাই ঘটেছে। বাইরের অনেক
অভিনেতা, খেলোয়াড় বা কুশীলবের সম্পৃক্ততায় আফগান যুদ্ধকে অমীমাংসিতপর্যায়ে
নিয়ে গেছে। ওই যুদ্ধ সত্যিকার অর্থে ৪০ বছর ধরে চলছে। দৃশ্যত, এই যুদ্ধের
কোনো পরিসমাপ্তি ঘটছে না। সিরিয়ার জন্যও হয়তো একই ধরনের ভাগ্য অপেক্ষা
করছে। শুরু থেকেই সিরীয় সঙ্ঘাতে একটি প্রক্সিযুদ্ধের ছাপ ছিল। আরবরা
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পদত্যাগ বা তাকে তার দায়িত্ব থেকে অপসারণ
চাচ্ছিল। আর এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাতে উৎসাহ দিয়ে আসছিল
যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক। অপর দিকে, বাশার তার মিত্র ইরান এবং
প্রক্সিমিলিশিয়া লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে আসছে। কিন্তু
একটি গৃহযুদ্ধকে বহিঃশক্তির পক্ষ থেকে উৎসাহিত দেয়া ও সমর্থন জানানোর জন্য
এটা একটি বড় পদক্ষেপ। সেখানে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে- সিরীয় বিমান
ক্ষেত্রের ওপর দিয়ে তুরস্ক, ইরান এবং ইসরাইলি বিমান উড্ডয়ন করছে। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মতো আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় তথা বিশ্ব শক্তিগুলো
সেখানে সরাসরি স্থল ও আকাশপথে সামরিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত
বিশ্ব শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে সিরিয়ায় যে ভূমিকা পালন করা হচ্ছে, তা বড় ধরনের
পদক্ষেপ।
যুক্তরাষ্ট্র আইএসএর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়। এ জন্য নিজেদের
সমর্থনে যারা স্থলযুদ্ধ করতে আগ্রহী, আমেরিকা বিমান হামলার মাধ্যমে তাদের
সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সিরিয়ান কুর্দিরা আমেরিকার অত্যাবশ্যকীয়
মিত্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভাড়া করেছে। রাশিয়া ইসলামিক
স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী নয়; তারা বরং বাশার আল
আসাদ সরকারকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং নিজেদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ গ্রহণ করছে। সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল
না। কিন্তু এখন তারা আবার সাবেক সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের মতো রাশিয়ার প্রভাব
প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। আসাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাশিয়া বিমান শক্তি নিয়ে
সিরিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়া সিরিয়া থেকে তাদের বিমানসেনাদের
প্রত্যাহার করে নিলেও সেখানে কিছু স্থলসৈন্য রেখে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা
উপলব্ধি করেছে। রাশিয়ার নিয়মিত সৈন্যদের ব্যবহার এড়িয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্ট
ভ্লাদিমির পুতিন ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের মতো কৌশলে সিরিয়ায়ও সুবিধা আদায়
করতে চান। তিনি সেখানে ইউনিফর্মবিহীন ‘লিটল গ্রিনম্যান’ নামে আখ্যায়িত
রাশিয়ানদের মোতায়েন করতে চাচ্ছে। তারা হয়তো মর্যাদাবিহীন নিয়মিত সৈন্য অথবা
বেসরকারি ঠিকাদার হতে পারেন। আমেরিকানদের কাছে অবশ্যই এ কৌশল অপরিচিত কিছু
নয়। তারা ইরাকে প্রাইভেট মিলিটারি কন্ট্রাক্টর ব্যবহারের ক্ষেত্রে পথ
প্রদর্শক। মার্কিন স্থলবাহিনীর উপস্থিতিকে অস্বীকার করতে চায়নি তারা তখন
সেখানে এবং তাদের লক্ষ্য ছিল ত্যাগ ছাড়াই স্থল বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা হ্রাস
করে সুবিধা আদায় করা। আমরা জানি না, সিরিয়ায় পুতিনের কতজন
কন্ট্রাক্টর-ভাড়াটে সৈন্য আছে, কিন্তু একবারের মার্কিন হামলায় ২০০ রুশ
সৈন্য নিহত হয়েছে বলে যে খবর পাওয়া গেছে, তা সঠিক হলে সেখানে পুতিনের
ভাড়াটে সৈন্য অনেক বেশি থাকতে পারে। ইরাকের কুর্দিরা দশকের পর দশক ধরে টিকে
থাকার কারণে সিরীয় কুর্দিরা অনুরূপ একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার
জন্য যে প্রয়াস চালাচ্ছে তা বন্ধ করার অভিপ্রায় থেকেই তুরস্ক সেখানে
হস্তক্ষেপ করেছে। আল আসাদের টিকে থাকা থেকে সামরিক ফায়দা হাসিল করার জন্যই
ইরান সিরিয়ার ওপর দিয়ে তাদের ড্রোন উড্ডয়ন করছে। তারা চায় আসাদের ভিত্তি
মজবুত হোক। কিন্তু ইসরাইল ইঙ্গিত দিয়েছে, ইরান যেটা প্রতিষ্ঠা করতে চায়,
সেটাকে তারা সহ্য করবে না। তারা সেখানে ইরানের উপস্থিতিও সহ্য করবে না বলে
আভাস দিয়েছে। সত্যিকার বিষয় হলো- প্রত্যেকেই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে কাজ
করছে। অবশ্য তাদের কেউ গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক ফলাফলকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা
করছে না। সিরিয়ার সুন্নিরা এই গৃহযুদ্ধে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসলামিক
স্টেট এখন কোনো ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে না। আসাদ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে জয়লাভ করে
টিকে যাচ্ছেন এবং ক্রমান্বয়ে আবার ভূখণ্ড দখল করে নিচ্ছেন। কুির্দদের
মর্যাদাসহ অবশিষ্ট বিষয়গুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুদ্ধ পরিস্থিতি
বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত এটাই দেখা যাচ্ছে। পুতিন দেখাতে চান, সিরীয়
যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছেন। এর অর্থ হলো- রুশ সৈন্যদের প্রত্যাহার করা হলেও
আল আসাদ যে অনিরাপদ নন, তা নিশ্চিত করতে চান পুতিন। সিরীয় কুর্দিরা কোথাও
যাচ্ছে না, কারণ, তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই কুর্দিদের যতদিন
পর্যন্ত পরাজিত করা যাবে না, ততদিন তুরস্কের সম্পৃক্ততা যে অব্যাহত থাকবে
তা নিশ্চিত। সিরিয়ায় ইরানের দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থ রয়েছে। আবার ইরানকে
প্রতিরোধ করার ব্যাপারে ইসরাইলের দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থ আছে। ইরান যতদিন
ইসরাইলের টিকে থাকার অধিকারকে অস্বীকার করবে, ততদিন ইসরাইলও ইরানকে প্রতিহত
করতে চাইবে। খুব সম্ভবত, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে যুদ্ধ বন্ধ করতে চায়। কিন্তু
সেটা খুব সহজ হবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের সমর্থনে বিমান হামলা
বন্ধ করার চেষ্টা করলে সেখানে হতাহতের সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যেতে পারে।
তত্ত্বগতভাবে, বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চূড়ান্তপর্যায়ে
আঞ্চলিক অভিনেতা বা খেলোয়াড়েরা এ ক্ষেত্রে পিছু হটতে এবং কিছু নতুন কৌশল
গ্রহণে সম্মত হতে পারে। কিন্তু আফগানিস্তানের উদাহরণ থেকে দেখা যায়, বাইরের
কুশীলবরা স্থানীয়দের পুনরায় অস্ত্র সজ্জিত করে যুদ্ধ আবার শুরু করে। এই
ঝুঁকির কারণে যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস করা কঠিন। সিরিয়ার জনগণের মর্মবেদনার
অবসান ঘটছে না।
লেখক : ব্লুমবার্গের একজন কলামিস্ট, সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক
‘ব্লুমবার্গ’ থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
লেখক : ব্লুমবার্গের একজন কলামিস্ট, সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক
‘ব্লুমবার্গ’ থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
No comments