বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুরবস্থা by বদরুদ্দীন উমর
যারা
শহরে বাস করেন, তারা একবার এক-আধ ঘণ্টার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে নিয়ে জেলা শহরের হাসপাতালগুলো একবার ঘুরে এলেই
তাদের বোঝার অসুবিধা হবে না, চিকিৎসার অভাবে, অবহেলিত চিকিৎসায় এবং প্রকৃত
চিকিৎসাসেবার অনুপস্থিতিতে গরিবদের অবস্থা কী রকম। এদিক দিয়ে গ্রামাঞ্চলের
অবস্থা যে আরও শোচনীয়। গ্রামাঞ্চলে কিছু চিকিৎসা কেন্দ্র ও সরকারি
হাসপাতাল আছে। কিন্তু হাসপাতাল থাকলেও সেখানে চিকিৎসা নেই, নার্স নেই,
ওষুধপত্র নেই। কিছু যন্ত্রপাতি পড়ে থাকলেও সেগুলোর কোনো ব্যবহার নেই।
গ্রামের হাসপাতালে নিযুক্ত ও বদলি হওয়া চিকিৎসকরা গ্রামে থেকে নিজেদের
দায়িত্ব পালন তো করেনই না, উপরন্তু তারা গ্রামে থাকেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকিৎসার অব্যবস্থার কথা বলে মাঝেমধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এর
প্রতিকারের জন্য তিনি নিজেকে বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা করেন। গতকাল ১১ মার্চ
তিনি বলেন, 'গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা
পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে
সরকার কাজ করছে। সে জন্য জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের কর্মস্থলে ডাক্তারদের
উপস্থিতি সরকার যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে চায়।' (সমকাল, ১২.৩.২০১৮) এ
ধরনের প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের সময় সকলেই দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি
দেওয়া এক কথা এবং তা কার্যকর করা অন্য কথা। সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেও
গত চার বছরে সে প্রতিশ্রুতির কী হলো? প্রতিশ্রুতি কি পালন করা হয়েছে? তিনি
বলেছেন, 'আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে পাঁচ হাজার নতুন
চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনের আগে আরও পাঁচ হাজার
চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সাড়ে চার হাজার নার্স নিয়োগের বিষয়টিও
প্রক্রিয়াধীন। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সরা উপজেলায় অবস্থান করে
জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন।' (ঐ) কীভাবে তারা এই কাজ করবেন? গত ৯
বছরে সরকারি ক্ষমতায় থেকে তারা চিকিৎসকদের গ্রামে যেতে বাধ্য করতে না
পারলেও এখন তারা কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করবেন? তিনি নিজেই এ প্রসঙ্গে
বলেছেন, 'মফস্বলে পদায়ন করা হলে কিছুদিন পরই তদবির করে তারা শহরে চলে
আসেন।' (ঐ) এতদিন এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর। তা ছাড়া তদবির করে
ডাক্তারদের শহরে চলে আসার কথা তিনি বলেছেন। এ তদবির কোথায় ও কাদের কাছে করা
হয়? এটা কি তার নিজের মন্ত্রণালয়েই হয় না? এই তদবির কি করা হয় অন্য কোনো
মন্ত্রণালয়ে? 'কর্মস্থলে থাকে না ৬০% চিকিৎসক, তদারকির দায়িত্ব কার' শীর্ষক
অন্য একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, 'অনেকে বদলি ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ে তদবির
করছেন। কয়েকজনের বদলির আদেশ এরই মধ্যে বাতিলও হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামীপন্থি
চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের কয়েকজন নেতা ঢাকার বাইরে বদলি
করা কয়েকজন চিকিৎসকের বদলির আদেশ বাতিল করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে
সাক্ষাৎ করেছেন বলে একটি সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছে। ওই নেতারা উৎকোচের
বিনিময়ে ড্যাব নেতাদের ঢাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ে লবিং-তদবির
করছেন বলেও জানা গেছে। এ অবস্থায় উপজেলায় চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করার
দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে,
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জনের সঙ্গে
সমঝোতার মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন চিকিৎসকরা।'
(ঐ) এখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জনের সঙ্গে
'সমঝোতার' অর্থ কী? অর্থ কি এই নয় যে, ঘুষ খেয়ে তারা এই 'সমঝোতায়' এসেছেন?
এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নতুন করে দশ হাজার চিকিৎসককে গ্রামে
পাঠিয়ে সেখানে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার যে কথা বলেছেন, তার
বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু? দুর্নীতি তার নিজের মন্ত্রণালয়েই রন্ধ্রে রন্ধ্রে
ছড়িয়ে আছে এবং এ দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি লোকদের, সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের
সম্পর্ক যে কী- এটা কি কাকেও বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে? বাংলাদেশের
স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে যখন এই অবস্থা, যখন চিকিৎসকদের চরম অমানবিক ও
স্বার্থপর চরিত্র, যখন উৎকটভাবে তাদের নানা কার্যকলাপের মাধ্যমে দেখা
যাচ্ছে, তখন কানাডার শত শত চিকিৎসকের মানবিক বোধের এক রিপোর্ট ৯ মার্চ ২০১৮
তারিখে লন্ডনের The Guardian পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেখানকার কুইবেক
প্রদেশের ৮০০ চিকিৎসক প্রাদেশিক সরকার তাদের যে বেতন বৃদ্ধি করেছে, তার
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এক বিবৃতি দিয়েছেন! তারা এই বৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান করে
বলেছেন, তারা যে বেতন পান, সেটা তাদের জন্য যথেষ্ট। কাজেই তাদেরকে দেওয়া
বর্ধিত বেতন প্রদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অন্য কর্মীদের মধ্যে নার্স এবং
অন্যদের দেওয়া দরকার। প্রাদেশিক সরকারকে দেওয়া এক খোলা চিঠিতে তারা বলেছেন-
'ÔWe, Quebec doctors, are asking that the salary increases granted to
physicians be cancelled and that the resources of the system be to
better distributed for the good of healthcare workersÕ.. এ ছাড়া
গার্ডিয়ানের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে-The letter says recent pay raises
negotiated by this professional associations as ÔshockingÕ, given the
Ôdraconian cutsÕ that have lift nurses, orderlies and others overworked
and underpaid, as well as led to a widespread lack of services for
patients.Õ কানাডীয় এই চিকিৎসকদের দ্বারা তাদের বেতন বৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান
করে যেভাবে কুইবেক প্রাদেশিক সরকারের কাছে সাধারণভাবে সেখানকার চিকিৎসা
ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, এটা যে তাদের উচ্চ মানবিক
বোধের, নৈতিক বোধের ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচয়- এ নিয়ে সন্দেহ থাকতে
পারে? এ ক্ষেত্রে বলা দরকার যে, সাধারণভাবে আমাদের দেশের সাধারণ চিকিৎসা
ব্যবস্থা তুলনায় কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থা বহুগুণে উন্নত। কিন্তু তা
সত্ত্বেও সেখানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে বৈষম্য আছে তার বিরুদ্ধেই উপরোক্ত ৮০০
জন চিকিৎসক তাদের প্রতিবাদ চিঠি প্রাদেশিক সরকারকে দিয়েছেন। এর সঙ্গে
তুলনায় আমাদের দেশের চিকিৎসকদের সাধারণ অবস্থা কী? তারা যেভাবে গরিব
রোগীদের গলায় ছুরি চালিয়ে নিজেদের ফি বৃদ্ধি করেন, হাসপাতালে নিজেদের
দায়িত্ব পালন করেন না, বিশেষত সরকারি বেতন নিয়মিত পাওয়া সত্ত্বেও গ্রামের
গরিবদের চিকিৎসা দানের জন্য কর্মস্থলে থাকার প্রয়োজনবোধ করেন না, একে কী
বলা যাবে? এর মধ্যে মনুষ্যত্বের সামান্য পরিচয়ও কি আছে? এই মনুষ্যত্বহীন ও
দায়িত্বহীন চিকিৎসকদের তাদের কাজ করতে, গ্রামাঞ্চলে নিজেদের কর্মস্থলে
থাকতে বাধ্য করার উপায় এখানেও আছে। কিন্তু সরকার তার ধারেকাছেও যায় না।
যারা নিজেদের কর্মস্থলে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকেন এবং যেখানে সরকারের
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অবগত থাকে, সেখানে তাদেরকে নিয়মিত বেতন দিয়ে
আসা হয় এবং তাদের জন্য কোনো তদারকি ও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের আজ
এটাই সর্বপ্রধান সংকট। এ দেশে সাধারণভাবে যেমন অপরাধের জন্য শাস্তি নেই,
তেমনি চিকিৎসকরা নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে চরম অমানবিকতা ও
দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেও তাদের কোনো শাস্তি নেই। ঘুষ-দুর্নীতি চালিয়ে,
সরকারি দলের খেদমত করে ও তাদেরকে সমর্থন জুগিয়ে এরা নিরাপদেই থাকে।
সমৃদ্ধশালী বুর্জোয়া রাষ্ট্রের শোষণ-নির্যাতন অনেক রকম থাকে। কিন্তু
বুর্জোয়া শ্রেণির একাংশের মধ্যে যে সভ্য আচরণ ও মানবিক বোধ আছে, এটা অনেক
ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এখানে মনে রাখা দরকার, কোনো সমাজের লোক হঠাৎ করে
ধন-সম্পত্তির মালিক হলে, সমাজে সুবিধাভোগী হিসেবে অনেক কিছু ভোগ করলেও তারা
নিজেরা এবং তাদের সহযোগী বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পীদের মধ্যে যে
বিকশিত মানবিক বোধ থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের
ধন-সম্পদশালী ও নানাভাবে সুবিধাবাদী সব ধরনের লোকেরা যে প্রকৃত অর্থে
বুর্জোয়া চরিত্র অর্জন করেছে, এটা বলার উপায় নেই। বাংলাদেশে আজ যে
শোষণ-নির্যাতন-নৈরাজ্য সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তার দিকে তাকালে অন্য মত
পোষণ করা কোনো সৎ লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
No comments