ট্রাম্প-উন সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে যত প্রশ্ন by আলী রীয়াজ
গত
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে উত্তর কোরিয়ার নেতারা যে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন,
বর্তমান নেতা কিম জং-উন তাতে সাফল্য লাভ করেছেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে
‘যুদ্ধে লিপ্ত’ যুক্তরাষ্ট্রের নেতাকে সরাসরি আলোচনায় রাজি করিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃশর্তে কিম জং-উনের সঙ্গে
মুখোমুখি আলোচনায় রাজি হওয়ার মতো যে ‘ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই নিজের সাফল্য দাবি করেন না কেন বা যতই বলেন না কেন
যে এক বছর ধরে তাঁর সরকারের চাপের কারণে বা তাঁর আক্রমণাত্মক অবস্থানের
জন্য তা সম্ভব হয়েছে, ইতিহাস তা সমর্থন করে না। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের
আমল থেকেই উত্তর কোরিয়া প্রস্তাব দিয়ে এসেছে দুই দেশের নেতাদের সরাসরি
মুখোমুখি বসার জন্য। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটিকে ‘অশুভ চক্রের’
অংশ বলে বর্ণনা করলেও ২০০৭ সালে তিনিও এক চিঠিতে উত্তর কোরিয়া যদি সব ধরনের
পরমাণু কর্মসূচি প্রকাশ করে এবং সব পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করে, তবে সম্পর্ক
স্বাভাবিকীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বারাক ওবামার সময়ও উত্তর কোরিয়া
আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। ক্লিনটন যদিও তাঁর শেষ সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মেডেলিন অলব্রাইটকে পিয়ংইয়ংয়ে পাঠিয়েছিলেন, ওবামা সেই পথে একেবারেই অগ্রসর
হননি। এটা অবশ্যই ইতিবাচক যে, যে দুই নেতা এই কিছুদিন আগেও শিশুসুলভ
বাগ্যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন এবং পরস্পরের ওপর পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়ে
আসছিলেন, সেখান থেকে তাঁরা সরে এসেছেন এবং কূটনৈতিকভাবে অবস্থার মোকাবিলা
করার চেষ্টা করছেন। যুদ্ধের আশঙ্কা তাতে আপাতত হ্রাস পেয়েছে এবং কিছু
অগ্রগতির সম্ভাবনা নিশ্চয় তৈরি হয়েছে।
দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় সম্মতি
দেওয়ার সময় ট্রাম্প এ দুই দশকের ইতিহাস বিবেচনায় নিয়েছিলেন বা এ ধরনের
আলোচনার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন, সে বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত
ছিলেন এবং কী লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই আলোচনা, তা অনুধাবন করতে
পেরেছিলেন-এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। কেননা, ট্রাম্প তাঁর টুইটে যেভাবে
মে মাসে এই আলোচনা হবে বলে ধারণা দিয়েছিলেন এবং ‘ডিল উইথ নর্থ কোরিয়া ইজ
ভেরি মাচ ইন দ্য মেকিং’ (উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি তৈরির পথে) বলে ঘোষণা
দিয়েছিলেন, সমালোচনার পর হোয়াইট হাউস সেখান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কিসের বিনিময়ে এই আলোচনায় সম্মত হয়েছে-এই প্রশ্নের উত্তরে
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র সারা স্যান্ডার্স যা বলেছেন, তা আন্তর্জাতিক
সম্পর্কের কোনো বিশেষজ্ঞকেই আশ্বস্ত করতে পারেনি। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের
সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন যে তিনি উত্তর কোরিয়ার
সঙ্গে আলোচনায় রাজি আছেন। ফলে তাঁর সম্মতি আসলে তাঁর অবস্থানের কোনো
পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না। রাজনৈতিক জুয়াখেলায় ট্রাম্প অভ্যস্ত; উত্তর
কোরিয়া নিয়ে তাঁর এই সিদ্ধান্ত সেই ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ফলে তিনি এ
ক্ষেত্রেও জুয়া খেলায় নেমেছেন বলে মনে হতে পারে। বিপরীতক্রমে এই সম্মতির
কারণ এ-ও হতে পারে যে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিকভাবে
আরও বেশি শক্তিশালী এবং যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানার মতো শক্তি তার আছে বলেই
প্রতীয়মান হয়। ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত এ কারণে উদ্বিগ্ন যে কিম জং-উন এ
ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তিনি কোনো বাধা পাবেন না। অন্য যেকোনো পরমাণু
অস্ত্রধারী দেশের নেতাদের ওপরে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে ধরনের
অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত নিয়ন্ত্রণ থাকে, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত।
উত্তর কোরিয়ার নেতারা কেন দুই দশক ধরে মুখোমুখি আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে
এসেছেন, সেটা সহজেই বোধগম্য। আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর
কোরিয়ার নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতার উপস্থিতি দেশটিকে
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেবে এবং তার কার্যকলাপের বৈধতা সৃষ্টি করবে। এখন
এ ধরনের বৈঠক পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে তার স্বীকৃতিও বটে। কিন্তু
যুক্তরাষ্ট্র তাতে আগে কখনো রাজি হয়নি, সে দাবি করে এসেছে উত্তর কোরিয়াকে
কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে এবং পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করার ব্যাপারে
আন্তর্জাতিকভাবে যাচাইযোগ্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০০৩ থেকে ২০১২
সাল পর্যন্ত দফায় দফায় অনুষ্ঠিত ছয় জাতি আলোচনা-যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর
কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, রাশিয়া ও জাপান-এ ধরনের প্রশ্নের সমাধান করতে
পারেনি বলেই সেই প্রচেষ্টা এখন কার্যত মৃত। ট্রাম্পের নিঃশর্ত সম্মতি এত
দিনের এই নীতি ও অবস্থানের বিপরীতে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞতা হেতু। অজ্ঞতার কথা
উঠছে, কারণ অতীতে অনেক বিষয়েই ট্রাম্প এমন ধরনের কথা বলেছেন, যাতে বোঝা
গেছে যে তাঁর নিজের প্রস্তুতি ছিল না। ট্রাম্প প্রশাসনও আলোচনার জন্য
প্রস্তুত কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। কেননা, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই
দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পদ শূন্য, কাজ চালাচ্ছেন চার্জ
দ্য অ্যাফেয়ার্স; তদুপরি উত্তর কোরিয়া বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
কর্মকর্তা জোসেফ ইউন, এক বছর ধরে নিউইয়র্কে উত্তর কোরিয়ার মিশনের মাধ্যমে
দুই দেশের মধ্যে যিনি নীরবে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন, গত মাসে পদত্যাগ
করেছেন। সাধারণত এ ধরনের শীর্ষ বৈঠকের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা পর্যায়ের আলোচনায়
খুঁটিনাটি সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তার আলোকেই দুই নেতা চুক্তি
করেন। বিরূপ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমেই অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে
যাওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আমলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের
সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক কাজ হয়েছিল দুটি দেশের মাধ্যমে-রোমানিয়া ও
পাকিস্তান। ২৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে নিক্সনের কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছিলেন চীনের
প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের মাধ্যমে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
চিঠিটি চীনের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পৌঁছে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত
আগা হিলালি ২ জুন ১৯৭১ সালে। এর অনেক আগে থেকেই পর্যায়ক্রমিকভাবে চীনের ওপর
আরোপিত অনেক ধরনের বাধানিষেধ শিথিল করা হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে
হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন সফরের মাধ্যমেই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার ভূমিকা প্রচলিত
কূটনৈতিক পদ্ধতির ইঙ্গিত দেয়, একই সঙ্গে এখন সুইডেনের অন্তর্ভুক্তি সম্ভবত এ
ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজনের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বীকৃতি। কিন্তু
পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি ও ঐকমত্য ছাড়া কেবল দ্রুত আয়োজিত শীর্ষ বৈঠকের ফল
ইতিবাচক হবে কি না, তা বলা মুশকিল। অনেকেই এ কথা বলতে পারেন যে উত্তর
কোরিয়া যে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে, তাতে লক্ষ্য হিসেবে ‘পরমাণু বিমুক্তি’ বা
‘ডি-নিউক্লিয়ারাইজেশন’-এর কথা বলা হয়েছে, ফলে আলোচনার ক্ষেত্রে
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে খানিকটা এগিয়ে আছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ‘পরমাণু
বিমুক্তি’ বলতে যা বোঝে, তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পার্থক্য
অনেক। ভাষাগতভাবে এখন ভিন্নভাবে বলা হচ্ছে, কিন্তু এই অবস্থান উত্তর কোরিয়া
আগেও জানিয়েছে। উত্তর কোরিয়া যা বলেছে তা হচ্ছে, তারা কোরীয় উপদ্বীপকে
পরমাণুমুক্ত করতে ‘আগ্রহী’, যদি তাদের জন্য উপস্থিত ‘হুমকি’ সরানো হয় এবং
তারা ‘নিরাপদ’ বোধ করে। উত্তর কোরিয়ার ভাষ্য হচ্ছে, এই হুমকি হচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার জোট, উপদ্বীপে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি এবং
জাপান ও কোরিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে পারমাণবিক সুরক্ষাব্যবস্থা
(নিউক্লিয়ার আমব্রেলা) তৈরি করেছে, সেগুলো। এগুলো সরিয়ে ফেলার পর, যখন
উত্তর কোরিয়া ‘নিরাপদ’ বোধ করবে, তখন তারা পরমাণু বিমুক্তির কথা ‘বিবেচনা’
করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানসহ এই
অঞ্চলের অন্য দেশগুলো এ ধরনের ব্যবস্থায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হবে
এবং তাতে করে এই অঞ্চলে চীনের যে সামরিক প্রভাব বাড়বে, তা তারা মানতে চাইবে
না। ফলে আপাতদৃষ্টে সম্ভাব্য এই শীর্ষ বৈঠক নিয়ে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে, তা
বাস্তবায়নের পথে বাধা অনেক। তদুপরি যদি ট্রাম্প-উন বৈঠক হয়ও, তবে কী হবে?
ঐকমত্যে পৌঁছানোর বদলে যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়, তবে কী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
ফিরে এসে বলবেন যে যেহেতু তিনি সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন, এখন একমাত্র পথ
হচ্ছে সামরিক অভিযান? এই সব বাধাবিঘ্ন ও আশঙ্কা সত্ত্বেও এই কূটনৈতিক
প্রচেষ্টা সফল হোক-সেই আশা করার আর কোনো বিকল্প নেই।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
No comments