উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান-শৃঙ্খল নয়, শৃঙ্খলা

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটতে চলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর এ অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ কম। মাত্র দুই দশক আগেও উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বলতে ঢাকা, রাজশাহী,


চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের মতো হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকেই বোঝাত। এগুলো স্বায়ত্তশাসিতভাবে পরিচালিত হয়, তবে ব্যয়ের সিংহভাগ আসে সরকারি তহবিল থেকে। কিন্তু এখন এ ধরনের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩৩টি। আরও অন্তত চারশ' বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হয়। এগুলোর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, যার উদ্যোগ ও অর্থের জোগান এসেছে বেসরকারি খাত থেকে। উচ্চশিক্ষার প্রসার ও গুণগত মান বাড়াতে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত ও সংশ্লিষ্ট করার সরকারের নীতি এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। আমরা বরাবরই এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহায়তার হাত বাড়াতে বলেছি। প্রাইভেট উদ্যোগে পরিচালিত কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষা বাণিজ্যে জড়িত, এমন অভিযোগ রয়েছে। এটাও বলা হয় যে, কেবল সার্টিফিকেট প্রদানের অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েও কাজ করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এ জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত এলাকার বাইরে ক্যাম্পাসও চালু করা হয়। তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ হারে বেতন-ফি আদায় করে, কিন্তু শিক্ষাদান কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সময়োচিত পদক্ষেপে এ ধরনের অনৈতিক বাণিজ্য অনেকটাই এখন নিয়ন্ত্রণে। আউটার ক্যাম্পাস নিষিদ্ধ। তবে এ নিয়ে ঢালাও অভিযোগের অবকাশ নেই এবং সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কেও এক পাল্লায় মাপা চলে না। বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রেডিট উন্নত বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বীকৃত হয়। তবে যে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। প্রকৃত অর্থে বিশ্ব মানে পেঁৗছাতে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও বহু দূর পাড়ি দিতে হবে। এ জন্য সেরা শিক্ষক যেমন নিয়োগ দিতে হবে, তেমনি অবকাঠামো সুবিধাও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত নির্ভর করবে সরকারি ভর্তুকির ওপর। কিন্তু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চার্জ আদায়ের কোনো বিকল্প নেই। তবে এর মাত্রা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, শিক্ষার্থীদের সুবিধা প্রদানের নাম করে বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য গলা কাটা হারে অর্থ আদায় করা না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। শুক্রবার উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে রাজধানীতে আয়োজিত এক সেমিনারে মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাস থাকতে পারবে না' বলে জানিয়েছেন। কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ ধরনের পদক্ষেপ অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। যে শহরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়েছে তার বাইরে অন্যত্র ক্যাম্পাস স্থাপন আইনে নিষিদ্ধ এবং তার কড়াকড়ি প্রয়োগ হতে হবে। তবে একই শহরে একাধিক ক্যাম্পাস স্থাপনে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। দেশের প্রাচীনতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও কয়েকটি ক্যাম্পাস নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস ভূমির পরিমাণ বিষয়েও নমনীয়তা। যারা আইনের বরখেলাপ করে বিত্ত সঞ্চয় করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, আইনের বরখেলাপ না করার কারণে ভালোভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অস্তিত্বের সংকটে না পড়ে।

No comments

Powered by Blogger.