শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন- প্রান্তিক মায়ের প্রান্তিক শিশুরা by কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছরে তাঁর জন্ম। দরিদ্রঘরে শৈশবের বড় স্মৃতি তাঁর ক্ষুধার। খেতে বসার আগে সৎমা বলতেন প্যান্টের রশি কষে বাঁধতে, যাতে বেশি খাওয়া না যায়। কাজ করতে হতো অনেক। জুটত মারধর।
একদিন সৎমা খুব মারলে মিরপুরের বাস্তুহারা বসতি থেকে পালিয়ে বাসে চেপে বসেছিলেন হাজেরা বেগম। তাঁর বয়স তখন আট কি নয়।
বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিল শিশু হাজেরা। ঘুম ভাঙতে দেখে, ফাঁকা বাস থেমে রয়েছে। জায়গাটা গুলিস্তান। সেখানে পথবাসী শিশুদের একটি দলের সঙ্গে শুরু হয় তার রাজপথের জীবন।
সে জীবন শিশুটিকে ভিড়িয়েছিল পকেটমারদের দলে। মাঝেমধ্যেই পুলিশের ‘ধরাগাড়ি’ নিয়ে যেত সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে, যেখানকার অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। পালিয়ে আবার পথে ওঠা। ভেসে বেড়ানোর সেই শৈশবে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হতে হাজেরাকে হয়ে যেতে হয় যৌনকর্মী।
নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ-এর এইচআইভি-এইডস নিরোধ কার্যক্রমের সুবাদে গঠিত হয় ঢাকার পথ-যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘ। হাজেরা সংগঠনের কাজে নামেন। ২০০৪ নাগাদ দুর্জয় পথ-যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য একটি শিশুনিবাস খুললে সেটাই হয়ে যায় তাঁর কাজের প্রধান জায়গা।
২০০৮ সালের শেষ দিকে শিশুনিবাসটির জন্য বিদেশি সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্প পরিচালক হাজেরা ও অন্য কর্মীরা বছর দেড়েক বিনা বেতনে খেটে, চেয়েচিন্তে ৪২টি শিশুর সেই আশ্রয় টিকিয়ে রাখেন। তারপর দেশে-বিদেশে শুভানুধ্যায়ীদের চেষ্টায় এককালীন একটা তহবিল মেলে। কিন্তু গুরুতর মতপার্থক্য হলে হাজেরার সঙ্গে এই শিশুনিবাস ও দুর্জয়-এর বিচ্ছেদ ঘটে।
প্রায় দুই সপ্তাহ ঘর থেকে বের হননি হাজেরা—‘আমি বুঝছিলাম, বাচ্চাদের ছাড়া আমি বাঁচব না। বাচ্চাদের সেন্টার একটা আমারে করতেই হবে।’
সম্বল ছিল সারা জীবন খেয়ে না খেয়ে জমানো কিছু টাকা। ‘আর ভরসা ছিল লোকবল,’ বলেন হাজেরা।
দুর্জয়-এর শিশুনিবাসে বেশ কয়েকজন মানুষ সাহায্য-সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কিছু তরুণ সবান্ধব এসে বাচ্চাদের পড়াতেন, গান-নাটক শেখাতেন আর তিন-চারটি শিশুর মাসখরচা দিতেন। পুরোনো সহযোগীরা এবার হাজেরার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামে ২০১০ সালের জুলাইয়ে সাভারে ২৫টি বাচ্চা নিয়ে নতুন শিশুনিবাসের যাত্রা শুরু হলো। ক্রমে দুর্জয়-এর শিশুনিবাস থেকেও অনেক মায়েরা বাচ্চা এখানে দিয়ে যান। একসময় সরে আসতে হয় ঢাকায়।
হাজেরার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ১৮ অক্টোবর, বুড়িগঙ্গার বেড়িবাঁধছোঁয়া প্রান্তে তাঁদের নতুন ঠিকানায়।
আজ পুতুলের গায়ে হলুদ: ধূলিধূসর ভাঙাচোরা পথ ধরে ময়লায় দমবন্ধ খাল-নালার পাশ দিয়ে গিয়ে উঠেছি আদাবরের প্রান্তিক নিম্নবিত্ত এলাকায় বাড়িটির সামনে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে স্বাগত জানায় শিশুনিবাসের রবিন, শাহীন, সাহিদ, সায়েম, জান্নাত ও রুমি। বয়স ওদের আট থেকে ১১-এর মধ্যে। হাসি ঝকমকে মুখগুলো লালে লাল।
কী সমাচার? সুরভী স্কুলের দুই ছাত্রীর পুতুলের বিয়ে শনিবার, আজ গায়ে হলুদ। ক্লাসের ফাঁকে চলছে রঙ খেলা।
সিঁড়িটা হাড়-জিরজিরে। হলুদ চুনকাম-ওঠা দেয়ালে রঙিন ছবি আঁকা, সুরভী স্কুলের দৌলতে। দোতলায় প্রথম ঘরগুলো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এই স্কুলটির। তারপর হাজেরাদের শিশুনিবাসের তিনটি ছোট ছোট ঘর এবং গ্যাসের চুলোর একচিলতে ঠাঁই। এরই ভাড়া মাসে ১২ হাজার টাকা।
নিবাসের বড় ছেলেমেয়েরা সুরভীতে পড়ে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাস করে একটি মেয়ে পড়ছে বাইরের স্কুলে, ষষ্ঠ শ্রেণীতে।
ওরা ২৪ জন: নিবাসী এখন ২৪ জন শিশু, দুটি বছর দুই বয়সী। ভর্তির বয়স দুই থেকে আট বছর। পথের যৌনকর্মীদের সন্তানদের পাশাপাশি এখন গৃহকর্মী, মেসের রাঁধুনি, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভিক্ষুক—এঁদের সন্তানেরাও থাকছে। অনেকেরই বাবা নেই। দুটি বোন আছে, যাদের বাবা-মা উভয়েই অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছেন। ছোট্ট পাখির মা তাকে রেখে গেছেন দুই বছর আগে; আর আসেননি।
বছর চারেকের শেলি ঘুরঘুর করছিল। হাজেরা ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘শেলি, তুই কোন প্যাটে হইছিস?’ সে আঙুল দিয়ে হাজেরাকে দেখায়। তারপর গুটগুটিয়ে এসে বসে পড়ে তাঁর কোলে। একটু পরেই ঘুমিয়ে কাদা! মেয়েটি হাজেরার হেফাজতে এসেছিল দুর্জয়-এর শিশুনিবাসে, নয় মাস বয়সে।
বারো বছর বয়সী মো. রবিনও পুরোনো নিবাসী। গত বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার আগ দিয়ে মা ওকে নিয়ে যান। ঘরে সৎবাবা। রবিন ফিরে এসেছে। হাজেরাকে দেখিয়ে সে বলে, ‘আম্মুরে অনেক দিন দেখি নাই, তাই চইল্যা আসছি। আমার নিজের মায়ে আমারে আদর করে না।’ আসছে জানুয়ারিতে রবিন আবার পঞ্চম শ্রেণীতে ঢুকবে।
সুরভী স্কুলের শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি বলেন, এখানে যে যৌনকর্মীদের সন্তানেরাও থাকে সে কথা এলাকাবাসী অনেকে হয়তো জানেন। তবে এ নিয়ে কোনো কথা উঠতে শোনেননি। বরং, তিনি বলেন, ‘এলাকার লোক সেন্টারটা ভালো চোখে দেখে—এটা আশ্রয়স্থল, নিরাপদ জায়গা।’
মা দিবসের চিঠি: হাজেরা লেখাপড়া শিখেছিলেন বড় হয়ে, কাশিমপুরে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময়। নিজের কাজের সবচেয়ে বড় অর্জন তিনি মনে করেন, এই শিশুদের কিছুটা লেখাপড়া করাতে পারা—‘ওরা যেই সুন্দর চিঠি লেখে!’
গত মা দিবসে হাতে হাতে তিনি এমন অনেকগুলো চিঠি পেয়েছেন—‘আমার মা/এলাহী বরসা। আমার প্রিয় মা, আসসালামুআইকুম। আশা করি তুমি অনেক ভালো আছো। মা আমি তোমাকে কতটুকু ভালো বাসি তো তোমাকে বলেতে পারছী না।...ইতি তোমার মেয়ে রুমি।’
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্বপনকে আখাউড়ার এক সাংবাদিক দুর্জয়-এর শিশুনিবাসে দিয়ে গিয়েছিলেন। নতুন শিশুনিবাসের কাগজপত্রে ওর মায়ের নাম ‘হাজেরা বেগম’। ফরসা সুন্দর মুখ শিশুটির চোখ সব সময় হাজেরাকে অনুসরণ করে। তিনি বাইরে গেলে স্বপন কেবলই বলে, ‘মা গ্যাছে গা।’
ওদের মুখে ‘মা’ ডাকে হাজেরার বড় তৃপ্তি হয়। একটু থেমে তিনি যোগ করেন, ‘আমি যেই কষ্ট পাইছি, ওরা যেন সেই কষ্ট না পায়। না খাইয়া যেন কষ্ট না পায়।’ ওদের প্রায় সবারই পথের জীবনে চলে যাওয়ার ঝুঁকি প্রবল ছিল।
এগিয়ে চলা: নিবাসের কাগজপত্র গোছানো ও সার্বিক সমন্বয়কাজের জন্য প্রথম দেড় বছর হাজেরা বেতন দিয়ে দুজন কর্মকর্তা রেখেছিলেন। ছিলেন দুজন আয়া ও একজন গৃহশিক্ষক। এখন আর পারছেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গত জানুয়ারিতে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হয়েছে। একটি ওয়েবক্ষেত্রও গুছিয়ে উঠছে।
যৌনকর্মীদের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হাজেরা মাঝেমধ্যে বিদেশে আমন্ত্রিত হন। তখন বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের ওপর লেখা বইপত্র বিক্রি করেন, ভ্রমণভাতা যথাসম্ভব জমিয়ে নিয়ে আসেন। এর প্রায় সবটা ব্যয় করেন শিশুনিবাস চালাতে। নিজের থাকা-খাওয়া শিশুদের সঙ্গেই।
বাচ্চাপ্রতি অভিভাবকের মাসে ৮০০ টাকা করে দেওয়ার কথা। অনেকেই দিতে পারেন না। থোক কিছু দান-অনুদান মেলে। ঈদে-চাঁদে মেলে জামাকাপড়। মাসের হিসাবে চাল, আলু আর আটা জোগান দুই শুভানুধ্যায়ী। আরেকজন প্রতি শুক্রবার মুরগি-চাল-ডাল পাঠান। বাড়িওয়ালা দেন প্রতিদিনের খাওয়ার ফিল্টার-পানি আর মাসে পাঁচ কেজি মুরগি। ইদানীং একটি পারিবারিক ফাউন্ডেশন মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা দিচ্ছে।
এখন নিবাসের যাবতীয় কাজ করেন একজন আয়া আর হাজেরা নিজে। একেকটি ছোট বাচ্চার যত্নের দায়িত্ব একেকজন বড় ছেলেমেয়ের। মাস গেলে তারা হাজেরা-মার কাছ থেকে ১০-১৫ টাকা করে পায়!
হাসি-কান্না: দুপুরে থালা হাতে বাচ্চারা সার দিয়ে বসে পড়ে। একটা পাঙাশের মাথা দিয়ে পুঁইশাকের ঘ্যাঁট, ভাত আর পাতলা ডাল। সপ্তাহে দুই বেলা মাংস আর দুই বেলা পাঙাশ বা কুচোচিংড়ি বরাদ্দ।
শোয়া-বসা মেঝেতে। খেলনাপাতি হাতফিরতি, পুরোনো। তার মধ্যেই ওদের আনন্দের কমতি নেই।
প্রতিষ্ঠানটির কার্যনির্বাহী পর্ষদের সহসভাপতি মো. মশিউল আজম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সেই তরুণ দলের একজন। ফোনে তিনি বললেন, ‘সবচেয়ে ভালো লাগে সেন্টারে যখন যাই, বাচ্চাদের হাসিমুখ দেখি। কষ্টও লাগে, ওদের জন্য যথেষ্ট করতে পারছি না।’
পর্ষদের সভাপতি হাজেরা বলছিলেন, ‘যে পরিবেশ চাইছিলাম, সেটা দিতে পারি নাই। কী করব, অর্থটা বড় সমস্যা।’ ভর্তি হতে ইচ্ছুক অনেককে ফিরিয়েও দিতে হচ্ছে।
চলার সাহস তবে কোথা থেকে পান হাজেরা? ‘আমি শুধু বুঝি, এটা করতে হবে। আর, বন্ধুদের সঙ্গে চলে সাহস পাই। ভালো মানুষদের সহযোগিতা থেকে শক্তি পাই।’
বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিল শিশু হাজেরা। ঘুম ভাঙতে দেখে, ফাঁকা বাস থেমে রয়েছে। জায়গাটা গুলিস্তান। সেখানে পথবাসী শিশুদের একটি দলের সঙ্গে শুরু হয় তার রাজপথের জীবন।
সে জীবন শিশুটিকে ভিড়িয়েছিল পকেটমারদের দলে। মাঝেমধ্যেই পুলিশের ‘ধরাগাড়ি’ নিয়ে যেত সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে, যেখানকার অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। পালিয়ে আবার পথে ওঠা। ভেসে বেড়ানোর সেই শৈশবে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হতে হাজেরাকে হয়ে যেতে হয় যৌনকর্মী।
নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ-এর এইচআইভি-এইডস নিরোধ কার্যক্রমের সুবাদে গঠিত হয় ঢাকার পথ-যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘ। হাজেরা সংগঠনের কাজে নামেন। ২০০৪ নাগাদ দুর্জয় পথ-যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য একটি শিশুনিবাস খুললে সেটাই হয়ে যায় তাঁর কাজের প্রধান জায়গা।
২০০৮ সালের শেষ দিকে শিশুনিবাসটির জন্য বিদেশি সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্প পরিচালক হাজেরা ও অন্য কর্মীরা বছর দেড়েক বিনা বেতনে খেটে, চেয়েচিন্তে ৪২টি শিশুর সেই আশ্রয় টিকিয়ে রাখেন। তারপর দেশে-বিদেশে শুভানুধ্যায়ীদের চেষ্টায় এককালীন একটা তহবিল মেলে। কিন্তু গুরুতর মতপার্থক্য হলে হাজেরার সঙ্গে এই শিশুনিবাস ও দুর্জয়-এর বিচ্ছেদ ঘটে।
প্রায় দুই সপ্তাহ ঘর থেকে বের হননি হাজেরা—‘আমি বুঝছিলাম, বাচ্চাদের ছাড়া আমি বাঁচব না। বাচ্চাদের সেন্টার একটা আমারে করতেই হবে।’
সম্বল ছিল সারা জীবন খেয়ে না খেয়ে জমানো কিছু টাকা। ‘আর ভরসা ছিল লোকবল,’ বলেন হাজেরা।
দুর্জয়-এর শিশুনিবাসে বেশ কয়েকজন মানুষ সাহায্য-সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কিছু তরুণ সবান্ধব এসে বাচ্চাদের পড়াতেন, গান-নাটক শেখাতেন আর তিন-চারটি শিশুর মাসখরচা দিতেন। পুরোনো সহযোগীরা এবার হাজেরার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামে ২০১০ সালের জুলাইয়ে সাভারে ২৫টি বাচ্চা নিয়ে নতুন শিশুনিবাসের যাত্রা শুরু হলো। ক্রমে দুর্জয়-এর শিশুনিবাস থেকেও অনেক মায়েরা বাচ্চা এখানে দিয়ে যান। একসময় সরে আসতে হয় ঢাকায়।
হাজেরার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ১৮ অক্টোবর, বুড়িগঙ্গার বেড়িবাঁধছোঁয়া প্রান্তে তাঁদের নতুন ঠিকানায়।
আজ পুতুলের গায়ে হলুদ: ধূলিধূসর ভাঙাচোরা পথ ধরে ময়লায় দমবন্ধ খাল-নালার পাশ দিয়ে গিয়ে উঠেছি আদাবরের প্রান্তিক নিম্নবিত্ত এলাকায় বাড়িটির সামনে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে স্বাগত জানায় শিশুনিবাসের রবিন, শাহীন, সাহিদ, সায়েম, জান্নাত ও রুমি। বয়স ওদের আট থেকে ১১-এর মধ্যে। হাসি ঝকমকে মুখগুলো লালে লাল।
কী সমাচার? সুরভী স্কুলের দুই ছাত্রীর পুতুলের বিয়ে শনিবার, আজ গায়ে হলুদ। ক্লাসের ফাঁকে চলছে রঙ খেলা।
সিঁড়িটা হাড়-জিরজিরে। হলুদ চুনকাম-ওঠা দেয়ালে রঙিন ছবি আঁকা, সুরভী স্কুলের দৌলতে। দোতলায় প্রথম ঘরগুলো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এই স্কুলটির। তারপর হাজেরাদের শিশুনিবাসের তিনটি ছোট ছোট ঘর এবং গ্যাসের চুলোর একচিলতে ঠাঁই। এরই ভাড়া মাসে ১২ হাজার টাকা।
নিবাসের বড় ছেলেমেয়েরা সুরভীতে পড়ে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাস করে একটি মেয়ে পড়ছে বাইরের স্কুলে, ষষ্ঠ শ্রেণীতে।
ওরা ২৪ জন: নিবাসী এখন ২৪ জন শিশু, দুটি বছর দুই বয়সী। ভর্তির বয়স দুই থেকে আট বছর। পথের যৌনকর্মীদের সন্তানদের পাশাপাশি এখন গৃহকর্মী, মেসের রাঁধুনি, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভিক্ষুক—এঁদের সন্তানেরাও থাকছে। অনেকেরই বাবা নেই। দুটি বোন আছে, যাদের বাবা-মা উভয়েই অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছেন। ছোট্ট পাখির মা তাকে রেখে গেছেন দুই বছর আগে; আর আসেননি।
বছর চারেকের শেলি ঘুরঘুর করছিল। হাজেরা ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘শেলি, তুই কোন প্যাটে হইছিস?’ সে আঙুল দিয়ে হাজেরাকে দেখায়। তারপর গুটগুটিয়ে এসে বসে পড়ে তাঁর কোলে। একটু পরেই ঘুমিয়ে কাদা! মেয়েটি হাজেরার হেফাজতে এসেছিল দুর্জয়-এর শিশুনিবাসে, নয় মাস বয়সে।
বারো বছর বয়সী মো. রবিনও পুরোনো নিবাসী। গত বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার আগ দিয়ে মা ওকে নিয়ে যান। ঘরে সৎবাবা। রবিন ফিরে এসেছে। হাজেরাকে দেখিয়ে সে বলে, ‘আম্মুরে অনেক দিন দেখি নাই, তাই চইল্যা আসছি। আমার নিজের মায়ে আমারে আদর করে না।’ আসছে জানুয়ারিতে রবিন আবার পঞ্চম শ্রেণীতে ঢুকবে।
সুরভী স্কুলের শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি বলেন, এখানে যে যৌনকর্মীদের সন্তানেরাও থাকে সে কথা এলাকাবাসী অনেকে হয়তো জানেন। তবে এ নিয়ে কোনো কথা উঠতে শোনেননি। বরং, তিনি বলেন, ‘এলাকার লোক সেন্টারটা ভালো চোখে দেখে—এটা আশ্রয়স্থল, নিরাপদ জায়গা।’
মা দিবসের চিঠি: হাজেরা লেখাপড়া শিখেছিলেন বড় হয়ে, কাশিমপুরে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময়। নিজের কাজের সবচেয়ে বড় অর্জন তিনি মনে করেন, এই শিশুদের কিছুটা লেখাপড়া করাতে পারা—‘ওরা যেই সুন্দর চিঠি লেখে!’
গত মা দিবসে হাতে হাতে তিনি এমন অনেকগুলো চিঠি পেয়েছেন—‘আমার মা/এলাহী বরসা। আমার প্রিয় মা, আসসালামুআইকুম। আশা করি তুমি অনেক ভালো আছো। মা আমি তোমাকে কতটুকু ভালো বাসি তো তোমাকে বলেতে পারছী না।...ইতি তোমার মেয়ে রুমি।’
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্বপনকে আখাউড়ার এক সাংবাদিক দুর্জয়-এর শিশুনিবাসে দিয়ে গিয়েছিলেন। নতুন শিশুনিবাসের কাগজপত্রে ওর মায়ের নাম ‘হাজেরা বেগম’। ফরসা সুন্দর মুখ শিশুটির চোখ সব সময় হাজেরাকে অনুসরণ করে। তিনি বাইরে গেলে স্বপন কেবলই বলে, ‘মা গ্যাছে গা।’
ওদের মুখে ‘মা’ ডাকে হাজেরার বড় তৃপ্তি হয়। একটু থেমে তিনি যোগ করেন, ‘আমি যেই কষ্ট পাইছি, ওরা যেন সেই কষ্ট না পায়। না খাইয়া যেন কষ্ট না পায়।’ ওদের প্রায় সবারই পথের জীবনে চলে যাওয়ার ঝুঁকি প্রবল ছিল।
এগিয়ে চলা: নিবাসের কাগজপত্র গোছানো ও সার্বিক সমন্বয়কাজের জন্য প্রথম দেড় বছর হাজেরা বেতন দিয়ে দুজন কর্মকর্তা রেখেছিলেন। ছিলেন দুজন আয়া ও একজন গৃহশিক্ষক। এখন আর পারছেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গত জানুয়ারিতে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হয়েছে। একটি ওয়েবক্ষেত্রও গুছিয়ে উঠছে।
যৌনকর্মীদের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হাজেরা মাঝেমধ্যে বিদেশে আমন্ত্রিত হন। তখন বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের ওপর লেখা বইপত্র বিক্রি করেন, ভ্রমণভাতা যথাসম্ভব জমিয়ে নিয়ে আসেন। এর প্রায় সবটা ব্যয় করেন শিশুনিবাস চালাতে। নিজের থাকা-খাওয়া শিশুদের সঙ্গেই।
বাচ্চাপ্রতি অভিভাবকের মাসে ৮০০ টাকা করে দেওয়ার কথা। অনেকেই দিতে পারেন না। থোক কিছু দান-অনুদান মেলে। ঈদে-চাঁদে মেলে জামাকাপড়। মাসের হিসাবে চাল, আলু আর আটা জোগান দুই শুভানুধ্যায়ী। আরেকজন প্রতি শুক্রবার মুরগি-চাল-ডাল পাঠান। বাড়িওয়ালা দেন প্রতিদিনের খাওয়ার ফিল্টার-পানি আর মাসে পাঁচ কেজি মুরগি। ইদানীং একটি পারিবারিক ফাউন্ডেশন মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা দিচ্ছে।
এখন নিবাসের যাবতীয় কাজ করেন একজন আয়া আর হাজেরা নিজে। একেকটি ছোট বাচ্চার যত্নের দায়িত্ব একেকজন বড় ছেলেমেয়ের। মাস গেলে তারা হাজেরা-মার কাছ থেকে ১০-১৫ টাকা করে পায়!
হাসি-কান্না: দুপুরে থালা হাতে বাচ্চারা সার দিয়ে বসে পড়ে। একটা পাঙাশের মাথা দিয়ে পুঁইশাকের ঘ্যাঁট, ভাত আর পাতলা ডাল। সপ্তাহে দুই বেলা মাংস আর দুই বেলা পাঙাশ বা কুচোচিংড়ি বরাদ্দ।
শোয়া-বসা মেঝেতে। খেলনাপাতি হাতফিরতি, পুরোনো। তার মধ্যেই ওদের আনন্দের কমতি নেই।
প্রতিষ্ঠানটির কার্যনির্বাহী পর্ষদের সহসভাপতি মো. মশিউল আজম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সেই তরুণ দলের একজন। ফোনে তিনি বললেন, ‘সবচেয়ে ভালো লাগে সেন্টারে যখন যাই, বাচ্চাদের হাসিমুখ দেখি। কষ্টও লাগে, ওদের জন্য যথেষ্ট করতে পারছি না।’
পর্ষদের সভাপতি হাজেরা বলছিলেন, ‘যে পরিবেশ চাইছিলাম, সেটা দিতে পারি নাই। কী করব, অর্থটা বড় সমস্যা।’ ভর্তি হতে ইচ্ছুক অনেককে ফিরিয়েও দিতে হচ্ছে।
চলার সাহস তবে কোথা থেকে পান হাজেরা? ‘আমি শুধু বুঝি, এটা করতে হবে। আর, বন্ধুদের সঙ্গে চলে সাহস পাই। ভালো মানুষদের সহযোগিতা থেকে শক্তি পাই।’
No comments