এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন by শহিদুল ইসলাম

এক. গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের 'রাজনীতি' নামের ট্যাবলয়েডে মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনের 'পদ্মা সেতু, বিশ্বব্যাংক ও একজন নোবেল লরিয়েট' শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রতিবেদন খুব মনোযোগের সঙ্গে বারবার পড়লাম। প্রতিবেদক খুব পরিশ্রম করেছেন। লেখাটি আমার ভালো লেগেছে।


কিন্তু লেখাটি পড়ে আমার বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার হাইজেনবার্গের 'অনিশ্চয়তার সূত্রটির' কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। তাই আজকের এই লেখা। তাই শুরুতেই ওই সূত্রটির মূল কথাটি বলতে চাই। তা হলো 'একটি পরমাণুর মধ্যে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রোনগুলোর সঠিক অবস্থান যদি জানতে চেষ্টা করি, তাহলে তার গতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে না। আবার তার গতি যদি সঠিকভাবে জানতে চেষ্টা করি তাহলে তার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে না।' বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই সূত্রকে মেনে নিতে পারেননি এবং জীবনের শেষ ৪০ বছর ওই সূত্রটিকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে আবিষ্কৃত ওই সূত্রটির সত্যতা নিয়ে আজও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। এটা বস্তুজগতের কথা-বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞানের সূত্র হুবহু মানুষ ও তার সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। তবুও 'দৃষ্টবাদের' জনক অগাস্ট কত্ বিজ্ঞানের প্রতি এতটাই দুর্বল ছিলেন যে তিনি তাই মনে করেছিলেন। যাক সে কথা। আমরা যারা একটু-আধটু লেখালেখি করি, তাঁরা নিশ্চিয়ই স্বীকার করবেন একটি বিষয়কে নিয়ে লিখতে বসলে আনুষঙ্গিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লেখার বাইরেই থেকে যায়। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর পড়লে মনে হয় 'ওহ, ওই বিষয়টি তো বাদ পড়ে গেছে।' এটা খুবই স্বাভাবিক। মেজবাহউদ্দিনের লেখাটি পড়ে আমার সেই কথাটিই মনে পড়ল। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটিই তাঁর লেখা থেকে বাদ পড়ে গেছে। তবে এটা তাঁর বিশ্বাসপ্রসূত নয় বলেই আমার মনে হয়েছে। তাঁর লেখাটির নামের শেষে আরো তিনটি শব্দ জুড়ে দিতেন এবং সে সম্পর্কে আলোকপাত করতেন, তাহলে লেখাটি আমার মতে পরিপূর্ণ হতো। সে তিনটি শব্দ হলো 'নয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন।'
দুই. এবারে আমি মেজবাহউদ্দিনের লেখা থেকে বেশ কিছু কথা এই অংশ তুলে ধরব; তাহলে আমি যা বলতে চাই, তা পরিষ্কার হবে। প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে লেখক কোনো রাখঢাক না করেই লিখেছেন। চাঁচাছোলাভাবে বলা যায়, 'বর্তমান সরকার যত দিনে সসম্মানে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে না দিচ্ছে, তত দিন আমেরিকা পদ্মা সেতু হতে দিচ্ছে না।' তিনি আরো বলেছেন, 'পদ্মা সেতু, ইউনূস আর বিশ্বব্যাংক যেন এক সূত্রে গাথা হয়ে গেছে। শেষ সময়ে এসে হলেও সরকারের উপলব্ধিতে এসেছে ড. ইউনূসের লবিংয়ের কারণে পদ্মা সেতু বারবার ঝুলে যাচ্ছে।' প্রধানমন্ত্রীর 'বোধোদয়' শীর্ষক অংশে বলছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যখন একের পর এক আক্রমণ চালানো হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ঘূণাক্ষরেও টের পাননি যে এই নোবেল লরিয়েটের খুঁটির জোর কত শক্ত। তিনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ভালো, এটা প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যরা জানলেও এই যোগাযোগের ব্যাপকতা টের পাননি। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিলারি ক্লিনটন। (ড. ইউনূসের পারিবারিক বন্ধু)। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পারেন না এমন কাজ নেই। ... ফলে দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূস ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ ছাড়ে গড়িমসি করছে, দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে। ...শুধু পদ্মা সেতুই নয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ ঋণ ও অনুদান সহায়তা পেত এর পরিমাণও অনেক কমে গেছে। আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ে প্রায় সবাই বেঁকে বসেছে। ....এর ওপর আন্তর্জাতিক মহল একযোগে চাপ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলার জন্য। সাধারণ মানুষও এখন বুঝতে পারছে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক টানাপড়েনের জন্য ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের বৈরী আচরণ অনেকটাই দায়ী। অনেকে এমন মন্তব্য প্রকাশ্যেই করছেন, সরকার এখনো যদি ইউনূসের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়। সসম্মানে গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূসকে ফিরিয়ে দেয়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই স্থির হয়ে যাবে। আর বেশি উদ্ধৃতি দেওয়ার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। পাঠকদের অনুরোধ ওই প্রতিবেদনটা জোগাড় করে পড়ে দেখতে।
তিন. ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া একমাত্র বাঙালি। দেশের আপামর মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। তাই ওই প্রতিবেদকের সঙ্গে একমত হওয়া যায় না যে ড. ইউনূস তাঁর আন্তর্জাতিক শক্তিধর বন্ধুদের সাহায্যে বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বিরোধ থাকতেই পারে; কিন্তু শেখ হাসিনাই তো বাংলাদেশ নন। বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম ১৬ কোটি মানুষের দেশ। আগামী নির্বাচনে হাসিনা পরাজিত হলে পদ্মা সেতু তুলে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন না- বাংলাদেশ সরকার আর বাংলাদেশ এক নয়। নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূস এত মোটা মাথার মানুষ নন বলেই দেশবাসী মনে করেন। গ্রামীণ ব্যাংক ফিরে না পেলে তিনি তাঁর লবিংয়ের শক্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে কোমর বেঁধে নামবেন- এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তার পরও যদি প্রতিবেদক মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় তাহলে দেশবাসী ড. ইউনূসকে আর আজকের মতো শ্রদ্ধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। হাসিনার শত্রু তখন দেশের শত্রুতে পরিণত হবেন। মনে রাখা উচিত, ৩০ লাখ মানুষের জীবনদান ও চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। অনেক মূল্য এ স্বাধীনতার। কোনো ব্যক্তি কিংবা সরকারের একগুঁয়েমি, কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা এ দেশের মানুষ সহ্য করবে না। বর্তমান সরকার দেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার। ড. ইউনূস তা নন। তিনি একজন ব্যক্তি। নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত। সবার নমস্য। বিশ্ব নয়া সাম্রাজ্যবাদ আজ সব বিশ্ব দখল করার শপথ নিয়ে এগোচ্ছে। সে জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে তাদের তাঁবেদার সরকার কিংবা কিছু বিশ্বাসঘাতক দালাল সৃষ্টি করে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তার প্রমাণ ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া প্রভৃতি। আমেরিকা আজ খোলাখুলিভাবে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপিত হচ্ছে মার্কিন সিনেটে। নোয়াম চমস্কির ভাষায়, আমেরিকা আজ পয়লা নম্বর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। পৃথিবীর দেশে দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করাই তার প্রধান কাজ। সেই মার্কিনি নয়া সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যে ড. ইউনূস বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন- এটা কী করে বিশ্বাস করা যায়? তাই বলছিলাম, মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন হাসিনা ও ড. ইউনূসের বিরোধের ফল বিচার করতে বসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কথাটি ভুলে গেছেন। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
চার. তাই জাতির জিজ্ঞাসা, আমরা কি বিশ্ব নয়া সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতি স্বীকার করব? উচ্চমূল্যে কেনা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পশ্চিমা শক্তির কাছে বিকিয়ে দেব? এ প্রসঙ্গে মেজবাহউদ্দিনের জ্ঞাতার্থে জানাই ১৯৭৪ সালে এ দেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং ৩০ হাজার মানুষ মরে গিয়েছিল, তার প্রধান হোতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে নোবেল অর্থনীতি পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর্ত্য সেন গবেষণালব্ধ বইতে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেশি দামে কিউবার কাছে পাট বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র চার জাহাজভর্তি খাদ্যদ্রব্য সিঙ্গাপুর পোর্টে আটকে দিয়ে এ দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে শেখ মুজিব সরকারকে বিপদে ফেলেছিল। আজ প্রতিবেদক মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনের কথাই যদি ঠিক হয়, তাহলে আজও যুক্তরাষ্ট্র একই কাজ করছে এবং তাঁকে সাহায্য-সমর্থন করছেন ড. ইউনূস। এটা যদি সত্যি হয়, এতে কি ড. ইউনূসের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে? তাই হাইজেনবার্গের 'অনিশ্চয়তার সূত্রের' উল্লেখ করে আমি এটাই বলতে চেয়েছি প্রতিবেদক একদিকে জোর দিতে গিয়ে অন্য দিকের কথা ভুলে গেছেন। ড. ইউনূস বিখ্যাত ব্যক্তি। ক্লিনটন পরিবার তাঁর পারিবারিক বন্ধু। তাঁর উন্নতির আরো সম্ভাবনা হয়তো বাকিই রয়ে গেছে। বাংলাদেশে আরো পণ্ডিত আছেন। তাঁদের মতামতগুলোও তুলে ধরা উচিত। কারণ দেশটি তাদেরও- সবার। বিদেশি সাহায্যের রাজনীতি নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মতো আমাদের দেশের মানুষও দ্বিধাবিভক্ত। তেমনি একজন ব্যক্তি ড. জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁর 'The Ulimate Fate of the Universe' বইটি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর আশির দশকে পৃথিবীতে বিপুল সাড়া জাগায়। তিনি স্টিফেন হকিংয়ের দুই ক্লাস ওপরে পড়তেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০০২ সালের ৪ আগস্ট প্রথম আলোতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের নাম দিয়েছিলেন 'আমাদের কোনো বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন নেই।' ২০১০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠের 'শিলালিপি'তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'ভিসাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে মুক্তি চাই।' ওই দুটি সাক্ষাৎকারে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, 'আমি বারবার বলব- বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি আপনারা চলে যান। আমরা এত দিন দেখেছি আপনাদের কর্মকাণ্ড, দারিদ্র্যবিমোচনের নামে হাতেগোনা কয়েকজন সুবিধাভোগীকে তৈরি করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যাঁদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন রাজনীতি। ভারসাম্যহীন করেন সমাজ। দেশকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করবেন না। আপনারা চলে যান। বিদেশি হস্তক্ষেপ চাই না। স্বাধীন দেশে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে চাই। এক পয়সার সাহায্যও চাই না, প্লিজ চলে যান। এখনো কি কম্পানি আমল যে হাজার হাজার কোটি টাকা, সাধারণ মানুষের অর্জনের টাকা তারা নিয়ে যাচ্ছে, আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আর কতিপয় বাঙালি সহচর তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে। হিংস্রতা বেড়ে যায়। নির্বাচনে সহিংসতার ক্ষেত্রেও বিদেশি সাহায্যের ইন্ধন আছে। এই ভিসাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে স্বাবলম্বী হতে হবে।' (শিলালিপি, কালের কণ্ঠ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১০, শুক্রবার)।
পাঁচ. এরপর আমার আর কিছু বলার থাকে না। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ করে এনে যাঁরা দেশের উন্নয়নের জন্য গলদঘর্ম বাস্তবে দেখা যায়, উন্নয়ন তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ মানুষের মাথা গোঁজার স্থান নেই। তারা রাস্তায় কিংবা বস্তির ৮ ফুট বাই ৮ ফুট একটি ভাঙা ঘরে জড়াজড়ি করে রাত কাটায়। তাই আজ অনেক প্রগতিশীল মানুষ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিকে সাধারণ মানুষের শত্রু মনে করে। 'সাহায্যের রাজনীতি' যে কত ভয়ংকর, তা মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়ে গেছে। তাই তাঁকে জানাই আমার অন্তরঙ্গ অভিনন্দন। হয়তো তাঁর অজান্তেই অনেক সত্যি কথা তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমার মনে হয়, যা হয়তো ড. ইউনূস সাহেবকে বিভ্রান্তকর অবস্থায় ফেলবে। দারিদ্র্য বিমোচন ও দেশের গতর খাটা মানুষের মঙ্গলের জন্য যারা বিদেশি সাহায্যের বিকল্প আর কিছু ভাবতে পারে না, জানি তারা আমার এই লেখার সঙ্গে একমত পোষণ করবে না। সেই সঙ্গে নয়া সাম্রাজ্যবাদের সুবিধার্থে দেশের অবকাঠামোর উন্নয়নে তারাই টাকা দেয়। সে টাকা কার পকেটে কত যায়, সে হিসাবও আজ অজানা নয়। বাংলাদেশে যারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে তার বেশির ভাগই বিদেশি সাহায্যপুষ্ট। তাই শেষে জানাতে চাই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী এবং দারিদ্র্যদূরীকরণে বৈদেশিক ঋণ নয়, স্বাবলম্বী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীন দেশগুলো আজ ঝেঁটিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফকে তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ৫০০ বছরের লাতিন আমেরিকার ইতিহাস পড়ুন। ইউরোপ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নির্মম শোষণের ও আগ্রাসনের কথা জানতে পারবেন। আমাদের দেশের ১৯০ বছরের 'সভ্য' ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস পড়ুন। ঢাকার 'মসলিন' শিল্পীদের বুড়ো আঙুল কেটে তারা কুটির শিল্পগুলো কিভাবে ধ্বংস করেছিল সে কথা জানতে চেষ্টা করুন। তাহলে আজকের 'সভ্যতার' মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের মিথ্যা অভিযোগে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান আক্রমণের কথা অবিশ্বাস করতে পারবেন না। নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত করে পশ্চিমা 'সভ্যতা'র বর্বর শাসকশ্রেণী সেখানে জনৈক কিশোরকে রাজা বানিয়ে কী রকম শোষণ চালিয়েছিল সে ইতিহাস পড়ুন। তখন আর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের প্রতি পাঠকের আর কোনো মোহ থাকবে না। বর্তমান বিশ্বে মানবতার প্রধান শত্রু যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ তাদের অস্ত্রভাণ্ডার। দেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে হলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিকে জোরে 'না' বলুন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের প্রতি যদি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে, তাহলে মার্কিনের নেতৃত্বে নয়া সাম্রাজ্যবাদকে আরো জোরে 'না' বলুন। একুশের ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাদের সবাইকে 'না' বলুন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার জন্য 'স্বাবলম্বী' হয়ে উঠুন। দেশের ১৬ কোটি মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছে- ভবিষ্যতেও থাকবে। আর যে 'কতিপয় বাঙালি' তাদের সহযোগিতা করছে, তাদের চিহ্নিত করুন। একাত্তরের রাজাকার-আলবদরদের মতো একদিন তাদেরও বিচার দাবি করবে এ দেশের মানুষ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.