খালেদা জিয়ার জামিন, অন্য মামলায় গ্রেপ্তার
হাইকোর্ট
থেকে জামিন পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কারাগারে যাওয়ার
৩৩ দিনের মাথায় জামিন পেলেন তিনি। বিচারিক আদালত থেকে আসা জিয়া অরফানেজ
ট্রাস্ট মামলার নথি দেখে গতকাল খালেদা জিয়াকে ৪ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন
জামিন দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে
গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। এই সময়ের মধ্যে আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত
করতে হবে। পেপার বুক প্রস্তুত হয়ে গেলে যেকোনো পক্ষ শুনানির জন্য আপিল
উপস্থাপন করতে পারবে।
এদিকে নাশকতার অভিযোগে কুমিল্লায় দায়েরকৃত একটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখাতে সরকারের আবেদনটি মঞ্জুর করেছে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। সেই সঙ্গে আগামী ২৮শে মার্চ খালেদা জিয়াকে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করার আদেশও দিয়েছেন আদালত। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর বিকাল পাঁচটায় কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এ আদেশ দিয়েছেন। এ মামলায় আমরা আগামীকাল মুভ করবো।
ওদিকে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা, কম সাজা, এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের আগে খালেদা জিয়ার জামিনে থাকা এবং জামিনের অপব্যবহার না করাসহ ৪টি যুক্তিতে খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর করেছেন। এর আগে রোববার খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য ছিল। তবে, ওইদিন বিচারিক আদালতের নথি হাইকোর্টে বিলম্বে আসায় জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য সোমবার দুপুর ২টায় সময় নির্ধারণ করেন হাইকোর্ট। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে গত ৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। রায়ের পরপরই খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি শেষে এক আদেশে বিচারিক আদালতের নথি পাওয়া সাপেক্ষে জামিন প্রশ্নে আদেশ দেয়া হবে বলে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের জানান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচারিক আদালতের নথি রোববার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে হাইকোর্টে এসে পৌঁছে। আদালতের ডেসপাচ শাখার কর্মকর্তারা নথি গ্রহণ করে তা হাইকোর্টের ফৌজদারি আপিল শাখায় পাঠিয়ে দেন। গতকাল আদেশের সময় এই নথি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এর আগে ২০শে ফেব্রুয়ারি সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদার আইনজীবীরা। পরে ২২শে ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের এই বেঞ্চ আপিল গ্রহণ করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বিচারিক আদালতের দেয়া অর্থদণ্ডের আদেশ স্থগিত করেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের শুনানির দিন (২৫শে ফেব্রুয়ারি) ধার্য করে হাইকোর্ট এ মামলার বিচারিক আদালতের নথি তলব করেন যা ১৫ দিনের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয় আদেশে।
গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় সংশ্লিষ্ট আদালতের এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিম। এর আগেই আদালতের এজলাস কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। উভয়পক্ষের আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আদেশ শোনার জন্য এজলাসে অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেকে এজলাস কক্ষে প্রবেশ করতে না পেরে বাইরে অবস্থান নেন। শুনানির শুরুতে আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের কাছে জানতে চান তাদের কোনো সাবমিশন আছে কি-না? জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের কোনো সাবমিশন নেই। জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য ধার্য আছে। এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের কোনো বক্তব্য আছে কি-না তা জানতে চান। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, এটি একটি সেনসেশনাল কেইস। আর টাকা যে উত্তোলন করা হয়েছে এর স্বপক্ষে বেস্ট ডকুমেন্ট রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা (খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা) যে জামিনের দরখাস্ত দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে তিনি (খালেদা জিয়া) অসুস্থ। কিন্তু আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলেছেন যে, তিনি সুস্থ। আদালতের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, আপিল শুনানির জন্য একটি দিন ধার্য করে দিতে পারেন এবং পেপারবুক তৈরি করার আদেশ দিতে পারেন। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, এখানে তো উনি (খালেদা জিয়া) প্রিন্সিপাল একিউজড (প্রধান আসামি)। আর সবকিছু কনসিডার করেই তো তাকে ৫ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন বলেন, উচ্চ আদালতের প্রথা আছে এ ধরনের শর্ট সেন্টেন্সের (কম সাজা) ক্ষেত্রে জামিন দেয়ার। এসময় তিনি উচ্চ আদালতের দুটি মামলার নজির উল্লেখ করে বলেন, সেখানে সাত বছরের সাজার ক্ষেত্রে আদালত জামিন দিয়েছিলেন। শুনানিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কারাবাস এবং জামিনের বিষয়টি উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ ধরনের একটি মামলায় এরশাদ সাড়ে ৩ বছর পর জামিন পেয়েছিলেন। উনিতো (খালেদা জিয়া) মাত্র ২ মাস কারাগারে আছেন। এ পর্যায়ে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন, সাড়ে ৩ বছর সাজার বিষয়ে আপনি যার কথা বলছেন উনার বয়স তখন কত ছিল? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ৬৫ বছর। এসময় আদালত বলেন, ওই সময় উনি শুধু ফিজিক্যালিই ফিট ছিলেন না, জেল থেকে বেরিয়ে বিয়েও করেছিলেন। সন্তানের বাবাও হয়েছিলেন। শুনানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, এই মামলায় দুইবারে মিলিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) আড়াই মাসের বেশি সাজা ভোগ করেননি। তিনি এই মামলার মূল আসামি। কিন্তু ওনার বয়স, শারীরিক অসুস্থতা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করেই বিচারিক আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। দুদক আইনজীবী আরো বলেন, সাজার পরিমাণ কম এটি জামিন পাওয়ার গ্রাউন্ড হতে পারে না। এসময় আদালত খুরশিদ আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার কথা অনুযায়ী মূল আসামিকে ৫ বছর আর অ্যাবেটরদের (সহযোগী আসামি) ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আপনারা কি সেটিসফাইড নন? জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, আমরা সেটিসফাইড নই। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জামিন বিষয়ে আদেশ দু’দিনের জন্য স্থগিত রাখার আবেদন জানান। তবে, আদালত সেটি বিবেচনায় নেননি। একপর্যায়ে আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা যে অসুস্থতার কথা বললেন সবই তো দীর্ঘ মেয়াদি। জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ওল্ড এইজে এরকম হয়। এরপরই হাইকোর্ট এক আদেশে ৪টি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে জামিন দেন। আদালত আদেশে উল্লেখ করেন, বিচারিক আদালত পাঁচ বছরের যে সাজা দিয়েছে তা তুলনামূলকভাবে কম। বিচারিক আদালতের নথি হাইকোর্টে এসেছে, কিন্তু আপিল শুনানির জন্য এখনো প্রস্তুত হয়নি। বিচারিক আদালতে মামলা চলাকালে খালেদা জিয়া জামিনে থেকে মামলা মোকাবিলা করেছেন এবং এর অপব্যবহার না করে আদালতে তিনি নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। বয়স এবং বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে জামিন দেয়া যায়। এসব যুক্তিতে হাইকোর্ট খালেদা জিয়াকে ৪ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন। এই সময়ের মধ্যে পেপারবুক প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট আদেশে বলেন, পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে গেলে যেকোনো পক্ষ শুনানির জন্য আপিল উপস্থাপন করতে পারবে। আদালতের আদেশের পরপরই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদেরও উল্লাস করতে দেখা যায়। এ সময় নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে আরো উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, আব্দুর রেজাক খান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, কায়সার কামাল, জাকির হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আদালতে উপস্থিত ছিলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মঈন খান, মির্জা আব্বাস, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু প্রমুখ।
আমরা আনন্দিত: মওদুদ
খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের প্রতিক্রয়ায় তার আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা আজ আনন্দিত। এই যে একমাস তিনি (খালেদা জিয়া) তিনি কষ্ট করেছেন, সেজন্য আমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, এটাই আমাদের কাছে সবচে বড় বিষয়। তিনি বলেন, যদি কোন সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি মহিলা হন, অসুস্থ হন তাহলে আদালত তাকে মুক্তি দিতে পারেন এটি আইনের বলা আছে। হাইকোর্টের আদেশের পর খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে আইনগত কোন বাধা আছে কি না- এমন প্রশ্নে মওদুদ আহমদ বলেন, কোনরকম আইনগত বাধা নেই এবং শিগগির তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। এদিকে জামিন আদেশের প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, অন্য কোন মামলায় গ্রেপ্তার না দেখালে খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে কোন বাধা নেই। এদিকে বিকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনে আমরা আংশিক খুশি। তবে যখন তিনি জেল গেট থেকে বের হয়ে তাঁর বাড়ি ফিরে আসবেন তখন পুরোপুরি খুশি হবো।
আমরা আপিল করবো: অ্যাটর্নি জেনারেল
খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের প্রতিক্রয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স এবং এই মামলার রায়ের আগে তিনি জামিনে ছিলেন এসব বিবেচনায় আদালত তাকে জামিন দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করবো। ইতিমধ্যে আপিল তৈরি করা শুরু করে দিয়েছি। আগামীকালই (আজ) এই জামিনের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে লিভ পিটিশন দায়ের করবো। খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া সরকারের রাজনৈতিক পরাজয় কি না- এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, অবশ্যই না। একজন আসামি জামিন পাবে কি পাবে না, সেটি আদালতের বিবেচ্য বিষয়। আইনজীবীদের প্রার্থনার বিষয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক কি থাকবে? আর যদি কেউ এখানে রাজনৈতিক সম্পর্ক জড়াতে চায় তাহলে আমার বিবেচনায় সেটি তো খারাপ দিকে যাওয়ার কথা। এদিকে খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের প্রতিক্রিয়ায় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন করা হবে।
কুমিল্লার আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজির করার নির্দেশ
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর এলাকায় যাত্রীবাহী নৈশকোচে দুর্বৃত্তদের পেট্রোল বোমা হামলায় ৮ যাত্রী হত্যা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে আগামী ২৮শে মার্চ কুমিল্লার আদালতে হাজির করার জন্য প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট (পি.ডব্লিউ) ইস্যু করেছে আদালত। ঢাকার গুলশান থানার একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে কুমিল্লার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৫নং আমলি আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক মুস্তাইন বিল্লাহ সোমবার বিকালে এ আদেশ দেন। ওই আদেশটি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুমিল্লার ৫নং আমলী আদালতে চলমান জি.আর ৫১/১৫ মামলায় যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছিল তা ইতোপূর্বে ঢাকার গুলশান থানায় প্রেরণ করা হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য সোমবার গুলশান থানার ওসি এ.বি সিদ্দিক স্বাক্ষরিত একটি আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে কুমিল্লার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৫নং আমলি আদালতের বিচারক মুস্তাইন বিল্লাহ আগামী ২৮শে মার্চ কুমিল্লার আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজির করার জন্য প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট (পি.ডব্লিউ) ইস্যুর আদেশ দেন। বিকালে আদালতের আদেশটি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আদালতের ওই আদেশের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন কোর্ট ইন্সপেক্টর সুব্রত ব্যানার্জি।
জানা যায়, বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধ চলাকালে ২০১৫ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আইকন পরিবহনের একটি নৈশ কোচ (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪০৮০) চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর নামক স্থানে পৌঁছুলে দুর্বৃত্তরা বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। এতে বাসের যাত্রীরা কোন কিছু বুঝে উঠার আগে আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন ও হাসপাতালে নেয়ার পর ১ জনসহ মোট ৮ ঘুমন্ত যাত্রী মারা যায়। এ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে পরদিন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে থানায় পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের নির্দেশে ৮ যাত্রী হত্যা মামলাটি কুমিল্লা ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে খালেদা জিয়া, বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী, মনিরুল হক চৌধুরী, জামায়াত নেতা ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরসহ ৭৭ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৬ই নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ ২টি মামলার চার্জশিটে এজাহার বহির্ভূত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক এমপি মনিরুল হক চৌধুরীসহ স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের আরও ৩০ জন নেতা-কর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত ২রা জানুয়ারি আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে মামলার আসামি পলাতক ৫৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি গভীর রাতে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদরের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হায়দারপুল এলাকায় একটি কার্ভাডভ্যানে আগুন দেয়ার ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায়ও বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে এবং স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের ৩২ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গত বছরের ৬ই মার্চ কুমিল্লার একই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ মামলায় চার্জশিটের ৩২নং আসামি বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে কুমিল্লার আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি মামলা রয়েছে।
এসব মামলা প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুস সা’দাত জানান, ৮ যাত্রী হত্যা মামলায় আদালত সোমবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পি.ডব্লিউ (হাজিরা পরোয়ানা) ইস্যু করেছেন। অপর ২টি মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত ছিল, কিন্তু পরে এ আদেশটি রহিত (ব্র্যাকেট) হলেও সংশ্লিষ্ট আদালতে ওই আদেশের কপি এখনো পৌঁছায়নি।
এদিকে নাশকতার অভিযোগে কুমিল্লায় দায়েরকৃত একটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখাতে সরকারের আবেদনটি মঞ্জুর করেছে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। সেই সঙ্গে আগামী ২৮শে মার্চ খালেদা জিয়াকে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করার আদেশও দিয়েছেন আদালত। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর বিকাল পাঁচটায় কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এ আদেশ দিয়েছেন। এ মামলায় আমরা আগামীকাল মুভ করবো।
ওদিকে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা, কম সাজা, এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের আগে খালেদা জিয়ার জামিনে থাকা এবং জামিনের অপব্যবহার না করাসহ ৪টি যুক্তিতে খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর করেছেন। এর আগে রোববার খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য ছিল। তবে, ওইদিন বিচারিক আদালতের নথি হাইকোর্টে বিলম্বে আসায় জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য সোমবার দুপুর ২টায় সময় নির্ধারণ করেন হাইকোর্ট। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে গত ৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। রায়ের পরপরই খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি শেষে এক আদেশে বিচারিক আদালতের নথি পাওয়া সাপেক্ষে জামিন প্রশ্নে আদেশ দেয়া হবে বলে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের জানান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচারিক আদালতের নথি রোববার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে হাইকোর্টে এসে পৌঁছে। আদালতের ডেসপাচ শাখার কর্মকর্তারা নথি গ্রহণ করে তা হাইকোর্টের ফৌজদারি আপিল শাখায় পাঠিয়ে দেন। গতকাল আদেশের সময় এই নথি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এর আগে ২০শে ফেব্রুয়ারি সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদার আইনজীবীরা। পরে ২২শে ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের এই বেঞ্চ আপিল গ্রহণ করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বিচারিক আদালতের দেয়া অর্থদণ্ডের আদেশ স্থগিত করেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের শুনানির দিন (২৫শে ফেব্রুয়ারি) ধার্য করে হাইকোর্ট এ মামলার বিচারিক আদালতের নথি তলব করেন যা ১৫ দিনের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয় আদেশে।
গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় সংশ্লিষ্ট আদালতের এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিম। এর আগেই আদালতের এজলাস কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। উভয়পক্ষের আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আদেশ শোনার জন্য এজলাসে অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেকে এজলাস কক্ষে প্রবেশ করতে না পেরে বাইরে অবস্থান নেন। শুনানির শুরুতে আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের কাছে জানতে চান তাদের কোনো সাবমিশন আছে কি-না? জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের কোনো সাবমিশন নেই। জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য ধার্য আছে। এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের কোনো বক্তব্য আছে কি-না তা জানতে চান। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, এটি একটি সেনসেশনাল কেইস। আর টাকা যে উত্তোলন করা হয়েছে এর স্বপক্ষে বেস্ট ডকুমেন্ট রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা (খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা) যে জামিনের দরখাস্ত দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে তিনি (খালেদা জিয়া) অসুস্থ। কিন্তু আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলেছেন যে, তিনি সুস্থ। আদালতের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, আপিল শুনানির জন্য একটি দিন ধার্য করে দিতে পারেন এবং পেপারবুক তৈরি করার আদেশ দিতে পারেন। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, এখানে তো উনি (খালেদা জিয়া) প্রিন্সিপাল একিউজড (প্রধান আসামি)। আর সবকিছু কনসিডার করেই তো তাকে ৫ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন বলেন, উচ্চ আদালতের প্রথা আছে এ ধরনের শর্ট সেন্টেন্সের (কম সাজা) ক্ষেত্রে জামিন দেয়ার। এসময় তিনি উচ্চ আদালতের দুটি মামলার নজির উল্লেখ করে বলেন, সেখানে সাত বছরের সাজার ক্ষেত্রে আদালত জামিন দিয়েছিলেন। শুনানিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কারাবাস এবং জামিনের বিষয়টি উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ ধরনের একটি মামলায় এরশাদ সাড়ে ৩ বছর পর জামিন পেয়েছিলেন। উনিতো (খালেদা জিয়া) মাত্র ২ মাস কারাগারে আছেন। এ পর্যায়ে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন, সাড়ে ৩ বছর সাজার বিষয়ে আপনি যার কথা বলছেন উনার বয়স তখন কত ছিল? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ৬৫ বছর। এসময় আদালত বলেন, ওই সময় উনি শুধু ফিজিক্যালিই ফিট ছিলেন না, জেল থেকে বেরিয়ে বিয়েও করেছিলেন। সন্তানের বাবাও হয়েছিলেন। শুনানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, এই মামলায় দুইবারে মিলিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) আড়াই মাসের বেশি সাজা ভোগ করেননি। তিনি এই মামলার মূল আসামি। কিন্তু ওনার বয়স, শারীরিক অসুস্থতা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করেই বিচারিক আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। দুদক আইনজীবী আরো বলেন, সাজার পরিমাণ কম এটি জামিন পাওয়ার গ্রাউন্ড হতে পারে না। এসময় আদালত খুরশিদ আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার কথা অনুযায়ী মূল আসামিকে ৫ বছর আর অ্যাবেটরদের (সহযোগী আসামি) ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আপনারা কি সেটিসফাইড নন? জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, আমরা সেটিসফাইড নই। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জামিন বিষয়ে আদেশ দু’দিনের জন্য স্থগিত রাখার আবেদন জানান। তবে, আদালত সেটি বিবেচনায় নেননি। একপর্যায়ে আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা যে অসুস্থতার কথা বললেন সবই তো দীর্ঘ মেয়াদি। জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ওল্ড এইজে এরকম হয়। এরপরই হাইকোর্ট এক আদেশে ৪টি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে জামিন দেন। আদালত আদেশে উল্লেখ করেন, বিচারিক আদালত পাঁচ বছরের যে সাজা দিয়েছে তা তুলনামূলকভাবে কম। বিচারিক আদালতের নথি হাইকোর্টে এসেছে, কিন্তু আপিল শুনানির জন্য এখনো প্রস্তুত হয়নি। বিচারিক আদালতে মামলা চলাকালে খালেদা জিয়া জামিনে থেকে মামলা মোকাবিলা করেছেন এবং এর অপব্যবহার না করে আদালতে তিনি নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। বয়স এবং বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে জামিন দেয়া যায়। এসব যুক্তিতে হাইকোর্ট খালেদা জিয়াকে ৪ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন। এই সময়ের মধ্যে পেপারবুক প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট আদেশে বলেন, পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে গেলে যেকোনো পক্ষ শুনানির জন্য আপিল উপস্থাপন করতে পারবে। আদালতের আদেশের পরপরই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদেরও উল্লাস করতে দেখা যায়। এ সময় নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে আরো উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, আব্দুর রেজাক খান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, কায়সার কামাল, জাকির হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আদালতে উপস্থিত ছিলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মঈন খান, মির্জা আব্বাস, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু প্রমুখ।
আমরা আনন্দিত: মওদুদ
খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের প্রতিক্রয়ায় তার আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা আজ আনন্দিত। এই যে একমাস তিনি (খালেদা জিয়া) তিনি কষ্ট করেছেন, সেজন্য আমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, এটাই আমাদের কাছে সবচে বড় বিষয়। তিনি বলেন, যদি কোন সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি মহিলা হন, অসুস্থ হন তাহলে আদালত তাকে মুক্তি দিতে পারেন এটি আইনের বলা আছে। হাইকোর্টের আদেশের পর খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে আইনগত কোন বাধা আছে কি না- এমন প্রশ্নে মওদুদ আহমদ বলেন, কোনরকম আইনগত বাধা নেই এবং শিগগির তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। এদিকে জামিন আদেশের প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, অন্য কোন মামলায় গ্রেপ্তার না দেখালে খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে কোন বাধা নেই। এদিকে বিকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনে আমরা আংশিক খুশি। তবে যখন তিনি জেল গেট থেকে বের হয়ে তাঁর বাড়ি ফিরে আসবেন তখন পুরোপুরি খুশি হবো।
আমরা আপিল করবো: অ্যাটর্নি জেনারেল
খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের প্রতিক্রয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স এবং এই মামলার রায়ের আগে তিনি জামিনে ছিলেন এসব বিবেচনায় আদালত তাকে জামিন দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করবো। ইতিমধ্যে আপিল তৈরি করা শুরু করে দিয়েছি। আগামীকালই (আজ) এই জামিনের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে লিভ পিটিশন দায়ের করবো। খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া সরকারের রাজনৈতিক পরাজয় কি না- এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, অবশ্যই না। একজন আসামি জামিন পাবে কি পাবে না, সেটি আদালতের বিবেচ্য বিষয়। আইনজীবীদের প্রার্থনার বিষয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক কি থাকবে? আর যদি কেউ এখানে রাজনৈতিক সম্পর্ক জড়াতে চায় তাহলে আমার বিবেচনায় সেটি তো খারাপ দিকে যাওয়ার কথা। এদিকে খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের প্রতিক্রিয়ায় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন করা হবে।
কুমিল্লার আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজির করার নির্দেশ
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর এলাকায় যাত্রীবাহী নৈশকোচে দুর্বৃত্তদের পেট্রোল বোমা হামলায় ৮ যাত্রী হত্যা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে আগামী ২৮শে মার্চ কুমিল্লার আদালতে হাজির করার জন্য প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট (পি.ডব্লিউ) ইস্যু করেছে আদালত। ঢাকার গুলশান থানার একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে কুমিল্লার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৫নং আমলি আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক মুস্তাইন বিল্লাহ সোমবার বিকালে এ আদেশ দেন। ওই আদেশটি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুমিল্লার ৫নং আমলী আদালতে চলমান জি.আর ৫১/১৫ মামলায় যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছিল তা ইতোপূর্বে ঢাকার গুলশান থানায় প্রেরণ করা হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য সোমবার গুলশান থানার ওসি এ.বি সিদ্দিক স্বাক্ষরিত একটি আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে কুমিল্লার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৫নং আমলি আদালতের বিচারক মুস্তাইন বিল্লাহ আগামী ২৮শে মার্চ কুমিল্লার আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজির করার জন্য প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট (পি.ডব্লিউ) ইস্যুর আদেশ দেন। বিকালে আদালতের আদেশটি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আদালতের ওই আদেশের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন কোর্ট ইন্সপেক্টর সুব্রত ব্যানার্জি।
জানা যায়, বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধ চলাকালে ২০১৫ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আইকন পরিবহনের একটি নৈশ কোচ (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪০৮০) চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর নামক স্থানে পৌঁছুলে দুর্বৃত্তরা বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। এতে বাসের যাত্রীরা কোন কিছু বুঝে উঠার আগে আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন ও হাসপাতালে নেয়ার পর ১ জনসহ মোট ৮ ঘুমন্ত যাত্রী মারা যায়। এ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে পরদিন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে থানায় পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের নির্দেশে ৮ যাত্রী হত্যা মামলাটি কুমিল্লা ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে খালেদা জিয়া, বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী, মনিরুল হক চৌধুরী, জামায়াত নেতা ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরসহ ৭৭ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৬ই নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ ২টি মামলার চার্জশিটে এজাহার বহির্ভূত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক এমপি মনিরুল হক চৌধুরীসহ স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের আরও ৩০ জন নেতা-কর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত ২রা জানুয়ারি আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে মামলার আসামি পলাতক ৫৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি গভীর রাতে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদরের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হায়দারপুল এলাকায় একটি কার্ভাডভ্যানে আগুন দেয়ার ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায়ও বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে এবং স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের ৩২ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গত বছরের ৬ই মার্চ কুমিল্লার একই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ মামলায় চার্জশিটের ৩২নং আসামি বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে কুমিল্লার আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি মামলা রয়েছে।
এসব মামলা প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুস সা’দাত জানান, ৮ যাত্রী হত্যা মামলায় আদালত সোমবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পি.ডব্লিউ (হাজিরা পরোয়ানা) ইস্যু করেছেন। অপর ২টি মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত ছিল, কিন্তু পরে এ আদেশটি রহিত (ব্র্যাকেট) হলেও সংশ্লিষ্ট আদালতে ওই আদেশের কপি এখনো পৌঁছায়নি।
No comments