সময়ের প্রতিবিম্ব- খালেদার সফর ও আমাদের ‘নার্ভাস’ সরকার by এবিএম মূসা
আমার সর্বরোগের ধন্বন্তরি ডাক্তার, ল্যাবএইডের অধ্যাপক বরেন চক্রবর্তীকে টেলিফোন করলাম। অপর প্রান্ত থেকে দাদার উদ্বিগ্ন কণ্ঠের জিজ্ঞাসা, ‘আবার কী হলো, নতুন কী যন্ত্রণা?’ তাঁকে নিশ্চিন্ত করে আসল প্রশ্নটি করলাম, ‘ইংরেজি ফোবিয়া ও নার্ভাসনেস শব্দদ্বয়ের ডাক্তারি ব্যাখ্যা কী?’ তিনি জবাব দিলেন দুটিই একধরনের আতঙ্ক।
এর সঙ্গে প্রকৃত কোনো রোগের চেয়েও মানসিক দুশ্চিন্তা অধিকতর জড়িত। বরেনদা বললেন, ‘আপনার যদি এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানার থাকে, কোনো মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’ কয়েকটি নাম-ঠিকানাও জানিয়ে দিলেন।
আশ্বস্ত হতে পারলাম না, মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ মনঃপূত হলো না। কারণ, আমি একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে ভাবনায় প্রশ্নটি করেছিলাম। আমার চাই একটি প্রতিশব্দ, তাই অভিধানের আশ্রয় নিলাম। সংসদ অভিধানটি হাতের কাছে পেলাম না, পেলাম বাংলা একাডেমীর অভিধান, যেখানে অনেকগুলো প্রতিশব্দ পেলাম। সেগুলো হচ্ছে, ‘ভয়, আতঙ্ক, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, যুক্তিহীন কোনো রোগের উপসর্গ।’ মাথা ঘুলিয়ে যাওয়ার অবস্থা, আমি যে কারণে ‘ফোবিয়া ও নার্ভাসনেস’ শব্দদ্বয়ের অর্থ খুঁজছি, তার ধারেকাছেও নেই উপরিউক্ত প্রতিশব্দগুলো। খালেদা জিয়ার ভারত সফর, সেখানে তাঁর প্রায়-রাজসিক সংবর্ধনা, একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্য সম্মাননা প্রদান নিয়ে বর্তমানের আওয়ামী সরকারের বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার কারণ অনুসন্ধানে আমি শব্দদ্বয়ের অর্থ খুঁজছি।
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সহায়তাকারী ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের সখ্যের বন্ধন নানা উত্থান-পতনের মাঝেও অনেকখানি অটুট রয়েছে। এই কারণে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্ব সব সময় অবিচ্ছেদ্য, ইংরেজিতে বলব ‘টেকন ফর গ্রান্টেড’। সেই চিরঞ্জীব বন্ধুর সঙ্গে রাজনৈতিক শত্রু বলব না, প্রতিদ্বন্দ্বীর এ সদ্য গড়ে ওঠা দোস্তালি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে কেন? খালেদা জিয়া না হয় ভারত সফরে গেলেনই, তাঁকে সসম্মানে মেহমানদারি করাই হলো, তাই বলে এ নিয়ে এত ঘাবড়ে গেলেন কেন আমাদের সরকারি নীতিনির্ধারকেরা? এ নিয়ে একজন মন্ত্রী হাছান মাহমুদ কেন অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আমার প্রয়াত বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাক-এর এককালীন কর্মকর্তা, আবদুল ওয়াদুদের কন্যা তাই আমার অতি স্নেহভাজন, সাংবাদিকদের এ সম্পর্কিত প্রশ্নে ‘গুরুত্বহীন’ বলে কেন অকূটনৈতিক মন্তব্য করেন, যাতে একটুখানি তাচ্ছিল্যের আভাস রয়েছে? দীপু মনিকে আমি বরং পাল্টা প্রশ্ন করছি, খালেদা জিয়ার সফরটি ‘গুরুত্বহীন’ মনে হচ্ছে কার—তাঁর নিজের, সরকারের, কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের, নাকি জনগণের?
দীপু মনি যা-ই বলুন, আমি এ নিয়ে চ্যানেল আইয়ের টক শোতে (প্রধানমন্ত্রীর জবানিতে মধ্যরাতের সিঁধেল চুরি) যে মন্তব্যগুলো করেছি, সেসবের কিছু অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের সকাশে পেশ করছি। আমার বক্তব্য ছিল (১) বিএনপি-প্রধানের এই সফরের সব বিবরণ পড়ে মনে হয়েছে, তিনি ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্কের গুরুত্ব ও কূটনৈতিক প্রয়োজনীয়তা এত দিন পরে হলেও উপলব্ধি করেছেন। (২) পররাষ্ট্রনীতিতে একটি কথা চালু আছে, ‘ইউর এনিমিজ এনিমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’। এটি সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়। বরং ‘মাই এনিমির’, আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে বন্ধুত্বের ধারাটি যতখানি সম্ভব আমার দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটিই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কৌশল ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়। এবারে খালেদা জিয়ার সফরের প্রধান সাফল্য হচ্ছে, সেই কৌশলটি প্রয়োগে প্রজ্ঞার পরিচয়ে বিরোধীদলীয় নেতা অনেকখানি সফল হয়েছেন। দীপু মনি ‘গুরুত্বহীন’ বলে আসলে খালেদার সফরটিকে গুরুত্বপূর্ণ করেছেন। তদুপরি সফরটি যে তাঁর সরকারের নার্ভাসনেস, তথা মনোবৈকল্য সৃষ্টি করেছে, এই মন্তব্যে তা আড়াল করতে চেয়েছেন। বনের বাঘের মোকাবিলায় মনের বাঘটিকেই তাড়াতে চেয়েছেন।
এবার বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার ভারতনীতিতে ইউ-টার্নটি বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধুর অতীতের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ মন্তব্যের সঙ্গে বর্তমানের, দূর ও নিকট অতীতের কতিপয় ঘটনার তুলনামূলক আলোচনা করে বলব, তাঁর এ সম্পর্কিত অন্য একটি বক্তব্যই অধিকতর সঠিক। তিনি বলেছিলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতিতে স্থায়ী বন্ধুত্ব বা শত্রুতা থাকতে পারে না।’ এই বন্ধুত্ব বা শত্রুতা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, এক সরকারের সঙ্গে অন্যটির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতখানি প্রযোজ্য, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুই বা ততোধিক দেশের জনগণের পারস্পরিক জানাশোনা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর। এই সম্পর্কই স্থায়ী, অন্য কোনোটি নয়।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, দুই দেশের জনগণের মনোভাবের সম্পর্কে বিএনপি একসময়ে টানাপোড়েন বা অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছিল। এই কর্মটি করে তারা যে কোনো এককালে স্বল্প সময়ের জন্য রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেনি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে তাদের সৃষ্ট ‘ভারতীয় জুজুর’ ভয় একসময়ে অকেজো হয়ে গেছে। বিলম্বে হলেও বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলেরও বোধোদয় ঘটেছে, পন্থাটি ভ্রান্ত ছিল। শুধু তা-ই নয়, এর জন্য দেশি-বিদেশি, আঞ্চলিক ও ঘরোয়া রাজনীতিতে তাদের খেসারত দিতে হয়েছে। তাই এবার ভারত সফরে বিএনপি অতীত ঝেড়ে ফেলে বর্তমান বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন ধারা সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছে। ভারত-সম্পর্কিত মনোভাবে বাহ্যিক পরিবর্তন এনেছে। দুই দেশের বিশেষজ্ঞ মহল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমে সফরটি নিয়ে আলোচনায় এই নতুন মোড়ের (ইউ-টার্নের) প্রতিফলনও ঘটেছে।
তার পরও আমার কাছে যা বিচিত্র মনে হচ্ছে, তা হলো, বিএনপির দলীয় নীতিতে যেমন ভারত-মনোভাবের বাহ্যিক পরিবর্তনের মৃদুমন্দ সুবাতাস বইছে, বাংলাদেশে নানা কারণে জনগণের মাঝে একটু-আধটু উল্টো হাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর জন্য বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ সরাসরি ভারতকে ও পরোক্ষে বর্তমান সরকারের তথাকথিত ‘ভারতপ্রীতি’কে দায়ী করছে। বিএনপি ‘নতজানু’ কথাটি আওয়ামী লীগের ভারতনীতির সমালোচনায় রাজনৈতিক পরিভাষায় ব্যবহার করত। গত কয়েক বছর তারা তা করে না। তবে স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নেপথ্যে বলাবলি করছে। তাদের মাঝে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তার পানি বণ্টন, কাঁটাতারের বেড়া, ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ, সীমান্ত হত্যা ইত্যাকার বিষয়ে ভারতবিরোধী অসন্তোষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাদের অসন্তোষের মাত্রা বাড়িয়েছে ভারতের ভিসা জটিলতা, যা প্রকৃতপক্ষে সীমাহীন ভোগান্তি। এই অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী বাংলাদেশে নিযুক্ত কতিপয় ভারতীয় কর্মীর অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, সোজা কথায় কারও কারও দুর্ব্যবহার এবং অহেতুক দীর্ঘসূত্রতা।
উল্লেখ্য, উপরিউক্ত বিষয়ের সঙ্গে বিএনপির দলীয় মনোভাব অথবা তাদের নেত্রীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং অতীতে যেমন এ ধরনের সামান্য সূত্র ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট ভারতবিদ্বেষ সৃষ্টিতে তৎপর থাকত, গত দুই দশক বাংলাদেশের জনগণের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে কুলার বাতাস না দিয়ে নিশ্চুপ থাকার অথবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করেছে। এর কারণ বোধ হয় তাদের একধরনের উপলব্ধি ঘটেছে, যা হলো, বাংলাদেশের জনগণের মাঝে যেকোনো অজুহাতে ভারতীয় জুজুর ট্রাম্পকার্ড মোটেই কার্যকর নয়। তবে অকার্যকর করার কৃতিত্বটি দুবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতায় আসার পর তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে, একাত্তরের চেতনার পুনরুদ্ধার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রসার, যা নতুন প্রজন্মের ভোটদাতাদের মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। যদিও এই যুক্তিটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না জানি না, এই দুটি চিন্তাচেতনার সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সংযোগ রয়েছে। বিএনপি এই সত্যটি বিলম্বে হলেও উপলব্ধি করেই ভারতবিদ্বেষী প্রচারের কৌশল থেকে সরে এসেছে। ভারতেরও বিএনপি সম্পর্কে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। ভারতনীতিতে ইউ-টার্ন করে তথা মোড় ঘুরিয়ে খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচ্য বিষয়সমূহ দুই দেশের গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমার এমনটি মনে হয়েছে।
আমি উপরিউক্ত বিশ্লেষণসমূহের ভিত্তিটি আরও পোক্ত করতে চাই। ভারত কোনো দলকে বা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে পারে না, আবার ক্ষমতাচ্যুতও করতে পারে না। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা সম্প্রতি এ কথাটি বিভিন্ন উপলক্ষে বারবার বলছেন। তার পরও কেন ভারতের নীতিনির্ধারকদের বিএনপির নেত্রীকে সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী সরকারের উদ্বেগের কারণটিই বা কী হতে পারে? খালেদা জিয়ার দৃশ্যমান বর্ধিষ্ণু কদর বা গুরুত্বপূর্ণ সফরকে তাই ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। অনেকে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ ও ভারতীয় ‘র’ দুটিই কর্মতৎপর। উভয়ই বাংলাদেশের শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক অবস্থান, আন্তর্জাতিক বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাই ভাবছি, এখন কি খালেদা জিয়াকে প্রায় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের অনুসরণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগাম কোনো ধারণার ওপর ভিত্তি করে?
আমি তো মনে করি ব্যাপারটি হয়তো তা-ই। সে জন্যই বোধ হয় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে প্রয়োজনে ভবিষ্যতের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্র তৈরি করছে। তাই খালেদা জিয়ার কাছে ভারত আগাম প্রতিশ্রুতি চেয়েছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে অতীতের মতো বাংলাদেশের মাটিতে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গিবাদের ঘাঁটি তৈরি করতে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কক্সবাজার দিয়ে ট্রাকভর্তি অস্ত্র আসবে না, বাংলাদেশে অনুপ চেটিয়াদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে না। খালেদার সফরের এই বৈশিষ্ট্যই বর্তমান আওয়ামী নীতিনির্ধারকদের ‘নার্ভাসনেস’ তথা স্নায়ুবৈকল্য ও দুশ্চিন্তার কারণ। সেই দুর্বলতা ঢাকতেই তাঁরা খালেদা জিয়াকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ‘গুরুত্বহীন’ বলে মানসিক সান্ত্বনা পেতে চেয়েছেন। উভয় পক্ষের মনোজগতে আমার বিশ্লেষিত বিপরীত প্রতিক্রিয়া দুটির কোনটি বাস্তবভিত্তিক বা সঠিক, তা জানতে হলে আগামী নির্বাচনের (যদি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়) ফলাফলের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আশ্বস্ত হতে পারলাম না, মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ মনঃপূত হলো না। কারণ, আমি একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে ভাবনায় প্রশ্নটি করেছিলাম। আমার চাই একটি প্রতিশব্দ, তাই অভিধানের আশ্রয় নিলাম। সংসদ অভিধানটি হাতের কাছে পেলাম না, পেলাম বাংলা একাডেমীর অভিধান, যেখানে অনেকগুলো প্রতিশব্দ পেলাম। সেগুলো হচ্ছে, ‘ভয়, আতঙ্ক, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, যুক্তিহীন কোনো রোগের উপসর্গ।’ মাথা ঘুলিয়ে যাওয়ার অবস্থা, আমি যে কারণে ‘ফোবিয়া ও নার্ভাসনেস’ শব্দদ্বয়ের অর্থ খুঁজছি, তার ধারেকাছেও নেই উপরিউক্ত প্রতিশব্দগুলো। খালেদা জিয়ার ভারত সফর, সেখানে তাঁর প্রায়-রাজসিক সংবর্ধনা, একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্য সম্মাননা প্রদান নিয়ে বর্তমানের আওয়ামী সরকারের বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার কারণ অনুসন্ধানে আমি শব্দদ্বয়ের অর্থ খুঁজছি।
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সহায়তাকারী ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের সখ্যের বন্ধন নানা উত্থান-পতনের মাঝেও অনেকখানি অটুট রয়েছে। এই কারণে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্ব সব সময় অবিচ্ছেদ্য, ইংরেজিতে বলব ‘টেকন ফর গ্রান্টেড’। সেই চিরঞ্জীব বন্ধুর সঙ্গে রাজনৈতিক শত্রু বলব না, প্রতিদ্বন্দ্বীর এ সদ্য গড়ে ওঠা দোস্তালি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে কেন? খালেদা জিয়া না হয় ভারত সফরে গেলেনই, তাঁকে সসম্মানে মেহমানদারি করাই হলো, তাই বলে এ নিয়ে এত ঘাবড়ে গেলেন কেন আমাদের সরকারি নীতিনির্ধারকেরা? এ নিয়ে একজন মন্ত্রী হাছান মাহমুদ কেন অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আমার প্রয়াত বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাক-এর এককালীন কর্মকর্তা, আবদুল ওয়াদুদের কন্যা তাই আমার অতি স্নেহভাজন, সাংবাদিকদের এ সম্পর্কিত প্রশ্নে ‘গুরুত্বহীন’ বলে কেন অকূটনৈতিক মন্তব্য করেন, যাতে একটুখানি তাচ্ছিল্যের আভাস রয়েছে? দীপু মনিকে আমি বরং পাল্টা প্রশ্ন করছি, খালেদা জিয়ার সফরটি ‘গুরুত্বহীন’ মনে হচ্ছে কার—তাঁর নিজের, সরকারের, কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের, নাকি জনগণের?
দীপু মনি যা-ই বলুন, আমি এ নিয়ে চ্যানেল আইয়ের টক শোতে (প্রধানমন্ত্রীর জবানিতে মধ্যরাতের সিঁধেল চুরি) যে মন্তব্যগুলো করেছি, সেসবের কিছু অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের সকাশে পেশ করছি। আমার বক্তব্য ছিল (১) বিএনপি-প্রধানের এই সফরের সব বিবরণ পড়ে মনে হয়েছে, তিনি ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্কের গুরুত্ব ও কূটনৈতিক প্রয়োজনীয়তা এত দিন পরে হলেও উপলব্ধি করেছেন। (২) পররাষ্ট্রনীতিতে একটি কথা চালু আছে, ‘ইউর এনিমিজ এনিমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’। এটি সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়। বরং ‘মাই এনিমির’, আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে বন্ধুত্বের ধারাটি যতখানি সম্ভব আমার দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটিই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কৌশল ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়। এবারে খালেদা জিয়ার সফরের প্রধান সাফল্য হচ্ছে, সেই কৌশলটি প্রয়োগে প্রজ্ঞার পরিচয়ে বিরোধীদলীয় নেতা অনেকখানি সফল হয়েছেন। দীপু মনি ‘গুরুত্বহীন’ বলে আসলে খালেদার সফরটিকে গুরুত্বপূর্ণ করেছেন। তদুপরি সফরটি যে তাঁর সরকারের নার্ভাসনেস, তথা মনোবৈকল্য সৃষ্টি করেছে, এই মন্তব্যে তা আড়াল করতে চেয়েছেন। বনের বাঘের মোকাবিলায় মনের বাঘটিকেই তাড়াতে চেয়েছেন।
এবার বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার ভারতনীতিতে ইউ-টার্নটি বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধুর অতীতের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ মন্তব্যের সঙ্গে বর্তমানের, দূর ও নিকট অতীতের কতিপয় ঘটনার তুলনামূলক আলোচনা করে বলব, তাঁর এ সম্পর্কিত অন্য একটি বক্তব্যই অধিকতর সঠিক। তিনি বলেছিলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতিতে স্থায়ী বন্ধুত্ব বা শত্রুতা থাকতে পারে না।’ এই বন্ধুত্ব বা শত্রুতা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, এক সরকারের সঙ্গে অন্যটির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতখানি প্রযোজ্য, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুই বা ততোধিক দেশের জনগণের পারস্পরিক জানাশোনা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর। এই সম্পর্কই স্থায়ী, অন্য কোনোটি নয়।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, দুই দেশের জনগণের মনোভাবের সম্পর্কে বিএনপি একসময়ে টানাপোড়েন বা অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছিল। এই কর্মটি করে তারা যে কোনো এককালে স্বল্প সময়ের জন্য রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেনি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে তাদের সৃষ্ট ‘ভারতীয় জুজুর’ ভয় একসময়ে অকেজো হয়ে গেছে। বিলম্বে হলেও বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলেরও বোধোদয় ঘটেছে, পন্থাটি ভ্রান্ত ছিল। শুধু তা-ই নয়, এর জন্য দেশি-বিদেশি, আঞ্চলিক ও ঘরোয়া রাজনীতিতে তাদের খেসারত দিতে হয়েছে। তাই এবার ভারত সফরে বিএনপি অতীত ঝেড়ে ফেলে বর্তমান বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন ধারা সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছে। ভারত-সম্পর্কিত মনোভাবে বাহ্যিক পরিবর্তন এনেছে। দুই দেশের বিশেষজ্ঞ মহল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমে সফরটি নিয়ে আলোচনায় এই নতুন মোড়ের (ইউ-টার্নের) প্রতিফলনও ঘটেছে।
তার পরও আমার কাছে যা বিচিত্র মনে হচ্ছে, তা হলো, বিএনপির দলীয় নীতিতে যেমন ভারত-মনোভাবের বাহ্যিক পরিবর্তনের মৃদুমন্দ সুবাতাস বইছে, বাংলাদেশে নানা কারণে জনগণের মাঝে একটু-আধটু উল্টো হাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর জন্য বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ সরাসরি ভারতকে ও পরোক্ষে বর্তমান সরকারের তথাকথিত ‘ভারতপ্রীতি’কে দায়ী করছে। বিএনপি ‘নতজানু’ কথাটি আওয়ামী লীগের ভারতনীতির সমালোচনায় রাজনৈতিক পরিভাষায় ব্যবহার করত। গত কয়েক বছর তারা তা করে না। তবে স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নেপথ্যে বলাবলি করছে। তাদের মাঝে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তার পানি বণ্টন, কাঁটাতারের বেড়া, ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ, সীমান্ত হত্যা ইত্যাকার বিষয়ে ভারতবিরোধী অসন্তোষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাদের অসন্তোষের মাত্রা বাড়িয়েছে ভারতের ভিসা জটিলতা, যা প্রকৃতপক্ষে সীমাহীন ভোগান্তি। এই অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী বাংলাদেশে নিযুক্ত কতিপয় ভারতীয় কর্মীর অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, সোজা কথায় কারও কারও দুর্ব্যবহার এবং অহেতুক দীর্ঘসূত্রতা।
উল্লেখ্য, উপরিউক্ত বিষয়ের সঙ্গে বিএনপির দলীয় মনোভাব অথবা তাদের নেত্রীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং অতীতে যেমন এ ধরনের সামান্য সূত্র ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট ভারতবিদ্বেষ সৃষ্টিতে তৎপর থাকত, গত দুই দশক বাংলাদেশের জনগণের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে কুলার বাতাস না দিয়ে নিশ্চুপ থাকার অথবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করেছে। এর কারণ বোধ হয় তাদের একধরনের উপলব্ধি ঘটেছে, যা হলো, বাংলাদেশের জনগণের মাঝে যেকোনো অজুহাতে ভারতীয় জুজুর ট্রাম্পকার্ড মোটেই কার্যকর নয়। তবে অকার্যকর করার কৃতিত্বটি দুবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতায় আসার পর তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে, একাত্তরের চেতনার পুনরুদ্ধার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রসার, যা নতুন প্রজন্মের ভোটদাতাদের মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। যদিও এই যুক্তিটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না জানি না, এই দুটি চিন্তাচেতনার সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সংযোগ রয়েছে। বিএনপি এই সত্যটি বিলম্বে হলেও উপলব্ধি করেই ভারতবিদ্বেষী প্রচারের কৌশল থেকে সরে এসেছে। ভারতেরও বিএনপি সম্পর্কে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। ভারতনীতিতে ইউ-টার্ন করে তথা মোড় ঘুরিয়ে খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচ্য বিষয়সমূহ দুই দেশের গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমার এমনটি মনে হয়েছে।
আমি উপরিউক্ত বিশ্লেষণসমূহের ভিত্তিটি আরও পোক্ত করতে চাই। ভারত কোনো দলকে বা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে পারে না, আবার ক্ষমতাচ্যুতও করতে পারে না। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা সম্প্রতি এ কথাটি বিভিন্ন উপলক্ষে বারবার বলছেন। তার পরও কেন ভারতের নীতিনির্ধারকদের বিএনপির নেত্রীকে সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী সরকারের উদ্বেগের কারণটিই বা কী হতে পারে? খালেদা জিয়ার দৃশ্যমান বর্ধিষ্ণু কদর বা গুরুত্বপূর্ণ সফরকে তাই ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। অনেকে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ ও ভারতীয় ‘র’ দুটিই কর্মতৎপর। উভয়ই বাংলাদেশের শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক অবস্থান, আন্তর্জাতিক বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাই ভাবছি, এখন কি খালেদা জিয়াকে প্রায় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের অনুসরণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগাম কোনো ধারণার ওপর ভিত্তি করে?
আমি তো মনে করি ব্যাপারটি হয়তো তা-ই। সে জন্যই বোধ হয় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে প্রয়োজনে ভবিষ্যতের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্র তৈরি করছে। তাই খালেদা জিয়ার কাছে ভারত আগাম প্রতিশ্রুতি চেয়েছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে অতীতের মতো বাংলাদেশের মাটিতে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গিবাদের ঘাঁটি তৈরি করতে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কক্সবাজার দিয়ে ট্রাকভর্তি অস্ত্র আসবে না, বাংলাদেশে অনুপ চেটিয়াদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে না। খালেদার সফরের এই বৈশিষ্ট্যই বর্তমান আওয়ামী নীতিনির্ধারকদের ‘নার্ভাসনেস’ তথা স্নায়ুবৈকল্য ও দুশ্চিন্তার কারণ। সেই দুর্বলতা ঢাকতেই তাঁরা খালেদা জিয়াকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ‘গুরুত্বহীন’ বলে মানসিক সান্ত্বনা পেতে চেয়েছেন। উভয় পক্ষের মনোজগতে আমার বিশ্লেষিত বিপরীত প্রতিক্রিয়া দুটির কোনটি বাস্তবভিত্তিক বা সঠিক, তা জানতে হলে আগামী নির্বাচনের (যদি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়) ফলাফলের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments