জাতীয় নেতাদের যথার্থ সম্মান দেখানো হোক by ড. মিল্টন বিশ্বাস
শারদীয় দুর্গাপূজা ও পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসবের মধ্য দিয়ে অক্টোবর মাসটি শেষ হলো। আজ নভেম্বরের ৩ তারিখে জেলহত্যা দিবস। ঈদ উৎসব শেষে মানুষ কতটুকু নিবেদিত হতে পারবে সেই দিনটির জন্য? প্রতিবছর ঘুরে-ফিরে দিনটি আসে, চলেও যায়।
এক বিশাল উত্তরাধিকার, ব্যাপ্ত দেশপ্রেম ও বিজয়ের মুকুট সঙ্গে নিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের পদচারণ শুরু হয়েছিল, তার জন্য যাঁদের আত্মত্যাগ ছিল, সেই জাতীয় নেতাদের আজও আমরা যথার্থ সম্মান দেখাতে শিখেছি কি? ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টো স্রোতের দিকে টেনে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দি করা হয়। এক সপ্তাহ পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। বন্দি করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ আরো অনেক নেতাকে। বাংলাদেশ যেন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, তাই '৭১-এর পরীক্ষিত চারজন নেতাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায়, বন্দি অবস্থায় কারাগারের ভেতর হত্যা করা হয় ৩ নভেম্বর। অর্থাৎ হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং প্রথম স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টাসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছিল মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে। এই নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় তাদের সব ক্রোধ ও আক্রোশের মূল লক্ষ্যে পরিণত হন তাজউদ্দীন আহমদ। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা তাজউদ্দীনকে হিন্দু 'ত্যাজারাম সিং' ও ভারতের গুপ্তচর বলে অভিহিত করেছে। প্রচার করা হয়েছিল তিনি আট বছর বয়সে নাম পাল্টে তাজউদ্দীন হয়েছেন। এরপর আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগে ঢুকে পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন। ছাত্রদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ, যার মূল ষড়যন্ত্রকারী তিনি। তাঁর প্রতি আক্রোশ আর ঘৃণায় পাকিস্তানি সেনাদের চোখ জ্বল জ্বল করত। তারা বলত, পাকিস্তানকে ভাঙতে চান তাজউদ্দীন, কারণ তিনি হিন্দু। মুক্তিসংগ্রামে তাজউদ্দীনের সাহসী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন অন্য তিনজন নেতাও। সে সময় এই চার নেতার ব্যক্তিগত সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, ক্রোধ, প্রতিশোধ- সবই ধাবিত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক তথা শত্রুর বিরুদ্ধে।
বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত চারজনই এমন সজ্জন ও নির্বিরোধ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন যে তাঁদের সঙ্গে কারো শত্রুতার প্রশ্নই আসে না। তাঁদের মতো নির্দোষ প্রকৃতির ও অক্ষতিকর মানুষ রাজনীতিকদের মধ্যে কমই দেখা যায়। তাঁদের সরল জীবনযাপনও ছিল মুগ্ধ করার মতো। ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পরিকল্পনাকারী, হুকুমদাতা ও হত্যাকারী- কেউই চার রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত শত্রু ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদ যখন অর্থমন্ত্রী; তখন বলতেন, 'আমরা দেশ শাসন করছি, দেশের মঙ্গল চাই, কাজেই আমাদের দুর্বলতা আছে, এগুলো মানা উচিত। স্বীকার করা উচিত। আমরা তো সব জানি না, তাই শিখতে হবে।' রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও তাঁরা কোনো নিন্দিত কাজ করেননি। অনেকেই সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসায় গিয়ে দেখেছেন, সকালে তিনি গেঞ্জি গায় দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। মধ্যবিত্তের স্নিগ্ধ আচরণ ছিল তাঁর মধ্যে। বাংলা ভাষায় কামরুজ্জামান চমৎকার বক্তৃতা করতেন। সুকণ্ঠের অধিকারী এই জননেতা গান গাইতেও পারতেন। মনসুর আলী ছিলেন শান্ত ও নির্বিরোধ। এ ধরনের মানুষের কোনো ব্যক্তিগত শত্রু থাকার কথা নয়; ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে পশ্চিমা শোষণবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, এই চার নেতা তখন থেকে সেই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁরা সবাই ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিপক্ষে। কারণ আমলারা বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দলিত করছিল। এ জন্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁদের কাজ ছিল বাংলার মানুষকে সংঘবদ্ধ করা। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁদের লড়াই ছিল বাঙালির ন্যায্য দাবির লড়াই, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আপসহীন পথযাত্রা। ষাটের দশক থেকে এই চার জাতীয় নেতা তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণকে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; মানুষকে দাবি আদায়ের বিষয়ে আশাবাদী করে তুলেছিলেন। ইসলাম ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান-বিশ্বাসী মানুষকে সর্বজনীন গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত করার কৃতিত্ব তাঁদের। আর মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের নেতৃত্ব বিশ্ববাসীর কাছে ছিল সুউচ্চ ও মহান। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তাঁরা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হন। দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত ছিলেন তাঁরা। ভালো রাজনীতিক মাত্রই ভালো প্রশাসক হবেন- এটা ঠিক নয়; তবে তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন। কারণ তাঁরা কেউ ষাটের দশকের আদর্শবাদী রাজনীতির বাইরে চলে যাননি। বরং একটি অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বাকশালের পতাকাতলে একত্রিত হয়েছিলেন। কারণ তখনো বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের দেশ। কিন্তু পুরনো শত্রুরা সক্রিয় ছিল তখনো। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু সরকারের নীতি পছন্দ করত না। দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের নানা তৎপরতা চলতে থাকে। এরই পরিণতিতে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা। এর পরই পাকিস্তানি ঘরানার ইসলামী রাজনীতি পুনর্বহাল হয় বাংলাদেশে।
সেই সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পেছনে কিছু সেনা কর্মকর্তার ক্ষমতার লোভ প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিল। ১৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর সৃষ্ট অস্থিরতায় খালেদ মোশাররফ জিয়াকে সরিয়ে দিয়ে সেনাপ্রধান হন। মোশতাক-মোশাররফের ক্ষমতার লড়াইয়ের সময়ই '৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা ঘটে। অর্থাৎ ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদীদের ক্যু ও পাল্টা ক্যু চলছিল তখন। জেলহত্যার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত ছিল অথবা ওই ঘটনার সমর্থক ব্যক্তিদের নিয়ে জিয়া ও এরশাদ ১৩ বছর রাজনীতি করেছেন। তাঁদের সেই রাজনীতির ধারাটি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান নিজেই ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে আজকে তথ্য-প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ জন্যই কি তিনি সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ঘাতকদের বিচারের সামনে দাঁড় করানো থেকে বিরত থেকেছিলেন? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন?
ইতিহাসের জঘন্য ও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৭৫ সালেই লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর আট বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অন্য পাঁচজনকে খালাস দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
কিন্তু ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে অন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের খালাস দেওয়া হয়। তবে জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অন্য আট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি সম্পর্কে কোনো মতামত না দেওয়ায় তাঁদের দণ্ড বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে জেলহত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যসহ আমরা এ রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। একই সঙ্গে রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়েছে। কারণ জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পুনঃ তদন্ত ও পুনর্বিচার বর্তমান প্রজন্মের দাবি।
সংসদীয় গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মহাজোট সরকার এখন ক্ষমতায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিল, 'জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার করা হবে।' জেলহত্যার নির্মম বলি মহান ব্যক্তিরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারার সমর্থক। তাঁদের হত্যার বিচার ও দোষীদের শাস্তি বিধানের মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক ধারা সমুন্নত রাখতে পারলেই তাঁদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। একাত্তরে প্রদীপ্ত শিখার মতো এ জাতীয় নেতারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দৃঢ় হাতে যুদ্ধের হাল ধরেছিলেন। লাখ লাখ শহীদের আত্মদান, আর্তনাদ, হাহাকার, বেদনা আর অশ্রু পেরিয়ে এরপর আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পতাকা পেয়েছি সেদিনের সেই কীর্তিমানদের সাংগঠনিক তৎপরতার কারণেই। পৃথিবীর বুকে তাঁদের অসামান্য কীর্তির গর্বিত সন্তান আমরা। জাতীয় নেতাদের যথার্থ সম্মান দেখানোর জোর দাবি জানাচ্ছি আমরা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টাসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছিল মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে। এই নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় তাদের সব ক্রোধ ও আক্রোশের মূল লক্ষ্যে পরিণত হন তাজউদ্দীন আহমদ। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা তাজউদ্দীনকে হিন্দু 'ত্যাজারাম সিং' ও ভারতের গুপ্তচর বলে অভিহিত করেছে। প্রচার করা হয়েছিল তিনি আট বছর বয়সে নাম পাল্টে তাজউদ্দীন হয়েছেন। এরপর আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগে ঢুকে পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন। ছাত্রদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ, যার মূল ষড়যন্ত্রকারী তিনি। তাঁর প্রতি আক্রোশ আর ঘৃণায় পাকিস্তানি সেনাদের চোখ জ্বল জ্বল করত। তারা বলত, পাকিস্তানকে ভাঙতে চান তাজউদ্দীন, কারণ তিনি হিন্দু। মুক্তিসংগ্রামে তাজউদ্দীনের সাহসী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন অন্য তিনজন নেতাও। সে সময় এই চার নেতার ব্যক্তিগত সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, ক্রোধ, প্রতিশোধ- সবই ধাবিত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক তথা শত্রুর বিরুদ্ধে।
বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত চারজনই এমন সজ্জন ও নির্বিরোধ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন যে তাঁদের সঙ্গে কারো শত্রুতার প্রশ্নই আসে না। তাঁদের মতো নির্দোষ প্রকৃতির ও অক্ষতিকর মানুষ রাজনীতিকদের মধ্যে কমই দেখা যায়। তাঁদের সরল জীবনযাপনও ছিল মুগ্ধ করার মতো। ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পরিকল্পনাকারী, হুকুমদাতা ও হত্যাকারী- কেউই চার রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত শত্রু ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদ যখন অর্থমন্ত্রী; তখন বলতেন, 'আমরা দেশ শাসন করছি, দেশের মঙ্গল চাই, কাজেই আমাদের দুর্বলতা আছে, এগুলো মানা উচিত। স্বীকার করা উচিত। আমরা তো সব জানি না, তাই শিখতে হবে।' রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও তাঁরা কোনো নিন্দিত কাজ করেননি। অনেকেই সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসায় গিয়ে দেখেছেন, সকালে তিনি গেঞ্জি গায় দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। মধ্যবিত্তের স্নিগ্ধ আচরণ ছিল তাঁর মধ্যে। বাংলা ভাষায় কামরুজ্জামান চমৎকার বক্তৃতা করতেন। সুকণ্ঠের অধিকারী এই জননেতা গান গাইতেও পারতেন। মনসুর আলী ছিলেন শান্ত ও নির্বিরোধ। এ ধরনের মানুষের কোনো ব্যক্তিগত শত্রু থাকার কথা নয়; ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে পশ্চিমা শোষণবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, এই চার নেতা তখন থেকে সেই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁরা সবাই ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিপক্ষে। কারণ আমলারা বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দলিত করছিল। এ জন্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁদের কাজ ছিল বাংলার মানুষকে সংঘবদ্ধ করা। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁদের লড়াই ছিল বাঙালির ন্যায্য দাবির লড়াই, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আপসহীন পথযাত্রা। ষাটের দশক থেকে এই চার জাতীয় নেতা তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণকে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; মানুষকে দাবি আদায়ের বিষয়ে আশাবাদী করে তুলেছিলেন। ইসলাম ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান-বিশ্বাসী মানুষকে সর্বজনীন গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত করার কৃতিত্ব তাঁদের। আর মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের নেতৃত্ব বিশ্ববাসীর কাছে ছিল সুউচ্চ ও মহান। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তাঁরা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হন। দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত ছিলেন তাঁরা। ভালো রাজনীতিক মাত্রই ভালো প্রশাসক হবেন- এটা ঠিক নয়; তবে তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন। কারণ তাঁরা কেউ ষাটের দশকের আদর্শবাদী রাজনীতির বাইরে চলে যাননি। বরং একটি অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বাকশালের পতাকাতলে একত্রিত হয়েছিলেন। কারণ তখনো বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের দেশ। কিন্তু পুরনো শত্রুরা সক্রিয় ছিল তখনো। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু সরকারের নীতি পছন্দ করত না। দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের নানা তৎপরতা চলতে থাকে। এরই পরিণতিতে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা। এর পরই পাকিস্তানি ঘরানার ইসলামী রাজনীতি পুনর্বহাল হয় বাংলাদেশে।
সেই সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পেছনে কিছু সেনা কর্মকর্তার ক্ষমতার লোভ প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিল। ১৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর সৃষ্ট অস্থিরতায় খালেদ মোশাররফ জিয়াকে সরিয়ে দিয়ে সেনাপ্রধান হন। মোশতাক-মোশাররফের ক্ষমতার লড়াইয়ের সময়ই '৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা ঘটে। অর্থাৎ ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদীদের ক্যু ও পাল্টা ক্যু চলছিল তখন। জেলহত্যার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত ছিল অথবা ওই ঘটনার সমর্থক ব্যক্তিদের নিয়ে জিয়া ও এরশাদ ১৩ বছর রাজনীতি করেছেন। তাঁদের সেই রাজনীতির ধারাটি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান নিজেই ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে আজকে তথ্য-প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ জন্যই কি তিনি সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ঘাতকদের বিচারের সামনে দাঁড় করানো থেকে বিরত থেকেছিলেন? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন?
ইতিহাসের জঘন্য ও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৭৫ সালেই লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর আট বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অন্য পাঁচজনকে খালাস দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
কিন্তু ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে অন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের খালাস দেওয়া হয়। তবে জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অন্য আট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি সম্পর্কে কোনো মতামত না দেওয়ায় তাঁদের দণ্ড বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে জেলহত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যসহ আমরা এ রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। একই সঙ্গে রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়েছে। কারণ জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পুনঃ তদন্ত ও পুনর্বিচার বর্তমান প্রজন্মের দাবি।
সংসদীয় গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মহাজোট সরকার এখন ক্ষমতায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিল, 'জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার করা হবে।' জেলহত্যার নির্মম বলি মহান ব্যক্তিরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারার সমর্থক। তাঁদের হত্যার বিচার ও দোষীদের শাস্তি বিধানের মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক ধারা সমুন্নত রাখতে পারলেই তাঁদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। একাত্তরে প্রদীপ্ত শিখার মতো এ জাতীয় নেতারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দৃঢ় হাতে যুদ্ধের হাল ধরেছিলেন। লাখ লাখ শহীদের আত্মদান, আর্তনাদ, হাহাকার, বেদনা আর অশ্রু পেরিয়ে এরপর আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পতাকা পেয়েছি সেদিনের সেই কীর্তিমানদের সাংগঠনিক তৎপরতার কারণেই। পৃথিবীর বুকে তাঁদের অসামান্য কীর্তির গর্বিত সন্তান আমরা। জাতীয় নেতাদের যথার্থ সম্মান দেখানোর জোর দাবি জানাচ্ছি আমরা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
No comments