ঘরে ফেরা! by এম আবদুল হাফিজ
অদ্ভুত মাদকতা জড়িয়ে আছে অভিব্যক্তিটিতে। উৎসবে-পার্বণে ঘরে ফিরতেই হবে নগরে বন্দি মানুষকে, যদিও নগরীর সঙ্গেই তাদের পরিচিতি, কাজ-কারবার এবং নগরেই তাদের জীবিকার উৎস। তবু কোনো কোনো সময়ে নাড়ির টানে তারা যেখানে তাদের শিকড় প্রোথিত ফিরে যেতে উদগ্রীব হয়।
জীবিকার তাগিদে যে কর্মস্থলে তারা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটায় সেখানকার একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্ত হয়ে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোতে ফিরতে চায়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা বাধে, যখন এই আকুতিকেও একশ্রেণীর নরপশু পুঁজি করে তাদের ভাগ্য গড়তে চায়।
আমাদের দেশে মূলত দুটি ঈদের সময়েই রাজধানীবাসী গতানুগতিকতা মুক্ত হয়ে বৈচিত্র্যের স্বাদ এবং স্বজনদের সানি্নধ্য পেতে গ্রামে ছোটে। স্বভাবতই আমাদের অবকাঠামো এত বিপুল সংখ্যার মানুষের ঘরমুখো যাত্রায় এবং মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই আবার তাদের রাজধানীর কর্মস্থলে পেঁৗছে দেওয়ার একটি বিরাট দায়িত্ব বর্তায় প্রশাসনের ওপর_ যার তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে সাফল্য দিতে নানা ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়ে থাকে। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা মেরামত, যমুনা সেতুর মেরামত স্থগিতকরণ, জল ও স্থল উভয় পথেই অতিরিক্ত বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি, সতর্কবাণী এবং সমন্বয় সাধনের কথা আমরা টেলিভিশন চ্যানেলে দেখি, সংবাদপত্রে পড়ি।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তারা বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবের উচ্চপদস্থরা ঈদের ঘরমুখো ও ফিরতি ভ্রমণকে কতখানি নিরাপদ ও ঝঞ্ঝাটমুক্ত করা হয়েছে তারও নিয়মিত ফিরিস্তি দিয়ে থাকেন। ছিনতাই ও চাঁদাবাজ রোধ করতে কোথায় এবং কোন কোন পয়েন্টে কত ফোর্স মোতায়েন হবে তারও বিবরণী এই ফিরিস্তির অন্তর্ভুক্ত। যদিও অনেকের মনে অনেক দ্বিধাই থাকে এই ভেবে যে, বিষয়টি কি এতই সহজ হবে। কর্তাব্যক্তিদের সমস্যা সরলীকরণে মন সায় না দিলেও এবং অতীতের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এক কঠিন যাত্রার ঝুঁকি নেয় ঘরপাগল মানুষ। ভাগ্যবানরা ভালোয় ভালোয় গন্তব্যে যায় এবং ফিরেও আসে।
কিন্তু অধিকাংশের ললাট লিখন থাকে দুর্বিষহ দুর্ভোগের, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ার এবং ছিনতাইকারী কবলিত হওয়ার নিদেনপক্ষে সবাইকে কমবেশি চাঁদার টাকা গুনতেই হয়। এমন কথা যোগাযোগমন্ত্রীও অকপটে স্বীকার করেন। পরিহাসের বিষয় যে, এই চাঁদাবাজদের অন্তর্ভুক্ত ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও আছেন। এ তো মাত্র ঘরে ফিরতে উৎসাহীদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত। এদের সঙ্গে ঢাকামুখী স্রোতে শামিল আছে কোরবানির পশুর ব্যবসায়ীরা। তাদের অক্ষত অবস্থায় কোরবানির হাট পর্যন্ত পেঁৗছা এক অলৌকিক ব্যাপার। অধিকাংশেরই অভিজ্ঞতা তিক্ত।
তাহলে? সরকারের কাজ সরকার তার প্রশাসনযন্ত্রের মাধ্যমে ঠিকই করে থাকে_ স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ ভ্রমণের আশ্বাস দেয়। যাত্রীদের নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক মোতায়েন করে। যাত্রীদের না ঠকানোর জন্য কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাঘাট মেরামতের ব্যবস্থা ইত্যাদিও হয়। কিন্তু দেশের জরাজীর্ণ অবকাঠামো, অসাধু পুলিশ বা র্যাবের চাঁদাবাজিতে কথিত অংশগ্রহণ ইত্যাদি কারণে জনদুর্ভোগ, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবক্ষয়ের আরও অনেক উপসর্গ একই সমান্তরালে চলতে থাকে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধু শূন্যগর্ভ আশ্বাসই কি যথেষ্ট? বাস্তবতা তা প্রমাণ করে না। কেননা, যারা ওই আশ্বাসগুলো দেন তাদের আশ্বাসকে ফলপ্রসূ করার যোগ্যতা নেই। তারা এমন আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শুধু ছকবাঁধা রুটিনের অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু প্রদত্ত আশ্বাসকে কার্যকর করতে কদাচিৎ তাদের মধ্যে কোনো উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি এগুলো তো এদেশে অনুসৃত রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্তৃপক্ষ জনগণকে কার্যত নাবালক ভাবে, যাদের ললিপপসদৃশ কথার জাদু দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা যায়। তারপর ঈদের আনন্দ বেদনা এক সময় তামাদি হয়ে যায়। তখন কে মনে রাখে ঘরে ফেরার দুর্ভোগ। তখন হয়তো অন্য প্রকার দুর্ভোগ এই একই মানুষদের কাবু করে রেখেছে। কেউ কেউ হাজারো দুর্ভোগ ও বিপত্তির মধ্য দিয়েই ঘরে ফেরার আনন্দে বিভোর।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
আমাদের দেশে মূলত দুটি ঈদের সময়েই রাজধানীবাসী গতানুগতিকতা মুক্ত হয়ে বৈচিত্র্যের স্বাদ এবং স্বজনদের সানি্নধ্য পেতে গ্রামে ছোটে। স্বভাবতই আমাদের অবকাঠামো এত বিপুল সংখ্যার মানুষের ঘরমুখো যাত্রায় এবং মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই আবার তাদের রাজধানীর কর্মস্থলে পেঁৗছে দেওয়ার একটি বিরাট দায়িত্ব বর্তায় প্রশাসনের ওপর_ যার তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে সাফল্য দিতে নানা ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়ে থাকে। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা মেরামত, যমুনা সেতুর মেরামত স্থগিতকরণ, জল ও স্থল উভয় পথেই অতিরিক্ত বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি, সতর্কবাণী এবং সমন্বয় সাধনের কথা আমরা টেলিভিশন চ্যানেলে দেখি, সংবাদপত্রে পড়ি।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তারা বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবের উচ্চপদস্থরা ঈদের ঘরমুখো ও ফিরতি ভ্রমণকে কতখানি নিরাপদ ও ঝঞ্ঝাটমুক্ত করা হয়েছে তারও নিয়মিত ফিরিস্তি দিয়ে থাকেন। ছিনতাই ও চাঁদাবাজ রোধ করতে কোথায় এবং কোন কোন পয়েন্টে কত ফোর্স মোতায়েন হবে তারও বিবরণী এই ফিরিস্তির অন্তর্ভুক্ত। যদিও অনেকের মনে অনেক দ্বিধাই থাকে এই ভেবে যে, বিষয়টি কি এতই সহজ হবে। কর্তাব্যক্তিদের সমস্যা সরলীকরণে মন সায় না দিলেও এবং অতীতের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এক কঠিন যাত্রার ঝুঁকি নেয় ঘরপাগল মানুষ। ভাগ্যবানরা ভালোয় ভালোয় গন্তব্যে যায় এবং ফিরেও আসে।
কিন্তু অধিকাংশের ললাট লিখন থাকে দুর্বিষহ দুর্ভোগের, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ার এবং ছিনতাইকারী কবলিত হওয়ার নিদেনপক্ষে সবাইকে কমবেশি চাঁদার টাকা গুনতেই হয়। এমন কথা যোগাযোগমন্ত্রীও অকপটে স্বীকার করেন। পরিহাসের বিষয় যে, এই চাঁদাবাজদের অন্তর্ভুক্ত ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও আছেন। এ তো মাত্র ঘরে ফিরতে উৎসাহীদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত। এদের সঙ্গে ঢাকামুখী স্রোতে শামিল আছে কোরবানির পশুর ব্যবসায়ীরা। তাদের অক্ষত অবস্থায় কোরবানির হাট পর্যন্ত পেঁৗছা এক অলৌকিক ব্যাপার। অধিকাংশেরই অভিজ্ঞতা তিক্ত।
তাহলে? সরকারের কাজ সরকার তার প্রশাসনযন্ত্রের মাধ্যমে ঠিকই করে থাকে_ স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ ভ্রমণের আশ্বাস দেয়। যাত্রীদের নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক মোতায়েন করে। যাত্রীদের না ঠকানোর জন্য কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাঘাট মেরামতের ব্যবস্থা ইত্যাদিও হয়। কিন্তু দেশের জরাজীর্ণ অবকাঠামো, অসাধু পুলিশ বা র্যাবের চাঁদাবাজিতে কথিত অংশগ্রহণ ইত্যাদি কারণে জনদুর্ভোগ, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবক্ষয়ের আরও অনেক উপসর্গ একই সমান্তরালে চলতে থাকে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধু শূন্যগর্ভ আশ্বাসই কি যথেষ্ট? বাস্তবতা তা প্রমাণ করে না। কেননা, যারা ওই আশ্বাসগুলো দেন তাদের আশ্বাসকে ফলপ্রসূ করার যোগ্যতা নেই। তারা এমন আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শুধু ছকবাঁধা রুটিনের অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু প্রদত্ত আশ্বাসকে কার্যকর করতে কদাচিৎ তাদের মধ্যে কোনো উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি এগুলো তো এদেশে অনুসৃত রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্তৃপক্ষ জনগণকে কার্যত নাবালক ভাবে, যাদের ললিপপসদৃশ কথার জাদু দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা যায়। তারপর ঈদের আনন্দ বেদনা এক সময় তামাদি হয়ে যায়। তখন কে মনে রাখে ঘরে ফেরার দুর্ভোগ। তখন হয়তো অন্য প্রকার দুর্ভোগ এই একই মানুষদের কাবু করে রেখেছে। কেউ কেউ হাজারো দুর্ভোগ ও বিপত্তির মধ্য দিয়েই ঘরে ফেরার আনন্দে বিভোর।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments