সিকে ক্ষমতায় রাখায় চীনের আসল হিসাব
চীনের
নেতা সি চিন পিং আবারও বিশ্ব শিরোনাম হয়েছেন, তবে অন্য কারণে। মাও সে
তুংয়ের মৃত্যুর পর চীনে যখন এক ব্যক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ দুই
মেয়াদে সীমাবদ্ধ করা হয়, তখন বিশ্বের খুব কম প্রচারমাধ্যমেই তা উল্লেখিত
হয়। এমনকি চীনের বর্তমান সংবিধানের পূর্ববর্তী চারটি সংশোধনীর সময়ও
বিশ্বজুড়ে আগ্রহ দেখা গেছে সামান্যই। কিন্তু এবার, সর্বশেষ সংশোধনীর ১৪ বছর
পর, যখন নতুন একটা সংশোধনী এল, তখন বিশ্বের এমন কোনো রাজনৈতিক
প্রচারমাধ্যম নেই, যাতে এটা বড় আকারের সংবাদ হিসেবে আভির্ভূত হয়নি। এর
কারণটি সবার জানা। বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি না হলেও বিশ্বজুড়ে
প্রচারমাধ্যমের মূল মনোযোগ এখন চীনকে ঘিরেই। রোববার চীনের ১৩তম ন্যাশনাল
পিপলস কংগ্রেস কেবল (যেকোনো ব্যক্তির জন্য) প্রেসিডেন্ট পদের দুই মেয়াদের
সীমাই উঠিয়ে দিয়েছে তা নয়, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়েছে। আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘চিন্তাধারা’র
উল্লেখ থাকবে সংবিধানে। তবে বলা বাহুল্য, প্রথম সিদ্ধান্তটি নিয়েই
আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে বেশি। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটা তাৎপর্যবহ।
কিন্তু কী সেই তাৎপর্য? আংকেল সি ২০১৩ থেকে প্রেসিডেন্ট আছেন। অর্থাৎ
বর্তমান পদে ইতিমধ্যে তাঁর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং আরও পাঁচ বছরের
জন্য ইতিমধ্যে তিনি নির্বাচিত হয়ে আছেন।
কিন্তু চীন চিন্তা করছে
২০২৩–পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে। কারণ, ২০২১-এ দেশটির শাসক দল কমিউনিস্ট
পার্টি অব চীন (সিপিসি) তার প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্ণ করবে। ২০২৪ সালে দলটি
চীনে তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবের ৭৫ বছর উদ্যাপন করবে। আর সিপিসির
আগামী কংগ্রেস হলো ২০তম। চীন এসব উপলক্ষ উদ্যাপন করতে চায় বৈশ্বিক পরিসরে
নেতৃত্বের আসনে নিজেকে অভিষিক্ত করার মধ্য দিয়ে। চীনের নেতৃত্ব মনে করছে,
২০২০ থেকে পরবর্তী এক দশকে তারা বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যে সিদ্ধান্তসূচকভাবে
পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে। বিশেষ করে তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ’ এবং তাতে
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের আগ্রহভরে অংশগ্রহণ বিশ্বের অর্থনৈতিক ভারসাম্য
পাল্টে দিতে চলেছে। আর এ সময় অভ্যন্তরীণভাবে নেতৃত্ব পর্যায়ে তারা নতুন
কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা-অনিশ্চয়তায় পড়তে চায় না। আংকেল সির ক্ষমতায় থাকার
পক্ষে সিপিসিতে ঐকমত্যের ব্যাপকতা মূলত উপরোক্ত জাতীয়তাবাদী উচ্চাশা থেকেই।
যে কারণে প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদসংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবের পক্ষে ২
হাজার ৯৬০ ভোটের বিপরীতে ভোট পড়েছে মাত্র দুটি। এটাকে ‘হাততোলা
গণতন্ত্র’-এর সমার্থক হিসেবে গণ্য করা হলে হয়তো বাস্তব সত্যের পুরোটার
সন্ধান পাওয়া যাবে না। সিপিসি মনে করছে, মাও–পরবর্তী চীনে ১৯৮২ সালে যেসব
কারণে প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদকে একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে দুদফায় সীমিত করা
হয়েছিল, সেই বাস্তবতা থেকে দেশটি নতুন এক বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। চীন নতুন
সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে তার পুরো মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে চায়
সীমান্তের বাইরে—বহির্বিশ্বে। যেহেতু সি চিন পিং বর্তমানে দ্বিতীয় দফা
প্রেসিডেন্ট পদে আছেন, ফলে বর্তমান সংশোধনী না আনা হলে ২০২৩-এ দেশটিকে নতুন
এক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে হতো এবং এর ফলে একদিকে যেমন
পার্টি-রাজনীতিতে অনিশ্চিত প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে, তেমনি সম্পূর্ণ নতুন
একজন নেতাকে ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে চীনকে বিশ্ব পরিসরে
নেতৃত্ব দিতে হতে পারে। যার ফলাফল হতে পারে অনিশ্চয়তাময়। সিপিসি ২০২০ থেকে
২০৩০ সাল পর্যন্ত চীনকে নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা দেখাতে অনিচ্ছুক। এ ছাড়া চীনের
ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা স্বীকার করবেন যে প্রেসিডেন্ট
পদের মেয়াদ সীমিত করা না–করার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হলো সিপিসির সাধারণ
সম্পাদক হিসেবে কে থাকছেন এবং দেশটির সশস্ত্র বাহিনীসংক্রান্ত কমিশনের
চেয়ারম্যান পদটি কার হাতে থাকছে।
সাধারণত, পার্টিই সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর
ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে। উপরন্তু, পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও মিলিটারি
কমিশনের চেয়ারম্যান পদাধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে এখনো কোনো মেয়াদি ব্যাপার
নেই। ফলে সর্বশেষ সংস্কার না করলেও আংকেল সি সাধারণ সম্পাদক পদে (বা
উভয়পদে) পরবর্তী দফায় থাকতে পারতেন এবং দেশটিতে ক্ষমতার লাগাম তখনো তাঁর
হাতেই থাকত। যেমনটি ঘটেছিল দেং জিয়াও পিংয়ের আমলে। প্রেসিডেন্ট না থেকেও
দেং কার্যত তখন দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। চীন সম্পর্কিত তাবৎ বিশ্ব
ভাষ্যকার এ বিষয়ে একমত যে মাও সে তুং এবং দেং জিয়াং পিংয়ের মতো
মর্যাদাপূর্ণ তৃতীয় নেতা হিসেবে সি চীনজুড়ে ইতিমধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন।
এটা ঘটেছে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিকাশ এবং বৈশ্বিক পরিসরে
ক্ষমতা-ভারসাম্যে চীন যে রূপান্তর প্রক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, তার কারণে। ফলে
সর্বশেষ সংশোধনীর মধ্যে সি প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা
করছেন—এরূপ ভাবার চেয়েও যৌক্তিক হলো এটা অনুমান করা যে সিপিসি প্রেসিডেন্ট
পদে সিকে পরবর্তী দশকেও রাখার মধ্যদিয়ে চীন বিশ্বজুড়ে দেশটির সর্বোচ্চ পদের
প্রতীকী স্থিতিশীলতা দেখাতে চাইছে। সিপিসির ধারণা, আসন্ন দশকে বিশ্বজুড়ে
তারা শক্তির ভারসাম্যে যে পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে এবং এর ফলে যেসব সম্ভাব্য
সংঘাতপূর্ণ অবস্থা তৈরি হবে, তাতে সির মতো একজনকে সামনে রাখা চীনের জন্য
জরুরি। বলা বাহুল্য, সিপিসির এই ইচ্ছা পাশ্চাত্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
রোববার পিপলস কংগ্রেসের নতুন সিদ্ধান্তের পর থেকেই ইউরোপ-আমেরিকার
প্রচারমাধ্যমে ‘চীনে স্বৈরতন্ত্র’ উত্থানের উদ্বেগে সোচ্চার। সিকে
‘বাদশাহ’, ‘স্বৈরশাসক’, ‘ক্ষমতালিপ্সু’ ইত্যাদি অভিহিত করে এসব
প্রচারমাধ্যমে শত শত কলাম লেখা হচ্ছে এবং তা থেকে একটা বার্তাই পাওয়া
যাচ্ছে যে এক ব্যক্তির তিনটি পদে থাকা (প্রেসিডেন্ট, সামরিক বাহিনীর
চেয়ারম্যান এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদক) এবং তার মধ্যে একটি পদে কোনো
সময়সীমা না থাকাটা পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক মানসের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন
হয়ে দাঁড়িয়েছে!
তবে পশ্চিমের এই উদ্বেগ চীনে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের
জন্য কতটা—আর কতটাইবা দেশটিকে অস্থিতিশীল বা দুর্বল দেখার আশায়, তা নিয়ে
বিতর্ক থাকছেই। কারণ, চীনে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের যে অধিবেশনে
প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদসংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়, সেই একই
অধিবেশনে দেশটির একমাত্র পার্টি এবং পার্টি প্রভাবিত প্রশাসনে দুর্নীতি
রুখতে এমন এক কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যার গণতান্ত্রিক প্রভাব হতে পারে
সুদূরপ্রসারী। এটি মূলত সিরই প্রস্তাব যে চীনে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল
পর্যন্ত এমন একটি উপদেষ্টা/তদারকি কমিশন থাকা উচিত, যারা পার্টি ও
প্রশাসনের সব কর্মকাণ্ড ও কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়ে নজরদারি করবে এবং এই
কমিশন হবে তার কার্যক্রমের জন্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোরই
অংশ। বস্তুত, পাশ্চাত্যজুড়ে চীনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে উদ্বেগ দেখা
গেলেও চীনের অভ্যন্তরে উদ্বেগের বিষয় হলো দুর্নীতি। এই বাস্তবতা থেকেই
এসেছে সিপিসির দুর্নীতিবিরোধী ‘সুপারভাইজরি কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব। খসড়া
কাঠামো ও অধিকার অনুযায়ী কোনো সরকারি পদাধিকারীই এই কমিশনের আওতার বাইরে
থাকবে না। চীনে দুর্নীতি রুখতে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের বর্তমান অধিবেশনের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব সম্ভবত এটাই। যদিও তা আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের একদম মনোযোগ পায়নি। তবে এই কমিশনকেও সি তাঁর অভ্যন্তরীণ
ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার কাজে ব্যবহার করতে পারেন যেকোনো প্রতিপক্ষের
বিরুদ্ধে তাঁকে লেলিয়ে দিয়ে। যদিও আপাত সির সামনে সে রকম কোনো প্রতিপক্ষ
নেই, যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।
No comments