এশিয়ার দেশে দেশে মুসলিমদের ওপর বৌদ্ধদের নৃশংসতা
পশ্চিমাদের
কাছে শান্তিপূর্ণ মতবাদ হিসেবে বৌদ্ধবাদকে তুলে ধরা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে
এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে উগ্র বৌদ্ধদের সহিংসতা। কিছু বৌদ্ধ
ভিক্ষুর নেতৃত্বে এই গ্রুপগুলো ছোট হলেও দ্রুতই বাড়ছে তাদের প্রভাব। গত
সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদের মুসলিমবিরোধী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত
তিনজন। ধ্বংস করা হয়েছে মুসলিমদের মালিকানাধীন দুই শতাধিক বাড়ি ও
প্রতিষ্ঠান। ভাঙচুর করা হয়েছে অনেক মসজিদে, যা সম্প্রতিক সময়ের বৌদ্ধ
জাতীয়তাবাদীদের সর্বশেষ সহিংসতার নজির। মিয়ানমারে কুখ্যাত ভিক্ষু উইরাথুর
নেতৃত্বে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর সহিংসতা হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায়
ওই অঞ্চলে সেনা অভিযানে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে। নিহত
হয়েছে কয়েক হাজার। প্রায় একই সময়ে থাইল্যান্ডে এক শীর্ষস্থানীয় ভিক্ষু তার
অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছে মসজিদগুলো পুড়িয়ে দিতে। ধর্মীয় নেতাদের এমন
উসকানির পর সহিংসতা হওয়াটিই কি স্বাভাবিক নয়? যুক্তরাষ্ট্রের ইয়াংসটাউন
স্টেট ইউনিভার্সিটির ধর্মবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল জেরিসন জানান, বৌদ্ধরা
অনেকে তাদের সহিংসতার জন্য ধর্মকে কাজে লাগায়। বৌদ্ধ মতবাদ ও সহিংসতাবিষয়ক
একটি বইয়ের এই লেখক বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড- সর্বত্রই একই
চিত্র। মূলত (এর ফলে) বৌদ্ধবাদই হুমকির মুখে আছে।’ এই গবেষক বলেন,
‘প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাস, কারণ ও উসকানিদাতা রয়েছে। তবে এই
উসকানিদাতারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত।’ শত বছরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের
পরও বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা ইসলামকে আক্রমণাত্মক হিসেবে দাবি করে। তারা মালয়েশিয়া
ও ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের পতনের জন্যও মুসলিমদের দায়ী করে। তারা
এমনও দাবি করেছে যে, আধুনিক বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে মিলিশিয়া কার্যক্রম ও উচ্চ
জন্মহারের কারণে মুসলিমরা এই রাষ্ট্রগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মিয়ানমারের ভিক্ষু উইরাথু ব্যক্তিগতভাবে ও ফেসবুকে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা
চালাতেন ব্যাপকভাবে। গত জানুয়ারিতে তার ফেসবুক পেজটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
মিয়ানমারের জনসংখ্যার চার শতাংশেরও কম মুসলিম। উইরাথু তার ভক্তদের বলতেন,
হাজার বছর ধরেই মুসলিমরা বৌদ্ধ মতবাদকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। তার মা বা
থা গ্রুপ কঠোরভাবে আন্তঃধর্ম বিয়ে ও ধর্মান্তরিত হওয়ার বিরুদ্ধে কাজ করত।
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদের মিলিশিয়া তৎপরতা মূলধারায় চলে এসেছে, তারা অনেকবারই
দাঙ্গা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করেছে।
২৬ বছরের নৃশংস গৃহযুদ্ধের সময় দ্বীপদেশটির উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হিংসাত্মক
প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল দেশটির তামিল হিন্দুরা।
কিন্তু ২০০৯
সালে তামিল টাইগারদের পরাজয়ের পর এই সহিংসতাবাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে
লেগেছে। দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মুসলিম। এসব কর্মকাণ্ডের নেতাদের
একজন ভিক্ষু গালাগোদাত্তে গানাসারা কুরআন অবমাননা ও হিংসাত্মক বক্তৃতার
অভিযোগের মামলায় বর্তামনে জামিনে আছে। কিছু দিন আগে সরকারকে উদ্দেশ করে
তিনি বলেছিলেন, ‘এই দেশে কুরআন নিষিদ্ধ করা উচিত। যদি আপনারা না করেন, আমরা
এটি নিষিদ্ধ করার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণা চালাব।’ বিবিএস বা
বৌদ্ধবাহিনী নামে তার সংস্থাটির আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কায় এসেছিল
মিয়ানমারের কুখ্যাত ভিক্ষু ও মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গার মূল হোতা উইরাথু।
এশিয়ার দেশগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম মুসলিমবিরোধী সহিংসতা হয়েছে থাইল্যান্ডে।
দেশটির কলামিস্ট সানিতসুদা একচাই মনে করেন, বছরের পর বছরের দুর্নীতির কারণে
থাইল্যান্ডের সাধারণ মানুষের ওপর ভিক্ষুদের প্রভাব অনেক কমে গেছে। তিনি
বলেন, ‘মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় এখানকার ভিক্ষুদের সাথে সরকার ও
সাধারণ মানুষের সম্পর্ক অনেক কম।’ তবে তারপরও দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে মালয়
মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বেশ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গত দশকে এই
অঞ্চলে এক নৃশংস বিদ্রোহে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।
এই নিহতদের বেশির ভাগই মুসলিম। তবে কিছু ক্ষেত্রে মিলিশিয়াদের টার্গেট
হয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও। থাইল্যান্ডে মাহা এপিচাদ নামের এক সাবেক ভিক্ষু
ফেসবুকে তার অনুসারীদের অনুরোধ জানাতেন মসজিদে আগুন দিতে। তিনি বলতেন,
প্রত্যেক ভিক্ষুর জন্য তোমরা একটি করে মসজিদে আগুন দেবে। কিছু দিন পর অবশ্য
সেই ভিক্ষু পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৌদ্ধবাদীরা
নিজেরা সরাসরি জড়িত না থেকেও সহিংসতা ছড়াতে পারে। নরওয়েজিয়ান স্কুল অব
থিয়োলজির ইসেলিন ফেরিদেনলুন্দ বলেন, ‘খুব বিরল ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ
ক্ষেত্রেই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সরাসরি সহিংসতা থেকে নিজেদের দূরে রাখে; কিন্তু
তারা অন্যদের করা সহিংসতাকে বৈধতা দেয় এবং এর পক্ষে সাফাই গায়।
সূত্র : ইকোনমিক টাইমস।
সূত্র : ইকোনমিক টাইমস।
No comments