কোরবানির পশুর চামড়া- আন্তর্জাতিক বাজারের মন্দা কি তবে অজুহাত? by মোহাম্মদ হেলাল

কোরবানির পশুর চামড়ার দর নিয়ে বিতর্ক এবারের ঈদেও দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার কারণে আগে থেকে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেননি ট্যানারি মালিকেরা।


ট্যানারি মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চামড়া কিনতে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যতটা সম্ভব কম দামে চামড়া কিনতে বলেছিলেন। ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কমে কিনেছেন চামড়া সংগ্রহকারী ফড়িয়া ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছে যে তাঁরা অর্থাৎ ট্যানারি মালিকেরা ২০০৮ সালের পর থেকে প্রতিটি কোরবানি মৌসুমে একই পন্থা অবলম্বন করে কম দামে চামড়া কিনছেন। এভাবে কম দাম বজায় রাখায় প্রতিবেশী দেশে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছে কোনো কোনো মহল থেকে। এখন প্রশ্ন হলো, আসল ঘটনা কী? আগেভাগে দর নির্ধারণ না করায় লাভবান হচ্ছে কারা আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা? ট্যানারি মালিকেরা কম দামে চামড়া কেনার কৌশল হিসেবে এই পন্থা অবলম্বন করছেন? নাকি তাঁরা যা বলছেন এবং করছেন, তা-ই ঠিক এবং সবার স্বার্থে তা-ই করা উচিত?
প্রচলিত অর্থে বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা আর সরবরাহের ভিত্তিতে দর ঠিক হয়। কিন্তু এখানে সেভাবে হচ্ছে না। এখানে ট্যানারি মালিকদের সমিতি দর নির্ধারণ করছে। ফলে তারা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং তাদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই চামড়ার দর নির্ধারণ করার কথা। তারা সেটা করতে পারবে এই কারণে যে, তারা না কিনলে বিকল্প কোনো ক্রেতা নেই এখানে। একমাত্র বিকল্প হলো প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়ে যাওয়া। তাই সেটা যেন সম্ভব না হয় সেই ব্যাপারে ট্যানারি মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা কথা বলছেন। কিন্তু সঠিক দামে ট্যানারিগুলো চামড়া কিনলে তা পাচার হয়ে যাওয়ার কোনো অর্থনৈতিক কারণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়া, চামড়াজাত পণ্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল ও ভারত। কাঁচা চামড়া পাচার হয়ে গেলে তা ভারতে যাবে। ভারতের ব্যবসায়ীরা কি করে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া কাঁচা চামড়া ব্যবহার করে লাভবান হবে? তারা একই বিশ্ববাজারে তা বিক্রি করবে। লাভবান হওয়া সম্ভব তখনই, যখন বাংলাদেশের বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম যৌক্তিক লেভেলের চেয়ে অনেক কম। এতটাই কম যে পাচার করতে যে খরচ লাগে তা বাদ দিয়েও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব। অন্যথায় কাঁচা চামড়া পাচার হবে না।
কোনো একটা শিল্প তার প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম নিজেই নির্ধারণ করে দিলে ওই কাঁচামালের দাম তো যৌক্তিক লেভেলের নিচে থাকবেই। যেমনটি ঘটছে ট্যানারি মালিক সমিতির তাদের শিল্পের কাঁচামাল কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে। শিল্প তার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কী দামে কিনবে, তা নিজেই ঠিক করে দেবে—এটা কি করে সম্ভব? অর্থনীতির কোনো নিয়মই তা সমর্থন করে না। এটা আসলে তথাকথিত ‘সিন্ডিকেট’। দর নির্ধারণ ঈদের আগে কিংবা পরে যখনই হোক না কেন। এখন ভাবা দরকার, চামড়া সরবরাহ চেইনের সবার স্বার্থে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, কী করণীয় আছে সরকারের দিক থেকে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের ট্যানারি মালিকদের সমিতির দাবিগুলোকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে সর্বাগ্রে।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রথম আলোকে (২০ অক্টোবর, ২০১২) বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে চামড়ার মূল্যের দরপতন হচ্ছে, তাতে করে বেশি দামে চামড়া কেনার সুযোগ নেই। এমনিতেই আমাদের চামড়ার কার্যাদেশ কমে যাচ্ছে। বিক্রি করতে না পারায় ট্যানারিগুলোতে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার চামড়া পড়ে আছে। এ অবস্থায় যে দামে কেনা হয়েছে তা ঠিকই আছে।’ সভাপতি একই সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে (২০ অক্টোবর, ২০১২) বলেছিলেন যে গত দুই মাসে রপ্তানি অনেক কমে গেছে। তিনি আরও বলেছিলেন যে দুই মাস আগে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ২.৩০ ডলার থেকে ২.৫০ ডলার। বর্তমানে তা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭০ ডলার থেকে ১.৯০ ডলারে। আমি উল্লিখিত পরিসংখ্যান ও তথ্যের সত্যতাকে প্রশ্ন করছি না। তবে একেবারে হুবহু একই কথা আমরা শুনেছিলাম গত বছরের কোরবানিতে। ‘আবার বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত দুই মাস ধরে চামড়ার দাম কমছে। দুই মাস আগে দেশের ব্যবসায়ীরা প্রতি বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়া দুই ডলার ২০ সেন্টে বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন এর দর নেমে গেছে এক ডলার ৮০ সেন্ট থেকে এক ডলার ৯০ সেন্টে (প্রথম আলো, নভেম্বর ৫, ২০১১)।’ প্রথম আলো একই সংখ্যায় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) কোরবানির ঈদের আগের দুই মাসে বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ (অর্ডার) কমে যাওয়ার দাবি করেছিল। তাদের এই দাবিসমূহ কিন্তু এই ঈদে কম দামে চামড়া কেনার পক্ষে কোনো যুক্তি দেয় না।
ট্যানারি মালিক সমিতির দাবি অনুযায়ী গত দুই কোরবানির ঈদের সময়ই প্রতি বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়ার দাম কমে দুই ডলারের একটু নিচে নেমে এসেছিল। দুই ঈদের বিশ্ববাজারে প্রতি বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়ার দাম একই থাকা সত্ত্বেও এই ঈদে প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কমে কেনার ব্যাখ্যা কী? উপরন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ডলারের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে এই দুই ঈদের মধ্যখানে। সেই হিসাবে বিশ্ববাজারের দাম একই থাকলেও গত বছরের তুলনায় এখন আরও বেশি দামে কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে পারার কথা। তা হলে এ বছর কেন আরও অনেক কম দামে কিনতে হলো কোরবানির পশুর চামড়া? ট্যানারি মালিকেরা যতই লোকসানের দাবি করুক না কেন, বাস্তবে অনেকটা লাভজনকভাবেই তাঁরা চালাচ্ছেন এই ব্যবসা। তা না হলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ৩৭ কোটি ৯০ লাখ ডলারের চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে পরের বছরেই ৪৫ কোটি ডলারে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে এবং সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারে দাঁড়াত না। সাধারণত কোনো একটা শিল্পের প্রসারতা বাড়ে যখন ওই শিল্পভুক্ত ফার্মগুলো লাভজনকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে।
তার পরও যদি আমরা যুক্তির খাতিরে ধরে নিই যে এবার কোরবানির পশুর চামড়া কম দামে কিনতে হবে, তা হলে সেই দাম আগেভাগে বলে দিলে সমস্যা কী? ট্যানারি মালিকেরাসহ সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন যে, তারা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চামড়া কিনতে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এটা কীভাবে আমরা আশা করব যে চামড়া সংগ্রহকারী ফড়িয়া ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চামড়া কিনতে পারবেন? ব্যাখ্যা একটাই হতে পারে তা হলো, আগেভাগে নির্ধারিত দর খুব কম হলে চামড়া প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে পারে। কিন্তু একবার দেশের ভেতরে চামড়ার আড়তে এগুলো পৌঁছে গেলে দর কম হলেও পাচারের পরিমাণ কমে যাবে। আরেকটা ব্যাখ্যা হতে পারে কী পরিমাণ পশু জবাই হয় তা দেখে দর নির্ধারণ করা। তাতে করে জবাই বেশি হলে অনেক কম দামে কিনতে পারবে। কিন্তু আগেভাগে দর ঘোষণা দিলে তা করা সম্ভব নয়।
আমরা চাই বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ুক। প্রসার হোক এই খাত। দেশ অর্জন করুক প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা। তবে রপ্তানি আয়ের ন্যায্য হিস্যা সরবরাহ চেইনের সবাই পাবে—এটাও প্রত্যাশিত। আর এই ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হলে কোনোভাবেই কাঁচা চামড়ার দর নির্ধারণের ভার ট্যানারি মালিকদের সমিতির ওপর দেওয়া যাবে না। এই দায়িত্ব নিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে। যেমনটি সরকার করে থাকে তেল কিংবা চিনির বাজারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেল ও চিনির দাম, পরিশোধন ও অন্যান্য খরচাদি পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল ও চিনির দাম ঠিক করে দেয়। তারা সেই ক্ষেত্রে খুব সফল হয়েছে, তা বলব না। সেখানে অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। তবে একই মডেলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল পর্যবেক্ষণ করবে বিশ্ববাজারে প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়ার দাম, প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি। তারপর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বসে কথা বলে কাঁচা চামড়ার একটা যৌক্তিক দর নির্ধারণ করে দেবে ঈদের আগেই। তা সম্ভব না হলে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত চামড়ার দাম। অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম থাকলে বিদেশের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে চামড়া কিনে নিয়ে যাবে। আমাদের ট্যানারি মালিকেরাও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া কিনবেন।
মোহাম্মদ হেলাল: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: helalum@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.