বিয়ে নিয়ে ধর্মীয় বৈষম্য by সিরাজ প্রামাণিক
আমাদের
সংবিধানে বলা আছে- ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কোনোরকমের বৈষম্য ছাড়াই
সকলে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে
নারী-পুরুষের সমান অধিকারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।’ সেই সাথে
ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ভেদে অথবা জন্মস্থানের কারণে কারো প্রতি
বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৭ ধারায় উল্লেখ আছে, সব নাগরিক সমান
আশ্রয়লাভের অধিকারী। তবে সংবিধানে বর্ণিত এই সমান অধিকার বা সমান আইনি
প্রতিকার পাওয়ার অধিকার কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। কুষ্টিয়ার মেয়ে অর্চনা
বিশ্বাসের সাথে ঢাকার অনুপ বিশ্বাসের হিন্দুশাস্ত্র মতে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের
সময় নিয়ম ও প্রথা মেনে অর্চনার বাবা তন্ময় বিশ্বাস মেয়ের সুখের জন্য নগদ
টাকা, ব্যবহার্য আসবাব ও স্বর্ণালঙ্কার যৌতুক হিসাবে ছেলেকে দিয়েছিলেন।
কয়েক বছর যেতে না যেতেই অনুপ প্রথম স্ত্রী অর্চনা বিশ্বাসকে কোনো কিছু না
জানিয়ে কিংবা তার অনুমতি ব্যতিরেকে আরেকটি বিয়ে করেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী
রূপালী বিশ্বাসকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এ দিকে অর্চনা বিশ্বাস দীর্ঘ দিন
ধরে নিদারুণ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন; কিন্তু হিন্দুধর্মের বিধান
মতে, সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিষ্কার বিধান না থাকায় অর্চনাকে নিয়মকানুন মেনে
চলতে হচ্ছে। হিন্দু আইনে তালাক দেয়ার কোনো বিধান না থাকায় মৃত্যুর আগ
পর্যন্ত তাকে অনুপ বিশ্বাসের স্ত্রী হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন
হচ্ছেÑ অর্চনা বিশ্বাসের ভরণপোষণ কে দেবে? কিভাবে কাটবে তার বাকি জীবন। যদি
তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন, তবে কেন অর্চনা বিশ্বাস পারবেন না
বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করতে? বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে হিন্দু
নারীরা বৈষম্যের শিকার। কারণ, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী,
নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের যেমন অধিকার আছে (কাবিননামার ১৮ নম্বর শর্ত
সাপেক্ষে), হিন্দুদের বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইন নেই। হিন্দু
আইনে একজন পুরুষ যতবার ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন; কিন্তু স্ত্রী চাইলেও
বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন না। অবশ্য দুই ধর্মেই ভরণপোষণসংক্রান্ত আইন
রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্যমূলক আইন। মুসলিম আইনে নারীরা
সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন এবং সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার
তাদের রয়েছে; কিন্তু হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারী হলেও ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এ
ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত ‘দায়ভাগ’ মতবাদে হিন্দু নারীরা জীবনস্বত্বে এবং
স্ত্রীর মালিকানাধীন- এ দু’ভাবে উত্তরাধিকারী হতে পারেন। জীবনস্বত্বের
ক্ষেত্রে এ সম্পত্তি কোনো নারী বেঁচে থাকা পর্যন্ত ভোগদখলের এখতিয়ার লাভ
করেন; কিন্তু আইনগত কারণ ছাড়া এ সম্পত্তি তিনি হস্তান্তর করতে পারেন না।
তার মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীর ওপর না বর্তিয়ে যার কাছ থেকে
এটি পেয়েছিলেন, তার নিকটবর্তী উত্তরাধিকারীর দখলে চলে যায়। তবে স্ত্রীর
নিজস্ব কোনো সম্পত্তি হলে তা তার উত্তরাধিকারীর মধ্যে বর্তাতে পারে।
ভারতে
১৯৫৬ সালে হিন্দু উত্তরাধিকারসংক্রান্ত আইন পাস হওয়ার পর বাবার মৃত্যুর পর
ছেলে ও মেয়ে সমান অংশ লাভ করে আসছে। মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবকত্বের
ক্ষেত্রে বাবাই সন্তানের আইনানুগ অভিভাবক। তবে মা সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স
পর্যন্ত দেখাশোনা করতে পারেন। হিন্দু আইনে বাবার পর মা সন্তানের অভিভাবক
হতে কোনো বাধা নেই। কোনো বিবাহিত হিন্দু নারীর যদি স্বামী মারা যায়, তাহলে
ওই বিধবা নারী ১৮৬৫ সালের হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন অনুযায়ী আবার বিয়ে
করতে পারবেন এবং এ বিয়ের ফলে যদি কোনো সন্তান জন্মলাভ করে, সে সন্তান বৈধ
সন্তান বলে বিবেচিত হবে। তবে বিধবার আবার বিয়ে হলে তিনি তার আগের স্বামীর
কাছে আইনের দৃষ্টিতে মৃত বলে গণ্য হন এবং সে কারণে পুনর্বিবাহের ফলে তার
সাবেক স্বামীর সম্পত্তির ওপর তিনি অধিকার হারান। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের
জন্য অনেকের মতে দরকার সার্বজনীন পারিবারিক আইন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক,
ফৌজদারি কোনো অপরাধ যেমনÑ চুরি, মারামারি কিংবা খুনের জন্য জাতি, ধর্ম,
বর্ণ ও গোত্রভেদে কোনোরকম বৈষম্য প্রদর্শন করা হয় না; তবে কেন বিয়ের
ক্ষেত্রে এ বৈষম্য থাকবে। এ দিকে, হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশনের
বাধ্যতামূলক বিধান নেই। ফলে বিয়ে, তালাক কিংবা একই স্বামীর একাধিক স্ত্রী
গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা পান না হিন্দু নারীরা। এভাবে
তারা বিয়ের ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অপর দিকে, বিয়ের
ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে রয়েছে বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রির বিধান। আইন অনুযায়ী, এ
বিধান না মানা হলে শাস্তির বিধান আছে; কিন্তু নির্যাতনের শিকার হিন্দু
নারীরা এ ক্ষেত্রে প্রতিকার পান না। তবে ভারতে হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশন
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সার্বজনীন পারিবারিক আইন হচ্ছে নারী-পুরুষের
সম-অধিকার রক্ষার জন্য নতুন আইন প্রণয়নের একটি প্রচেষ্টা। আমাদের দেশে
পারিবারিক ও দাম্পত্যবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা ও বিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক
আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় এবং উল্লিখিত আইনগুলো মূলত ধর্মীয় বিধান মতে
রচিত হওয়ায় এ দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যেমনÑ হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও
খ্রিষ্টানদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রচলিত রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে
ধর্মভেদে নারীদের বৈষম্য পোহাতে হয়। অন্য দিকে খ্রিষ্টান ধর্ম মতে, বিয়ে
সামাজিক বন্ধন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম মতে বিয়ে একটি ধর্মীয় বিষয়। এ ছাড়া
মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়েতে স্ত্রীরা স্বামীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ
মোহরানা পান এবং বিবাহবিচ্ছেদ হলে তিন মাসের খোরপোষ (ভরণপোষণ) লাভ করেন;
কিন্তু অন্য ধর্মে এ রকম কোনো বিধান নেই। মুসলিম বিয়ে একটি চুক্তি হিসেবে
গণ্য হওয়ায় বিয়ের কাবিননামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়; কিন্তু অন্য ধর্মের
অনুসারী স্বামী যদি বিয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন, তবে তার
স্ত্রীর বিয়ে প্রমাণ করার উপায় থাকে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের সুবিধার্থে ১০০
টাকার মাধ্যমে ‘ডিক্লারেশন অব গিফট’ আইন পাস করা হয়েছে। এর ফলে হিন্দুরা
তাদের মেয়েদের কোনো ধরনের জিনিস দিতে চাইলে মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে একটি
দলিল করতে পারবেন। প্রয়োজনে হিন্দু বিবাহবিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার বিষয়ে আইন
প্রণয়নে পৃথক কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বর্তমান সরকার নারীর মর্যাদা ও
অধিকারের কথা বিবেচনায় রেখে বাস্তবধর্মী ফ্যামিলি কোড প্রণয়ন করার উদ্যোগ
নিলে তা বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। শুধু নারী নির্যাতন বন্ধ
কিংবা নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বুলি আওড়ালে হবে না, পারিবারিক আইনের
ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে আরো সক্রিয় হতে হবে। তবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা
হবে, নারীর অধিকার হবে সমুন্নত।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
E-mail:seraj.pramanik@gmail.com
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
E-mail:seraj.pramanik@gmail.com
No comments