জেল হত্যাকাণ্ডের পেছনে by মাহমুদুল বাসার
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ড ছিল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় পর্ব। এটা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি, অগণতান্ত্রিক এবং অমানবিক।
আইন হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা কারোরই নেই, বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যায় না; অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একবার, ৩ নভেম্বর আরেকবার আইনের শাসন পদদলিত করা হলো, আইন হাতে তুলে নেওয়া হলো।
১৫ আগস্টের হত্যাকারীরাই জেলহত্যার সঙ্গে জড়িত। কর্নেল হামিদ 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা' বইয়ে বলেছেন, ১৫ আগস্ট সকালে ডালিম, ফারুক, রশীদদের ঔদ্ধত্য ছিল সীমাহীন। কাউকেই ওরা তোয়াক্কা করছিল না। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। ওদের চোখ ছিল ১৯৭১-এর গণহত্যাকারীদের মতো। জেলহত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা যখন ঘটে, তখন মোশতাক রাষ্ট্রপতি আর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান। এই হত্যাকাণ্ডের দায় তাদের ওপর বর্তায়। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগেই জিয়া-মোশতাক দু'জনই মৃত্যুবরণ করেন। যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাদের হয়তো আইনের কাঠগড়ায় আসতে হতো।
একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ নভেম্বর রাতে জেলহত্যার ঘটনা ঘটে। পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় আসার সংবাদ শুনে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে মোশতাকের সিগন্যাল অনুসারে কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে নিমিষের মধ্যে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ড সেনা অভ্যন্তরের মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসাররা মেনে নিতে পারেননি। ডালিম-ফারুক-রশীদদের ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া অসহ্য হয়ে উঠছিল। সেনা অভ্যন্তরে ধূমায়িত অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুরাগীদের পক্ষ থেকেও ধীরে ধীরে প্রতিবাদ গড়ে উঠছিল। কারণ, জিয়া-মোশতাক হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে জেলে ঢুকিয়ে নির্যাতন করতে থাকেন, যাতে আওয়ামী লীগের নামগন্ধ না থাকে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রদ্রোহ, পাকিস্তানের দালালি এবং স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসবাদ, নাশকতা, গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও মেজর চক্র তাদের পাইকারি হারে মুক্তি দেয়। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও উগ্র বামপন্থিদের শুরু হয় উদগ্র আস্ফালন। আবার বাংলাদেশের দিকে ধূমায়িত হয়ে উঠতে থাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে মোশতাক আহমদ চক্রের চলতে থাকে দেনদরবার। এসব দেনদরবারে আলোচিত হয়_ ১. বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে কনফেডারেশন গঠন; ২. বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা; ৩. বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পরিবর্তন এবং ৪. বাঙালি ও পাকিস্তানিদের ডাবল নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্ন। (ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া_ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃ. ২৫৫)
সে সময়ে গুজব রটানো হয়েছিল যে, ভারতের সাহায্যে এই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক চার নেতাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য। এই গুজবকে গুরুত্ব দিয়ে জিয়া-মোশতাক ঠাণ্ডা মাথায় খুনিদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেন জাতীয় নেতাদের হত্যা করতে।
জেলখানায় যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা জাতির কৃতী সন্তান। ১৯৭১ সালে তারাই মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। বাংলাদেশ স্বাধীন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন, এই সাধ পূর্ণ করার পেছনে জাতীয় চার নেতার অসামান্য পরিশ্রম কাজ করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক গণসংগঠন গড়ে তোলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছেন, জেল খেটেছেন, নির্যাতন-জুলুম সহ্য করেছেন। স্বাধীনতার পক্ষে বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন।
খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। মুজিবনগরে তাজউদ্দীন এবং মোশতাকের আলাদা আলাদা দফতর ছিল। মোশতাকের দফতরে জিয়াউর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তারা গোপনে গোপনে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের আইএসআইর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। মুজিবনগরে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত চার নেতা মোশতাক-জিয়ার চক্রান্ত দক্ষতার সঙ্গে বানচাল করে দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই চক্রান্ত ধারালোভাবে অব্যাহত থাকে। মুজিবনগর চক্রান্তেরই পরিণতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর।
একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবক্তা হওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়; যাতে এ দেশকে পাকিস্তানের আদলে একটি ধর্মোন্মাদ রাষ্ট্র বানানো যায়। আর এ কাজটি করতে গিয়ে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার লক্ষ্যে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক ও গবেষক
১৫ আগস্টের হত্যাকারীরাই জেলহত্যার সঙ্গে জড়িত। কর্নেল হামিদ 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা' বইয়ে বলেছেন, ১৫ আগস্ট সকালে ডালিম, ফারুক, রশীদদের ঔদ্ধত্য ছিল সীমাহীন। কাউকেই ওরা তোয়াক্কা করছিল না। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। ওদের চোখ ছিল ১৯৭১-এর গণহত্যাকারীদের মতো। জেলহত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা যখন ঘটে, তখন মোশতাক রাষ্ট্রপতি আর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান। এই হত্যাকাণ্ডের দায় তাদের ওপর বর্তায়। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগেই জিয়া-মোশতাক দু'জনই মৃত্যুবরণ করেন। যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাদের হয়তো আইনের কাঠগড়ায় আসতে হতো।
একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ নভেম্বর রাতে জেলহত্যার ঘটনা ঘটে। পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় আসার সংবাদ শুনে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে মোশতাকের সিগন্যাল অনুসারে কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে নিমিষের মধ্যে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ড সেনা অভ্যন্তরের মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসাররা মেনে নিতে পারেননি। ডালিম-ফারুক-রশীদদের ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া অসহ্য হয়ে উঠছিল। সেনা অভ্যন্তরে ধূমায়িত অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুরাগীদের পক্ষ থেকেও ধীরে ধীরে প্রতিবাদ গড়ে উঠছিল। কারণ, জিয়া-মোশতাক হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে জেলে ঢুকিয়ে নির্যাতন করতে থাকেন, যাতে আওয়ামী লীগের নামগন্ধ না থাকে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রদ্রোহ, পাকিস্তানের দালালি এবং স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসবাদ, নাশকতা, গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও মেজর চক্র তাদের পাইকারি হারে মুক্তি দেয়। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও উগ্র বামপন্থিদের শুরু হয় উদগ্র আস্ফালন। আবার বাংলাদেশের দিকে ধূমায়িত হয়ে উঠতে থাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে মোশতাক আহমদ চক্রের চলতে থাকে দেনদরবার। এসব দেনদরবারে আলোচিত হয়_ ১. বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে কনফেডারেশন গঠন; ২. বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা; ৩. বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পরিবর্তন এবং ৪. বাঙালি ও পাকিস্তানিদের ডাবল নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্ন। (ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া_ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃ. ২৫৫)
সে সময়ে গুজব রটানো হয়েছিল যে, ভারতের সাহায্যে এই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক চার নেতাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য। এই গুজবকে গুরুত্ব দিয়ে জিয়া-মোশতাক ঠাণ্ডা মাথায় খুনিদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেন জাতীয় নেতাদের হত্যা করতে।
জেলখানায় যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা জাতির কৃতী সন্তান। ১৯৭১ সালে তারাই মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। বাংলাদেশ স্বাধীন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন, এই সাধ পূর্ণ করার পেছনে জাতীয় চার নেতার অসামান্য পরিশ্রম কাজ করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক গণসংগঠন গড়ে তোলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছেন, জেল খেটেছেন, নির্যাতন-জুলুম সহ্য করেছেন। স্বাধীনতার পক্ষে বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন।
খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। মুজিবনগরে তাজউদ্দীন এবং মোশতাকের আলাদা আলাদা দফতর ছিল। মোশতাকের দফতরে জিয়াউর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তারা গোপনে গোপনে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের আইএসআইর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। মুজিবনগরে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত চার নেতা মোশতাক-জিয়ার চক্রান্ত দক্ষতার সঙ্গে বানচাল করে দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই চক্রান্ত ধারালোভাবে অব্যাহত থাকে। মুজিবনগর চক্রান্তেরই পরিণতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর।
একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবক্তা হওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়; যাতে এ দেশকে পাকিস্তানের আদলে একটি ধর্মোন্মাদ রাষ্ট্র বানানো যায়। আর এ কাজটি করতে গিয়ে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার লক্ষ্যে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক ও গবেষক
No comments