আম-কাঁঠালের ছুটি by জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
কিছু খাচ্ছিস? হুঁ। আমি টের পাই। ঘরের ভেতর থেকে ফোকলা গালে বুড়ি হি-হি হাসে। একটা কচমচ শব্দ আমার কানে আসছে বাপ। তা আর টের পাবি না তুই! দাওয়ায় বসে শিবনাথ ঘরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে মুখ ঝামটা দেয়। দিন দিন তোর কানের ধার বাড়ছে যে বেটি।
এই দ্যাখো! রাগ করলি। বুড়ি আর হাসে না। বড় করে শ্বাস ফেলে। একজনই তো শব্দ করিস। হাঁটিস, চলিস, খাস_তাই কান পেতে শুনি। শুনতে ভালো লাগে।
তখন শিবনাথ চিন্তা করে, কথাটা মিথ্যা কি। অনেক শব্দ হয়েছে এ বাড়িতে, কত শোরগোল কানে এসেছে। এখন সব চুপ। যেন অনেক পাখি এলো, সারা দিন গান করল, কিচমিচ শব্দ করল, বিকেল পড়তে, না কি ধিকিধিকি বেলা থাকতেই সব পালিয়ে গেল, উড়ে গেল!
যেমন_এই উঠোনের আনাচকানাচে। কতবার কত রকম গাছ গজিয়েছে, ফুল দিয়েছে, কিছু কিছু ফল ফলেছে। এরপর সব শুকিয়ে মরেহেজে একাকার। এখন ফল ফুল গাছের চিহ্নও নেই। খাঁ খাঁ করছে চারদিক।
হুঁ, কত শব্দ ছিল, বুড়ি বিড়বিড় করে, উলুর শব্দ, শাঁখের ফুঁ, ঢাকের বাদ্যি, আঁতুড়ের ট্যাঁট্যাঁ, অন্নপ্রাশনের রান্নার ঘটর ঘটর আওয়াজ, আত্মীয়কুটুমের আনাগোনা, হৈচৈ, হাঁচিকাশি_এই বৈশাখে অন্নপ্রাশন গেছে, আর এক ফাগুনে আবার এই উঠোনে সানাইয়ের পোঁ পোঁ, উলু, শাঁখের ফুঁয়ে কান ঝালাপাল_
তারপর! থামলি কেন, বলে যা। বারান্দায় বসে শিবনাথ বুড়ির বিড়বিড় শোনে। শাঁখের ফুঁয়ে কান ঝালাপালা, তার মানে আর একটা বিয়ে, ন' মাস না পেরোতে আবার আঁতুড়ের ট্যাঁট্যাঁ, আত্মীয়কুটুমের আনাগোনা, মুখে-ভাতের রান্নার ঘটর ঘটর আওয়াজ। শিবনাথ ভেংচি কাটে। তারপর?
বুড়ি চুপ।
শিবনাথ চুপ থাকে না। চেঁচিয়ে বলে, ঘুরে ঘুরে বিয়ে শুনলি, বউ-ভাতের খাওয়া শুনলি, আঁতুড়ের ট্যাঁট্যাঁ কানে এলো_আর ওই যে বড় আওয়াজটা_বলো হরি হরিবোল এই উঠোনে কবার শুনলি, কতবার কান ঝালাপালা হয়েছে তোর শুনি?
যেন এবার বুড়ি মিইয়ে যায়, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। টের পেয়ে দাওয়ায় বসে শিবনাথ ফ্যাফ্যা করে হাসে। তারপর চৌকাঠের ওদিকে গলাটা বাড়িয়ে দেয়। বুড়িকে দেখে। আর কথা বলছিস না কেন বেটি, হুঁ? শিবনাথ খোঁচা দেয়।
কী বলব রে বাপ। মানুষ কি মানুষকে ধরে রাখতে পারে? কাতর গলায় বুড়ি জবাব দেয়।
না তা পারবে কেন। তবে তো আমি আমার বাবাকে ধরে রাখতাম, ছোট ভাইটাকে ধরে রাখতাম, তুই তোর ছেলের বউকে ধরে রাখতে পারতিস, নাতি দুটোকে ধরে রাখতিস, সেই সঙ্গে তোর মেয়ে গঙ্গাকে, ওর বাচ্চাটাকে_আমাদের কত আগে সব পালিয়ে গেল...
বলতে গিয়ে শিবনাথের গায়ে কাঁটা দেয়। আর হাসে না সে, বুড়ি কথা বলে না। বুড়ির এই চুপ করে থাকাটা শিবনাথের অসহ্য। কী হলো! কী বলছি তোকে, উত্তর দে।
যেন বুড়ি কাঁদে। নাকের ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হয়।
এই দ্যাখো! শিবনাথ ধমক লাগায়। কান্নাকাটির হিড়িক পড়ে গেল। একটা আলোচনা হচ্ছে, অমনি ফ্যাচফ্যাচ শুরু_অ মা!
কী বলব বল্! ধরা গলায় বুড়ি বলে ওরা সগ্গে গেছে, ভগবানের কোলে ঠাঁই নিয়েছে।
যা বলেছিস। শিবনাথ এবার জোরে জোরে হাসে যেন বুড়ির সঙ্গে সে রগড় করে। হুঁ ভগবানের কোলে ঠাঁই নিতে সব চলে গেছে, আর তোকে রেখে গেছে এই খালি উঠোন পাহারা দিতে, তাই না?
একটু থেমে থেকে আবার সে বলে, তা উঠোন তো একেবারে খালি হয়নি, এখনো তোর গভ্ভের একটা শত্তুর রয়ে গেছে। আর ওটা সারা দিন কী করছে, কী খাচ্ছে, তোর চোখ-কান পড়ে আছে সেদিকে। মিছা বললাম!
হুঁ, চোখ, সারা দিন চোখ পড়ে আছে তোর দিকে। এবার বুড়ির অভিমানের গলা শোনা গেল। চোখের আমার কিছু আছে কি না_সারা দিন তুই কী করিস, কী খাস আমি কেবল তাকিয়ে দেখি।
নাকের ফ্যাচফ্যাচ শব্দ করে আবার বুঝি বুড়ির কান্না শুরু হয়।
এই দ্যাখো! বাইরে থেকে শিবনাথ গলা ঝাঁকায়। তবে চল না একদিন হাসপাতালে নিয়ে যাই, চোখের ছানি কাটিয়ে আনি। তারপর নতুন চশমা নিবি_
ঠাট্টা করিসনে। নাকের কান্না থেমে যায় বুড়ির। চোখ কাটানোর বয়স আছে কি না আমার, নতুন করে চশমা নেব! যেন বাচ্চা খুকি আমি_কথা দিয়ে ভোলাচ্ছিস।
এই দ্যাখো, কথা দিয়ে ভোলানোর কী আছে, কে বলেছে তোর চশমা নেওয়ার বয়স নেই? শিবনাথ গুজগুজ করে হাসে। আমি দেখছি তোর যৌবন ফিরে আসছে। তোর বয়স এখন বায় কি তেয়_
বুড়ি একেবারে চুপ। কেবল অভিমান না, এবার বেটি রাগ করেছে টের পেয়ে শিবনাথ উঠে দাঁড়ায়।
অ মা! আদর করে ডাকে সে। জামরুল খাবি? বলছিলি কচমচ শব্দ শুনছিলি_আমি খাচ্ছি যে_
অ্যাঁ, জামরুল! নিমেষের মধ্যে বুড়ির রাগ-অভিমান কর্পূরের মতো উড়ে যায়। যেন পাঁচ বছরের খুকির মতন আহ্লাদে নেচে ওঠে। শিবনাথ তাই চাইছিল। এ জন্যেই এত রগড়।_জামরুল বললি, না কি গোলাপজাম? শিবু! বুড়ি অস্থির হয়ে ঘরের ভেতর থেকে ডাকে।
এই দ্যাখো! বাইরে থেকে শিবনাথ চেঁচায়। সাধে কী বলি যত দিন যাচ্ছে, সব গুলিয়ে ফেলছিস তুই। কেবল কী চোখ গেছে, কানের মাথাটিও খাওয়া হয়ে গেছে অনেক দিন। যেন শিবনাথ খুশি হতে গিয়ে দুঃখ করে। আম বলতে আনারস শুনিস, লিচু বলতে কলা, কলা বলতে কাঁঠাল শুনিস_বলছি জামরুল_উনি শুনছেন গোলাপজাম। তোকে নিয়ে আর পারা যায় না বেটি।
আমায় নিয়ে সত্যি আর পারা যায় না। তাই না বাপ! বুড়ি খুশিতে ডগমগ। তোর এই আড়াই বছরের মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ানক মুশকিলে পড়ে গেছিস। আম, জাম, লিচু, জামরুল, কলা, কাঁঠাল_রাক্ষসী আবার সব জায়গায় সব দেখতে চায়, একসঙ্গে খেতে চায়! কেমন? বুড়ি হি-হি করে হাসে।
মিছা কি! শিবনাথ হাসির আড়ালে গাঢ় নিশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে, দিন ঘনিয়ে এসেছে, যাওয়ার ঘণ্টা বেজে গেছে_তাই সব কিছু খাবার জন্য তোমার জিভ চুকচুক করছে।
তা কে দিলে জামরুল। কিনলি তুই? বুড়ি একটু পরে শুধায়।
না, বাইরে রকে বসেছিলাম, পাড়ার দুটো ছোড়া কোচড় ভরে জামরুল নিয়ে যাচ্ছিল_আমায় দিলে ওরা।
তুই চাইলি বুঝি?
কেন চাইব, ওরা নিজে থেকে দিলে। বলে, কি শিবদাদু তুমি বুড়ো হয়েছ, গাছে চড়তে পার না, এই দ্যাখো নন্দীবাবুদের বাগান থেকে কত জামরুল পেড়ে এনেছি আমরা। নাও, তোমায় দুটো দিলাম_খাও।
বড় ভালো ছেলেরে ওরা।
হুঁ, নন্দীবাবুদের বাগানের জামরুলও ভারি মিষ্টি। শিবনাথ বেশ রস করে বলল।
খা! বুড়ি বলল।
ওই একটা কথাই বলল। কেননা শিবনাথ টের পায়, এই মুহূর্তে একটার বেশি দুটো কথা বলা বুড়ির পক্ষে সম্ভব নয়। মিষ্টি জামরুল শুনে বুড়ির জিভে এত জল এসে গেছে। অবাক কাণ্ড, শিবনাথ চিন্তা করে, যত দিন যাচ্ছে, খাওয়ার নাম শুনলে শুকনো খেজুর-পাতার মতন খসখসে একরতি জিভটা কেমন রসে টইটই করে ওঠে।
কী হলো বেটি! খাবি একটা তুই?
নারে বাপ। তুই খা। আমার কি দাঁত আছে, চিবোব কেমন করে? বলতে বলতে বুড়ির ঠোঁট বেয়ে সত্যি দুই ফোঁটা লালা ঝরে পড়ে। আর একবার চৌকাঠের ওদিকে উঁকি দিতে দৃশ্যটা শিবনাথের চোখে পড়ে। মনে মনে সে হেসে বাঁচে না। তক্ষণি আবার রগড় করে বলে, দাঁত নেই তো হয়েছি কী? কাটারি দিয়ে কুচিয়ে দেব, চুষে খাবি।
বুড়ি মাথা নাড়ে। বড় করে শ্বাস ফেলে।
কী হলো! গলাটা ওদিকে বাড়িয়ে রেখে শিবনাথ বলল, কুচিয়ে দিলে খেতে পারবি না?
অমন করে জামরুল খেয়ে কি সুখ আছে? ছোট মেয়ের মতন বুড়ির গলায় যেন নতুন করে খেদ অভিমান জাগল। যে জিনিস যেমনটি করে খাবার_।
তাই বলো! যে জিনিস যেমন করে খাবার তেমন করে না খেলে_শিবনাথ নিজের মনে চোখ টেপে। হাসে। এখনো বেটির কামড়ে কামড়ে ফল খাবার শখ!
আচ্ছা শিবু! তোর আর কটা দাঁত আছে বাপ? বুড়ি শুধায়।
চারটে।
ওপরের পাটির, নাকি নিচের?
এই দ্যাখো! কেবল একপাটির দাঁত থাকলে যেন জামরুল কামড়ে খাওয়া যায়। শিবনাথ খিচিয়ে ওঠে। সব ভুলে গেছিস বুড়ি। তোর কি কোনো দিন দাঁত ছিল না? আখ-জামরুল কোনো দিন চিবিয়ে খাসনি? ওপরের নিচের দুপাটির দুটো করে দাঁত আছে আমার।
আহা! তুই কত সুখে আছিস, জামরুল-পেয়ারা-আখ সব চিবোতে পারিস_চিঁড়ে, মুড়ি, ছোলাভাজা ও বাদামভাজা। ঝরঝর করে বুড়ির ঠোঁট বেয়ে জল পড়ছিল, শিবনাথ টের পায়। তবু বুড়ির কথা থামছিল না। কাল সন্ধ্যেবেলা দাওয়ায় বসে টুকুসটুকুস করে চিনাবাদাম খেয়েছিলি, তাই না শিবু? আমি শুনেছি।
চুপ চুপ! শিবনাথ এবার ঘরে ঢুকে পড়ল। বুড়িকে ধমক লাগাল। যেন এই জন্মে কোনো দিন চিঁড়ে-মুড়ি-চিনেবাদাম তুই খাসনি, এখনো খাওয়ার আফসোস, হুঁ। আমি সুখে আছি, আমার চারটে দাঁত আছে।
ধমক খেয়ে বুড়ি মিইয়ে যায়। চুপ করে থাকে। তক্তপোষের ময়লা কাঁথার বিছানায় উবু হয়ে বসে আছে প্রাচীন মানুষটা। সব কটা পাকাচুল ঝরে পড়ে ছোট মাথাটা নেড়া হয়ে অবিকল কতবেলের চেহারা ধরেছে। পাকাটির মতন সরু ঠ্যাং ও কাঁকড়ার বাচ্চার মতন শুকনো খুদে খুদে দুটো হাঁটু। হাড় ছাড়া আর কিছু নেই বলে বুড়ির হাঁটুর দিকে তাকালে শিবনাথের এখন দুটো বাচ্চা কাঁকড়ার কথা মনে পড়ে। দুই হাঁটুর মাঝখানে থুঁতনিটা ঝুলিয়ে দিয়েছে বুড়ি।
শিবনাথ আরো দেখল, বুড়ির মাথার ওপর দিয়ে এধারের বেড়া থেকে জাল টেনে একটা মাকড়সা ওপাশের বেড়ার দিকে হেঁটে যেতে চাইছে। কাল দুপুরে ঝাড়ন বুলিয়ে শিবনাথ জালটা ভেঙে দিয়েছিল।
আমি সুখে আছি, এখনো আমার চারটে দাঁত আছে। ইচ্ছে করে শিবনাথ গলায় ঝাঁজ ফুটিয়ে তুলল। যদিও মনে মনে সে হাসে। যেন বুড়িকে চটাতে তার ভালো লাগে। আমি আখ খাই, পেয়ারা খাই, চিঁড়েমুড়ি চিবোই_তাই হিংসেয় তোর পেট ফাটে, তাই না মা!
না রে বাপ, এমন কথা বলিস না। তুই আমার পেটের সন্তান। তোর সুখ দেখলে আমার সুখ।
উঁহু, কক্খনো না। শিবনাথ মাথা নাড়ে। বুড়ির মতন তার মাথার চুল ঝরে পড়েনি, তার সবটা মাথাই এখন সাদা হয়ে গেছে। ভুরু জোড়া সাদা হয়ে গেছে। বুড়ির অবশ্য ভুরুর লোমও উঠে গেছে। ফলে কুঁচকানো কপালে ও ছানিপড়া চোখে লেপালেপি হয়ে গিয়ে সে এক আজব চেহারা ধরেছে মুখটা। সেদিকে চোখ রেখে শিবনাথ আবার একটু রগড় করে। হুঁ, আমি খুব টের পাই, রাত্তিরে আমি রুটি খেয়ে হজম করি_তুই সাবু ভিজিয়ে খাস, তাই তোর ঈর্ষে। রাস্তার কল থেকে এখনো আমি বালতি ভরে জল টেনে আনি_দেখে তোর মন খারাপ...
এ কী বলিস শিবু, অ্যাঁ! বুড়ি প্রায় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। এমন করে তুই আমার মনে দুঃখু দিস, ১০ মাস ১০ দিন তোকে আমি গভ্ভে ধরেছিলাম।
শিবনাথ হাতের বাকি জামরুলটা চিবিয়ে শেষ করল। একটা ঢেঁকুর তুলল। কাঁধের গামছা দিয়ে মুখটা মুছে ফেলল। তারপর কোনা থেকে ঝাড়নটা তুলে নিয়ে আবার মাকড়সার জালটা ভেঙে দিল। তারপর হাত থেকে ঝাড়ন নামিয়ে রেখে কাঁথাটা টেনেটুনে বুড়ির বিছানাটা ঠিক করে দেয়।
এবার বুড়িরও কান্না থামে। অর্থাৎ ছেলে তার পরিচর্যা করছে টের পেয়ে মনে সান্ত্বনা পায়। কিন্তু কান্নার ফোঁপানিটা থেকে যায়। হাড়গোড় বেরোনো পাতলা ছোট শরীরটা তখনো কাঁপে। শিবনাথ একদৃষ্টে চেয়ে দেখে। গায়ে একটা বোতাম, ছেঁড়া ব্লাউজ। স্তন দুটো শুকিয়ে পাঁজরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে, কালো ফুটকি দুটো ছাড়া এখন আর কিছুই চেনা যায় না। মনে হয় আট বছরের একটি মেয়ের লেপাপোছা বুক। এই স্তন টেনে শিবনাথ বড় হয়েছিল, বিশ্বাস করতে কেমন বাধে। রোগা জীর্ণ শরীরে আস্ত একটা থান কাপড়ের বোঝা বইতে পারে না বলে শিবনাথ শুধু একটা সায়া পরিয়ে রেখেছে মানুষটাকে।
কী হলো! কাঁপছিস কেন, শীত করছে বেটি? শিবনাথ তক্তপোষের কাছে ঝুঁকে দাঁড়ায়।
হ্যাঁ বাপ। বাইরে বুঝি ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে?
কোথায় ঠাণ্ডা হাওয়া! সারা দিন খটখটে রোদ ছিল। রোদ পড়ে গিয়ে এখন বিকেল হচ্ছে।
তাই তো ঠাণ্ডা লাগছে। রোজ বিকেল পড়তে আমার কেমন শীত করে শিবু।
কম্বলটা জড়িয়ে দেব?
দে বাপ।
পায়ের কাছ থেকে ভাঁজ করা কম্বলটা তুলে শিবনাথ বুড়ির গায়ে জড়িয়ে দিল।_হয়েছে?
হুঁ, বুড়ি আরাম পায়। হাঁটুর ভাঁজ খুলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে।
তোর কি বিকেল পড়তে শীত করে শিবু? বুড়ি প্রশ্ন করে।
আমার কেন শীত করবে! শিবনাথ হাসে। আমি কি তোর মতন ওই যে বলে লাতুড়ে লেতলেতে বুড়ি হয়ে গেছি। আমি এখনো শক্ত। আমার গায়ের রক্ত এখনো গরম।
বুড়ি চুপ করে থেকে বড় একটা শ্বাস ফেলে।
কী হলো! শিবনাথ গলা চড়িয়ে দেয়। আবার বুঝি মন খারাপ হলো?
কেন মন খারাপ হবে! বুড়ি চমকে ওঠে।
হেঁ, হেঁ, আমি টের পাই। তোর শিবু এখনো শক্ত আছে। তার রক্ত গরম। তার শীত করে না। তোর মতন অচল হয়ে সে বিছানা নেয়নি_
ষাট ষাট! কেন বিছানা নিবি। তুই যে আমার জোয়ান ছেলে। আমার কাছে তুই আজও ছটফটে ১০ বছরের খোকা।
বটে! ঘরের চালে টিকটিকি ডাকে। শিবনাথ আবার গলা ছেড়ে হাসে। এটা জবর বলেছিস বুড়ি। তোর শিবু এখনো ১০ বছরের খোকা থেকে গেছে। কথাটা শেষ করে শিবনাথ মনে মনে বলে, ভাগ্যিস তোর দুই চোখে ছানি পড়েছে বুড়ি। না হলে দেখতে পেতিস তোর ১০ বছরের খোকার ভুরু ও মাথার চুল রসুনের রং ধরেছে, কোমর বেঁকে গেছে, আজ পর্যন্ত ২৮টা দাঁত পড়ল আর যেহেতু তোর গর্ভের সন্তান, তারও একটা চোখে ছানি দেখা দিয়েছে।
আচ্ছা শিবু, তোর সঠিক বয়সটা জানি এখন কত বাবা! দুম করে বুড়ি প্রশ্ন করল। শিবনাথ যা আশঙ্কা করছিল। এইমাত্র সে লক্ষ্য করেছে, আঙুলের কড় গুনে বুড়ি নিজের বয়সের হিসাব বার করতে লেগে গেছে। যেন কিছুতেই হিসাবটা ঠিক রাখতে পারে না। গুলিয়ে ফেলছে!
কেন, তুই তো বললি আমি তোর ১০ বছরের খোকা। ভেংচি কাটার মতন চেহারা করল শিবনাথ। বলিসনি এই মাত্তর?
বুড়ি চুপ। শিবনাথ বিরক্ত হতে গিয়ে তখনই আবার হাসে। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে যায়। রোজ একবারটি করে বুড়িকে শিবনাথের সঠিক বয়স মনে করিয়ে দিতে হয়। শিবুর বয়স জানতে পারলে বুড়ি এক ছুটে নিজের বয়সে চলে যেতে পারে, আ হোঁচট খায় না, হিসাবের গোলমাল হয় না।
কী হলো! কথা বলিস না? বুড়ির মুখের সামনে শিবনাথ লম্বা করে গলাটা বাড়িয়ে দেয়। আমার বয়স জানতে চাইছিস, তার মানে তুই তোর বয়স নিয়ে আবার গোলমালে পড়েছিস_এই তো? তাজ্জব কাণ্ড! যেন আমি বাপ তুই মেয়ে, যেন আমি তোর গভ্ভে জন্মাইনি। তুই যদি তোর বয়স ভুলে থাকিস_আমিও আমার বয়স ভুলে গেছি_কেমন, হলো তো মজা!
যেন শিবনাথ চটে গেছে, এমন একটা ভান করল। তারপর এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বুড়ির মুখটা দেখল। তারপর আবার বলল, অ্যাঁ, আমার আগে তুই পৃথিবীতে এলি। কত মাছ-ভাত দুধ-ভাত খেলি, আম জাম কাঁঠাল কলা, কত চিঁড়েমুড়ি লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু, পৌষ পার্বণের পিঠেপুলি_ওই পেটটার মধ্যে ঢোকালি। বাবা মরল পর থেকে আলোচালের ভাত আর শাকচচ্চড়ি বা কত খেলি, আকাশে কত শতবার চাঁদ দেখলি, রোদ দেখলি_সেই সঙ্গে কুয়াশা! পাখির গান শুনলি এই জীবনে কত, ঝিঁঝির ডাক শুনলি, বর্ষার দিনে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। সব তোর মনে আছে, কেবল বয়সটা মনে থাকে না, হিসাব গুলিয়ে ফেলিস! তোকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়া গেল।
বুড়ি স্তব্ধ হয়ে থাকে, যেন ভয় পায়। থুঁতনিটা তুলে অসহায় ঘোলা চোখে ঘরের চাল দেখে। তাই তো। এ বড় সাংঘাতিক কথা যে। এত বছর বেঁচে গেল, তার কোনো হিসাব জানল না বুড়ি। হিসাব না জেনে হঠাৎ যদি আজ হার্টফেল করে! চোখ বোজে? এই আফসোস রাখার জায়গা কোথায়।
শিবনাথ মিটিমিটি হাসে। চোখ টেপে আর নিজের মনে বলে, রগড়টা জমেছে ভালো।
শিবনাথ এখন সেই গল্পটা শুনতে চাইছে, যে গল্প শুনে মানুষের আশ মেটে না। জন্মের পর থেকে লক্ষবার শুনেও যে গল্প পুরনো হয় না।
শোন্ বুড়ি! ঘাড় তুলে শিবনাথ সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
এবার সে খিকখিক করে হাসে। হেসে বুড়িকে আশ্বাস দেয়, সান্ত্বনা দেয়। হুঁ, আমি আমার সঠিক বয়স বলতে পারব, যদি তুই ঠিক করে বলতে পারিস আমি সকালে জন্মেছিলাম, নাকি বিকেলে। ভর দুপুরে, নাকি নিশুতি রাতে। জোছনার রাত ছিল, নাকি কাঠফাটা রোদ্দুরের দিন? শীতকাল ছিল! ঝমঝম বর্ষা? নাকি ভয়ানক গরম কাল_কোন্টা?
এবার বুড়ির ধূসর শুকনো চামড়ায় উজ্জ্বলতার ছাপ দেখা দেয়। ঘোলা চোখে একটা চকচকে চমক। রোজই এমন হয়। আজ যেন আরও বেশি পুলক জাগল বুড়ির শরীর মনে।
তা আমি খুব বলতে পারি শিবু। বুড়ি খনখনে গলায় হাসে। সেই সময়টা কি কোনো দিন ভুলব! তোর জন্মদিনের ছবিটা আমার বুকের মধ্যে গেঁথে আছে।
এক মিনিট চোখ বুজে ছবিটা বুঝি আর একবার নিজে নিজে দেখে নেয় বুড়ি। তারপর ছেলের মুখের দিকে মুখটা তুলে ধরে।
শোন, তখন একটা ঘুঘু ডাকছিল, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। আম পেকেছিল, পাকা কাঁঠালের গন্ধে জগৎসংসার ভুরভুর করছিল। লিচু-ফল আগেই পেকে শেষ হয়ে গেছে। জামরুল পাকতে শুরু করেছিল। আর কালো জাম। এক একটা গাছের মাথায় যেন থোকা থোকা মেঘ ঝুলছিল।
ব্যস, এখন মনে পড়েছে, আর বলতে হবে না। শিবনাথ উৎসাহে মাথা ঝাঁকাল। তার মানে জষ্টি মাস ছিল ওটা। পচা ভাদ্দর না, কুয়াশা মরা কার্তিক না। হুঁ, তবে তো ঠিকই আছে_চোখের নিমেষে আঙুলের কর গুনে শিবনাথ বলল, আমার বয়স আজ পর্যন্ত টায় টায় সাতাত্তর, একদিন বেশি না, কমও না। এবার তোরটা ঠিক করে ফেল বেটি।
সোজা অঙ্ক, এখন আর কঠিন কি বাপ। মাড়ি ছড়িয়ে বুড়ি হাসে। তোর বয়সের সঙ্গে পনেরো যোগ কর_টুক করে আমার বয়সটা বেরিয়ে পড়বে।
বুড়ির চোখেমুখে, খড়ি ওঠা গায়ের চামড়ায় হঠাৎ যেন রামধনুর সাতটা রং ঝিকিয়ে ওঠে। শিবনাথ অবাক হয়ে দেখে। বিরানব্বুই বছরের একটা পুরনো শরীরে ঠিক এই সময়টায় সত্যিকার লাবণ্যের মতন কিছু উঁকি দেয়?
হি-গি! বুড়ি তখনো হাসে। বুঝলি শিবু, তোরা বলিস, গরমের ছুটি_ওরা বলত আম-কাঁঠালের ছুটি। সেবার কলেজ ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও দেশের বাড়িতে চলে আসে। আগের বছরও এসেছিল। কিন্তু আগের বারের মজা সেবার আর ছিল না।
কেন! কৌতূহলী চোখে শিবনাথ তাকায়।
হুঁ, বুড়ি ঘাড় নাড়ল, বাড়ির পেছনে মস্ত বাগান। তিন তিনটে জামগাছ। আগের বছর আমিও গাছকোমর বেঁধে ওর সঙ্গে এত উঁচু ডালে উঠে জাম পেড়ে খেয়েছি। সেবার আর পারলাম না। হাঁ করে সারাক্ষণ গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
গাছে চড়তে পারলি না কেন! শিবনাথ ঢোক গিলল।
কী করে পারব বাপ। পেটটা ফুলে তখন জয়ঢাক। আঁচলটা কোমরে জড়াতে গেলেও লাগে। চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়। তারপর?
গাছে চড়ে একা একা ও অনেক জাম পাড়ল। একটাও মুখে দিচ্ছিল না কিন্তু। আমার জন্য মন খারাপ লাগছিল টের পেলাম। ওপর থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে বারবার যেমন করে আমায় দেখছিল।
হুঁ, তোকে দেখছিল, তারপর? শিবনাথ ভুরু কুঁচকোয়।
একটু পরে এত জাম নিয়ে গাছ থেকে নেমে এসে ও সব আমার কোঁচড়ে ঢেলে দিল।
শিবনাথ একগাল হাসল। তখন বুঝি নুন-লঙ্কা মাখিয়ে আরাম করে বসে সব খেলি!
কখন আর খেলাম। রোদ থাকতে থাকতে ব্যথা উঠল। তক্ষণি আঁতুড়ে ঢুকলাম। একটু পরে তুই ট্যাঁ করে উঠলি।
তখন শিবনাথ চিন্তা করে, কথাটা মিথ্যা কি। অনেক শব্দ হয়েছে এ বাড়িতে, কত শোরগোল কানে এসেছে। এখন সব চুপ। যেন অনেক পাখি এলো, সারা দিন গান করল, কিচমিচ শব্দ করল, বিকেল পড়তে, না কি ধিকিধিকি বেলা থাকতেই সব পালিয়ে গেল, উড়ে গেল!
যেমন_এই উঠোনের আনাচকানাচে। কতবার কত রকম গাছ গজিয়েছে, ফুল দিয়েছে, কিছু কিছু ফল ফলেছে। এরপর সব শুকিয়ে মরেহেজে একাকার। এখন ফল ফুল গাছের চিহ্নও নেই। খাঁ খাঁ করছে চারদিক।
হুঁ, কত শব্দ ছিল, বুড়ি বিড়বিড় করে, উলুর শব্দ, শাঁখের ফুঁ, ঢাকের বাদ্যি, আঁতুড়ের ট্যাঁট্যাঁ, অন্নপ্রাশনের রান্নার ঘটর ঘটর আওয়াজ, আত্মীয়কুটুমের আনাগোনা, হৈচৈ, হাঁচিকাশি_এই বৈশাখে অন্নপ্রাশন গেছে, আর এক ফাগুনে আবার এই উঠোনে সানাইয়ের পোঁ পোঁ, উলু, শাঁখের ফুঁয়ে কান ঝালাপাল_
তারপর! থামলি কেন, বলে যা। বারান্দায় বসে শিবনাথ বুড়ির বিড়বিড় শোনে। শাঁখের ফুঁয়ে কান ঝালাপালা, তার মানে আর একটা বিয়ে, ন' মাস না পেরোতে আবার আঁতুড়ের ট্যাঁট্যাঁ, আত্মীয়কুটুমের আনাগোনা, মুখে-ভাতের রান্নার ঘটর ঘটর আওয়াজ। শিবনাথ ভেংচি কাটে। তারপর?
বুড়ি চুপ।
শিবনাথ চুপ থাকে না। চেঁচিয়ে বলে, ঘুরে ঘুরে বিয়ে শুনলি, বউ-ভাতের খাওয়া শুনলি, আঁতুড়ের ট্যাঁট্যাঁ কানে এলো_আর ওই যে বড় আওয়াজটা_বলো হরি হরিবোল এই উঠোনে কবার শুনলি, কতবার কান ঝালাপালা হয়েছে তোর শুনি?
যেন এবার বুড়ি মিইয়ে যায়, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। টের পেয়ে দাওয়ায় বসে শিবনাথ ফ্যাফ্যা করে হাসে। তারপর চৌকাঠের ওদিকে গলাটা বাড়িয়ে দেয়। বুড়িকে দেখে। আর কথা বলছিস না কেন বেটি, হুঁ? শিবনাথ খোঁচা দেয়।
কী বলব রে বাপ। মানুষ কি মানুষকে ধরে রাখতে পারে? কাতর গলায় বুড়ি জবাব দেয়।
না তা পারবে কেন। তবে তো আমি আমার বাবাকে ধরে রাখতাম, ছোট ভাইটাকে ধরে রাখতাম, তুই তোর ছেলের বউকে ধরে রাখতে পারতিস, নাতি দুটোকে ধরে রাখতিস, সেই সঙ্গে তোর মেয়ে গঙ্গাকে, ওর বাচ্চাটাকে_আমাদের কত আগে সব পালিয়ে গেল...
বলতে গিয়ে শিবনাথের গায়ে কাঁটা দেয়। আর হাসে না সে, বুড়ি কথা বলে না। বুড়ির এই চুপ করে থাকাটা শিবনাথের অসহ্য। কী হলো! কী বলছি তোকে, উত্তর দে।
যেন বুড়ি কাঁদে। নাকের ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হয়।
এই দ্যাখো! শিবনাথ ধমক লাগায়। কান্নাকাটির হিড়িক পড়ে গেল। একটা আলোচনা হচ্ছে, অমনি ফ্যাচফ্যাচ শুরু_অ মা!
কী বলব বল্! ধরা গলায় বুড়ি বলে ওরা সগ্গে গেছে, ভগবানের কোলে ঠাঁই নিয়েছে।
যা বলেছিস। শিবনাথ এবার জোরে জোরে হাসে যেন বুড়ির সঙ্গে সে রগড় করে। হুঁ ভগবানের কোলে ঠাঁই নিতে সব চলে গেছে, আর তোকে রেখে গেছে এই খালি উঠোন পাহারা দিতে, তাই না?
একটু থেমে থেকে আবার সে বলে, তা উঠোন তো একেবারে খালি হয়নি, এখনো তোর গভ্ভের একটা শত্তুর রয়ে গেছে। আর ওটা সারা দিন কী করছে, কী খাচ্ছে, তোর চোখ-কান পড়ে আছে সেদিকে। মিছা বললাম!
হুঁ, চোখ, সারা দিন চোখ পড়ে আছে তোর দিকে। এবার বুড়ির অভিমানের গলা শোনা গেল। চোখের আমার কিছু আছে কি না_সারা দিন তুই কী করিস, কী খাস আমি কেবল তাকিয়ে দেখি।
নাকের ফ্যাচফ্যাচ শব্দ করে আবার বুঝি বুড়ির কান্না শুরু হয়।
এই দ্যাখো! বাইরে থেকে শিবনাথ গলা ঝাঁকায়। তবে চল না একদিন হাসপাতালে নিয়ে যাই, চোখের ছানি কাটিয়ে আনি। তারপর নতুন চশমা নিবি_
ঠাট্টা করিসনে। নাকের কান্না থেমে যায় বুড়ির। চোখ কাটানোর বয়স আছে কি না আমার, নতুন করে চশমা নেব! যেন বাচ্চা খুকি আমি_কথা দিয়ে ভোলাচ্ছিস।
এই দ্যাখো, কথা দিয়ে ভোলানোর কী আছে, কে বলেছে তোর চশমা নেওয়ার বয়স নেই? শিবনাথ গুজগুজ করে হাসে। আমি দেখছি তোর যৌবন ফিরে আসছে। তোর বয়স এখন বায় কি তেয়_
বুড়ি একেবারে চুপ। কেবল অভিমান না, এবার বেটি রাগ করেছে টের পেয়ে শিবনাথ উঠে দাঁড়ায়।
অ মা! আদর করে ডাকে সে। জামরুল খাবি? বলছিলি কচমচ শব্দ শুনছিলি_আমি খাচ্ছি যে_
অ্যাঁ, জামরুল! নিমেষের মধ্যে বুড়ির রাগ-অভিমান কর্পূরের মতো উড়ে যায়। যেন পাঁচ বছরের খুকির মতন আহ্লাদে নেচে ওঠে। শিবনাথ তাই চাইছিল। এ জন্যেই এত রগড়।_জামরুল বললি, না কি গোলাপজাম? শিবু! বুড়ি অস্থির হয়ে ঘরের ভেতর থেকে ডাকে।
এই দ্যাখো! বাইরে থেকে শিবনাথ চেঁচায়। সাধে কী বলি যত দিন যাচ্ছে, সব গুলিয়ে ফেলছিস তুই। কেবল কী চোখ গেছে, কানের মাথাটিও খাওয়া হয়ে গেছে অনেক দিন। যেন শিবনাথ খুশি হতে গিয়ে দুঃখ করে। আম বলতে আনারস শুনিস, লিচু বলতে কলা, কলা বলতে কাঁঠাল শুনিস_বলছি জামরুল_উনি শুনছেন গোলাপজাম। তোকে নিয়ে আর পারা যায় না বেটি।
আমায় নিয়ে সত্যি আর পারা যায় না। তাই না বাপ! বুড়ি খুশিতে ডগমগ। তোর এই আড়াই বছরের মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ানক মুশকিলে পড়ে গেছিস। আম, জাম, লিচু, জামরুল, কলা, কাঁঠাল_রাক্ষসী আবার সব জায়গায় সব দেখতে চায়, একসঙ্গে খেতে চায়! কেমন? বুড়ি হি-হি করে হাসে।
মিছা কি! শিবনাথ হাসির আড়ালে গাঢ় নিশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে, দিন ঘনিয়ে এসেছে, যাওয়ার ঘণ্টা বেজে গেছে_তাই সব কিছু খাবার জন্য তোমার জিভ চুকচুক করছে।
তা কে দিলে জামরুল। কিনলি তুই? বুড়ি একটু পরে শুধায়।
না, বাইরে রকে বসেছিলাম, পাড়ার দুটো ছোড়া কোচড় ভরে জামরুল নিয়ে যাচ্ছিল_আমায় দিলে ওরা।
তুই চাইলি বুঝি?
কেন চাইব, ওরা নিজে থেকে দিলে। বলে, কি শিবদাদু তুমি বুড়ো হয়েছ, গাছে চড়তে পার না, এই দ্যাখো নন্দীবাবুদের বাগান থেকে কত জামরুল পেড়ে এনেছি আমরা। নাও, তোমায় দুটো দিলাম_খাও।
বড় ভালো ছেলেরে ওরা।
হুঁ, নন্দীবাবুদের বাগানের জামরুলও ভারি মিষ্টি। শিবনাথ বেশ রস করে বলল।
খা! বুড়ি বলল।
ওই একটা কথাই বলল। কেননা শিবনাথ টের পায়, এই মুহূর্তে একটার বেশি দুটো কথা বলা বুড়ির পক্ষে সম্ভব নয়। মিষ্টি জামরুল শুনে বুড়ির জিভে এত জল এসে গেছে। অবাক কাণ্ড, শিবনাথ চিন্তা করে, যত দিন যাচ্ছে, খাওয়ার নাম শুনলে শুকনো খেজুর-পাতার মতন খসখসে একরতি জিভটা কেমন রসে টইটই করে ওঠে।
কী হলো বেটি! খাবি একটা তুই?
নারে বাপ। তুই খা। আমার কি দাঁত আছে, চিবোব কেমন করে? বলতে বলতে বুড়ির ঠোঁট বেয়ে সত্যি দুই ফোঁটা লালা ঝরে পড়ে। আর একবার চৌকাঠের ওদিকে উঁকি দিতে দৃশ্যটা শিবনাথের চোখে পড়ে। মনে মনে সে হেসে বাঁচে না। তক্ষণি আবার রগড় করে বলে, দাঁত নেই তো হয়েছি কী? কাটারি দিয়ে কুচিয়ে দেব, চুষে খাবি।
বুড়ি মাথা নাড়ে। বড় করে শ্বাস ফেলে।
কী হলো! গলাটা ওদিকে বাড়িয়ে রেখে শিবনাথ বলল, কুচিয়ে দিলে খেতে পারবি না?
অমন করে জামরুল খেয়ে কি সুখ আছে? ছোট মেয়ের মতন বুড়ির গলায় যেন নতুন করে খেদ অভিমান জাগল। যে জিনিস যেমনটি করে খাবার_।
তাই বলো! যে জিনিস যেমন করে খাবার তেমন করে না খেলে_শিবনাথ নিজের মনে চোখ টেপে। হাসে। এখনো বেটির কামড়ে কামড়ে ফল খাবার শখ!
আচ্ছা শিবু! তোর আর কটা দাঁত আছে বাপ? বুড়ি শুধায়।
চারটে।
ওপরের পাটির, নাকি নিচের?
এই দ্যাখো! কেবল একপাটির দাঁত থাকলে যেন জামরুল কামড়ে খাওয়া যায়। শিবনাথ খিচিয়ে ওঠে। সব ভুলে গেছিস বুড়ি। তোর কি কোনো দিন দাঁত ছিল না? আখ-জামরুল কোনো দিন চিবিয়ে খাসনি? ওপরের নিচের দুপাটির দুটো করে দাঁত আছে আমার।
আহা! তুই কত সুখে আছিস, জামরুল-পেয়ারা-আখ সব চিবোতে পারিস_চিঁড়ে, মুড়ি, ছোলাভাজা ও বাদামভাজা। ঝরঝর করে বুড়ির ঠোঁট বেয়ে জল পড়ছিল, শিবনাথ টের পায়। তবু বুড়ির কথা থামছিল না। কাল সন্ধ্যেবেলা দাওয়ায় বসে টুকুসটুকুস করে চিনাবাদাম খেয়েছিলি, তাই না শিবু? আমি শুনেছি।
চুপ চুপ! শিবনাথ এবার ঘরে ঢুকে পড়ল। বুড়িকে ধমক লাগাল। যেন এই জন্মে কোনো দিন চিঁড়ে-মুড়ি-চিনেবাদাম তুই খাসনি, এখনো খাওয়ার আফসোস, হুঁ। আমি সুখে আছি, আমার চারটে দাঁত আছে।
ধমক খেয়ে বুড়ি মিইয়ে যায়। চুপ করে থাকে। তক্তপোষের ময়লা কাঁথার বিছানায় উবু হয়ে বসে আছে প্রাচীন মানুষটা। সব কটা পাকাচুল ঝরে পড়ে ছোট মাথাটা নেড়া হয়ে অবিকল কতবেলের চেহারা ধরেছে। পাকাটির মতন সরু ঠ্যাং ও কাঁকড়ার বাচ্চার মতন শুকনো খুদে খুদে দুটো হাঁটু। হাড় ছাড়া আর কিছু নেই বলে বুড়ির হাঁটুর দিকে তাকালে শিবনাথের এখন দুটো বাচ্চা কাঁকড়ার কথা মনে পড়ে। দুই হাঁটুর মাঝখানে থুঁতনিটা ঝুলিয়ে দিয়েছে বুড়ি।
শিবনাথ আরো দেখল, বুড়ির মাথার ওপর দিয়ে এধারের বেড়া থেকে জাল টেনে একটা মাকড়সা ওপাশের বেড়ার দিকে হেঁটে যেতে চাইছে। কাল দুপুরে ঝাড়ন বুলিয়ে শিবনাথ জালটা ভেঙে দিয়েছিল।
আমি সুখে আছি, এখনো আমার চারটে দাঁত আছে। ইচ্ছে করে শিবনাথ গলায় ঝাঁজ ফুটিয়ে তুলল। যদিও মনে মনে সে হাসে। যেন বুড়িকে চটাতে তার ভালো লাগে। আমি আখ খাই, পেয়ারা খাই, চিঁড়েমুড়ি চিবোই_তাই হিংসেয় তোর পেট ফাটে, তাই না মা!
না রে বাপ, এমন কথা বলিস না। তুই আমার পেটের সন্তান। তোর সুখ দেখলে আমার সুখ।
উঁহু, কক্খনো না। শিবনাথ মাথা নাড়ে। বুড়ির মতন তার মাথার চুল ঝরে পড়েনি, তার সবটা মাথাই এখন সাদা হয়ে গেছে। ভুরু জোড়া সাদা হয়ে গেছে। বুড়ির অবশ্য ভুরুর লোমও উঠে গেছে। ফলে কুঁচকানো কপালে ও ছানিপড়া চোখে লেপালেপি হয়ে গিয়ে সে এক আজব চেহারা ধরেছে মুখটা। সেদিকে চোখ রেখে শিবনাথ আবার একটু রগড় করে। হুঁ, আমি খুব টের পাই, রাত্তিরে আমি রুটি খেয়ে হজম করি_তুই সাবু ভিজিয়ে খাস, তাই তোর ঈর্ষে। রাস্তার কল থেকে এখনো আমি বালতি ভরে জল টেনে আনি_দেখে তোর মন খারাপ...
এ কী বলিস শিবু, অ্যাঁ! বুড়ি প্রায় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। এমন করে তুই আমার মনে দুঃখু দিস, ১০ মাস ১০ দিন তোকে আমি গভ্ভে ধরেছিলাম।
শিবনাথ হাতের বাকি জামরুলটা চিবিয়ে শেষ করল। একটা ঢেঁকুর তুলল। কাঁধের গামছা দিয়ে মুখটা মুছে ফেলল। তারপর কোনা থেকে ঝাড়নটা তুলে নিয়ে আবার মাকড়সার জালটা ভেঙে দিল। তারপর হাত থেকে ঝাড়ন নামিয়ে রেখে কাঁথাটা টেনেটুনে বুড়ির বিছানাটা ঠিক করে দেয়।
এবার বুড়িরও কান্না থামে। অর্থাৎ ছেলে তার পরিচর্যা করছে টের পেয়ে মনে সান্ত্বনা পায়। কিন্তু কান্নার ফোঁপানিটা থেকে যায়। হাড়গোড় বেরোনো পাতলা ছোট শরীরটা তখনো কাঁপে। শিবনাথ একদৃষ্টে চেয়ে দেখে। গায়ে একটা বোতাম, ছেঁড়া ব্লাউজ। স্তন দুটো শুকিয়ে পাঁজরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে, কালো ফুটকি দুটো ছাড়া এখন আর কিছুই চেনা যায় না। মনে হয় আট বছরের একটি মেয়ের লেপাপোছা বুক। এই স্তন টেনে শিবনাথ বড় হয়েছিল, বিশ্বাস করতে কেমন বাধে। রোগা জীর্ণ শরীরে আস্ত একটা থান কাপড়ের বোঝা বইতে পারে না বলে শিবনাথ শুধু একটা সায়া পরিয়ে রেখেছে মানুষটাকে।
কী হলো! কাঁপছিস কেন, শীত করছে বেটি? শিবনাথ তক্তপোষের কাছে ঝুঁকে দাঁড়ায়।
হ্যাঁ বাপ। বাইরে বুঝি ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে?
কোথায় ঠাণ্ডা হাওয়া! সারা দিন খটখটে রোদ ছিল। রোদ পড়ে গিয়ে এখন বিকেল হচ্ছে।
তাই তো ঠাণ্ডা লাগছে। রোজ বিকেল পড়তে আমার কেমন শীত করে শিবু।
কম্বলটা জড়িয়ে দেব?
দে বাপ।
পায়ের কাছ থেকে ভাঁজ করা কম্বলটা তুলে শিবনাথ বুড়ির গায়ে জড়িয়ে দিল।_হয়েছে?
হুঁ, বুড়ি আরাম পায়। হাঁটুর ভাঁজ খুলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে।
তোর কি বিকেল পড়তে শীত করে শিবু? বুড়ি প্রশ্ন করে।
আমার কেন শীত করবে! শিবনাথ হাসে। আমি কি তোর মতন ওই যে বলে লাতুড়ে লেতলেতে বুড়ি হয়ে গেছি। আমি এখনো শক্ত। আমার গায়ের রক্ত এখনো গরম।
বুড়ি চুপ করে থেকে বড় একটা শ্বাস ফেলে।
কী হলো! শিবনাথ গলা চড়িয়ে দেয়। আবার বুঝি মন খারাপ হলো?
কেন মন খারাপ হবে! বুড়ি চমকে ওঠে।
হেঁ, হেঁ, আমি টের পাই। তোর শিবু এখনো শক্ত আছে। তার রক্ত গরম। তার শীত করে না। তোর মতন অচল হয়ে সে বিছানা নেয়নি_
ষাট ষাট! কেন বিছানা নিবি। তুই যে আমার জোয়ান ছেলে। আমার কাছে তুই আজও ছটফটে ১০ বছরের খোকা।
বটে! ঘরের চালে টিকটিকি ডাকে। শিবনাথ আবার গলা ছেড়ে হাসে। এটা জবর বলেছিস বুড়ি। তোর শিবু এখনো ১০ বছরের খোকা থেকে গেছে। কথাটা শেষ করে শিবনাথ মনে মনে বলে, ভাগ্যিস তোর দুই চোখে ছানি পড়েছে বুড়ি। না হলে দেখতে পেতিস তোর ১০ বছরের খোকার ভুরু ও মাথার চুল রসুনের রং ধরেছে, কোমর বেঁকে গেছে, আজ পর্যন্ত ২৮টা দাঁত পড়ল আর যেহেতু তোর গর্ভের সন্তান, তারও একটা চোখে ছানি দেখা দিয়েছে।
আচ্ছা শিবু, তোর সঠিক বয়সটা জানি এখন কত বাবা! দুম করে বুড়ি প্রশ্ন করল। শিবনাথ যা আশঙ্কা করছিল। এইমাত্র সে লক্ষ্য করেছে, আঙুলের কড় গুনে বুড়ি নিজের বয়সের হিসাব বার করতে লেগে গেছে। যেন কিছুতেই হিসাবটা ঠিক রাখতে পারে না। গুলিয়ে ফেলছে!
কেন, তুই তো বললি আমি তোর ১০ বছরের খোকা। ভেংচি কাটার মতন চেহারা করল শিবনাথ। বলিসনি এই মাত্তর?
বুড়ি চুপ। শিবনাথ বিরক্ত হতে গিয়ে তখনই আবার হাসে। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে যায়। রোজ একবারটি করে বুড়িকে শিবনাথের সঠিক বয়স মনে করিয়ে দিতে হয়। শিবুর বয়স জানতে পারলে বুড়ি এক ছুটে নিজের বয়সে চলে যেতে পারে, আ হোঁচট খায় না, হিসাবের গোলমাল হয় না।
কী হলো! কথা বলিস না? বুড়ির মুখের সামনে শিবনাথ লম্বা করে গলাটা বাড়িয়ে দেয়। আমার বয়স জানতে চাইছিস, তার মানে তুই তোর বয়স নিয়ে আবার গোলমালে পড়েছিস_এই তো? তাজ্জব কাণ্ড! যেন আমি বাপ তুই মেয়ে, যেন আমি তোর গভ্ভে জন্মাইনি। তুই যদি তোর বয়স ভুলে থাকিস_আমিও আমার বয়স ভুলে গেছি_কেমন, হলো তো মজা!
যেন শিবনাথ চটে গেছে, এমন একটা ভান করল। তারপর এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বুড়ির মুখটা দেখল। তারপর আবার বলল, অ্যাঁ, আমার আগে তুই পৃথিবীতে এলি। কত মাছ-ভাত দুধ-ভাত খেলি, আম জাম কাঁঠাল কলা, কত চিঁড়েমুড়ি লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু, পৌষ পার্বণের পিঠেপুলি_ওই পেটটার মধ্যে ঢোকালি। বাবা মরল পর থেকে আলোচালের ভাত আর শাকচচ্চড়ি বা কত খেলি, আকাশে কত শতবার চাঁদ দেখলি, রোদ দেখলি_সেই সঙ্গে কুয়াশা! পাখির গান শুনলি এই জীবনে কত, ঝিঁঝির ডাক শুনলি, বর্ষার দিনে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। সব তোর মনে আছে, কেবল বয়সটা মনে থাকে না, হিসাব গুলিয়ে ফেলিস! তোকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়া গেল।
বুড়ি স্তব্ধ হয়ে থাকে, যেন ভয় পায়। থুঁতনিটা তুলে অসহায় ঘোলা চোখে ঘরের চাল দেখে। তাই তো। এ বড় সাংঘাতিক কথা যে। এত বছর বেঁচে গেল, তার কোনো হিসাব জানল না বুড়ি। হিসাব না জেনে হঠাৎ যদি আজ হার্টফেল করে! চোখ বোজে? এই আফসোস রাখার জায়গা কোথায়।
শিবনাথ মিটিমিটি হাসে। চোখ টেপে আর নিজের মনে বলে, রগড়টা জমেছে ভালো।
শিবনাথ এখন সেই গল্পটা শুনতে চাইছে, যে গল্প শুনে মানুষের আশ মেটে না। জন্মের পর থেকে লক্ষবার শুনেও যে গল্প পুরনো হয় না।
শোন্ বুড়ি! ঘাড় তুলে শিবনাথ সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
এবার সে খিকখিক করে হাসে। হেসে বুড়িকে আশ্বাস দেয়, সান্ত্বনা দেয়। হুঁ, আমি আমার সঠিক বয়স বলতে পারব, যদি তুই ঠিক করে বলতে পারিস আমি সকালে জন্মেছিলাম, নাকি বিকেলে। ভর দুপুরে, নাকি নিশুতি রাতে। জোছনার রাত ছিল, নাকি কাঠফাটা রোদ্দুরের দিন? শীতকাল ছিল! ঝমঝম বর্ষা? নাকি ভয়ানক গরম কাল_কোন্টা?
এবার বুড়ির ধূসর শুকনো চামড়ায় উজ্জ্বলতার ছাপ দেখা দেয়। ঘোলা চোখে একটা চকচকে চমক। রোজই এমন হয়। আজ যেন আরও বেশি পুলক জাগল বুড়ির শরীর মনে।
তা আমি খুব বলতে পারি শিবু। বুড়ি খনখনে গলায় হাসে। সেই সময়টা কি কোনো দিন ভুলব! তোর জন্মদিনের ছবিটা আমার বুকের মধ্যে গেঁথে আছে।
এক মিনিট চোখ বুজে ছবিটা বুঝি আর একবার নিজে নিজে দেখে নেয় বুড়ি। তারপর ছেলের মুখের দিকে মুখটা তুলে ধরে।
শোন, তখন একটা ঘুঘু ডাকছিল, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। আম পেকেছিল, পাকা কাঁঠালের গন্ধে জগৎসংসার ভুরভুর করছিল। লিচু-ফল আগেই পেকে শেষ হয়ে গেছে। জামরুল পাকতে শুরু করেছিল। আর কালো জাম। এক একটা গাছের মাথায় যেন থোকা থোকা মেঘ ঝুলছিল।
ব্যস, এখন মনে পড়েছে, আর বলতে হবে না। শিবনাথ উৎসাহে মাথা ঝাঁকাল। তার মানে জষ্টি মাস ছিল ওটা। পচা ভাদ্দর না, কুয়াশা মরা কার্তিক না। হুঁ, তবে তো ঠিকই আছে_চোখের নিমেষে আঙুলের কর গুনে শিবনাথ বলল, আমার বয়স আজ পর্যন্ত টায় টায় সাতাত্তর, একদিন বেশি না, কমও না। এবার তোরটা ঠিক করে ফেল বেটি।
সোজা অঙ্ক, এখন আর কঠিন কি বাপ। মাড়ি ছড়িয়ে বুড়ি হাসে। তোর বয়সের সঙ্গে পনেরো যোগ কর_টুক করে আমার বয়সটা বেরিয়ে পড়বে।
বুড়ির চোখেমুখে, খড়ি ওঠা গায়ের চামড়ায় হঠাৎ যেন রামধনুর সাতটা রং ঝিকিয়ে ওঠে। শিবনাথ অবাক হয়ে দেখে। বিরানব্বুই বছরের একটা পুরনো শরীরে ঠিক এই সময়টায় সত্যিকার লাবণ্যের মতন কিছু উঁকি দেয়?
হি-গি! বুড়ি তখনো হাসে। বুঝলি শিবু, তোরা বলিস, গরমের ছুটি_ওরা বলত আম-কাঁঠালের ছুটি। সেবার কলেজ ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও দেশের বাড়িতে চলে আসে। আগের বছরও এসেছিল। কিন্তু আগের বারের মজা সেবার আর ছিল না।
কেন! কৌতূহলী চোখে শিবনাথ তাকায়।
হুঁ, বুড়ি ঘাড় নাড়ল, বাড়ির পেছনে মস্ত বাগান। তিন তিনটে জামগাছ। আগের বছর আমিও গাছকোমর বেঁধে ওর সঙ্গে এত উঁচু ডালে উঠে জাম পেড়ে খেয়েছি। সেবার আর পারলাম না। হাঁ করে সারাক্ষণ গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
গাছে চড়তে পারলি না কেন! শিবনাথ ঢোক গিলল।
কী করে পারব বাপ। পেটটা ফুলে তখন জয়ঢাক। আঁচলটা কোমরে জড়াতে গেলেও লাগে। চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়। তারপর?
গাছে চড়ে একা একা ও অনেক জাম পাড়ল। একটাও মুখে দিচ্ছিল না কিন্তু। আমার জন্য মন খারাপ লাগছিল টের পেলাম। ওপর থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে বারবার যেমন করে আমায় দেখছিল।
হুঁ, তোকে দেখছিল, তারপর? শিবনাথ ভুরু কুঁচকোয়।
একটু পরে এত জাম নিয়ে গাছ থেকে নেমে এসে ও সব আমার কোঁচড়ে ঢেলে দিল।
শিবনাথ একগাল হাসল। তখন বুঝি নুন-লঙ্কা মাখিয়ে আরাম করে বসে সব খেলি!
কখন আর খেলাম। রোদ থাকতে থাকতে ব্যথা উঠল। তক্ষণি আঁতুড়ে ঢুকলাম। একটু পরে তুই ট্যাঁ করে উঠলি।
No comments