সহজ-সরল-নীতিনির্ধারকরা ভুল করলেও গাছগুলো তো সত্য! by কনকচাঁপা
গেল বছরের কোনো একসময়ে আমার ঈদের বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের ভিডিও চিত্রগ্রহণ করতে একটা চ্যানেলের টিম বের হলো জায়গা খুঁজতে। ঢাকা শহরে তো খোলামেলা বৃক্ষরাজি বা উদ্যান-জাতীয় স্থান খুব কম। তাই খুঁজতে খুঁজতে ঢাকার বাইরে শেষমেশ একটা আবাসন প্রকল্প পাওয়া গেল। প্রকল্পটি আমাদের অনুমতি দিল শুটিং করার। দারুণ স্থান।
যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। প্রকল্পের মাঝে বিশাল খাল। প্রায় নদীর মতো। আমাদের দেশের প্রায় বুজে আসা বা অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া নদীর চেয়ে তো অবশ্যই বড়! নৌকায় চড়েও ভিডিও শুট হলো। অল্প অল্প উঁচু সীমানা দেওয়া প্লট, সেগুলো গাছে ভরা। গাছ আর গাছ। ফলদ, বনজ, ঔষধি, গুল্ম, ঝাড়, ফুল- কী গাছ নেই সেখানে! চোখের সীমানা আটকায় না কোথাও। চোখ এগিয়ে যেতে থাকে। অজস্র পেয়ারা গাছে ধরে পেকে আছে। এমনটা বাংলাদেশে দেখা যায় না। প্রতিটা পেয়ারা গাছের নিচে স্তূপাকার হয়ে পাকা পেয়ারা পড়ে আছে। নানা রকমের হাজার হাজার পাখি। তাদের কলকাকলিতে কান পাতা দায়। এত প্লট- তাতে প্লট অধিকারীদের নামফলক। কিন্তু বাড়ি নেই একটাও। বিশাল নদীর মতো খালের ওই প্রান্তেও প্রান্তরবিহীন সবুজ আবাসন প্রকল্প। একটু একটু করে মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল। আমার কাজই তো এই। খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন! আর তার উত্তর না পেয়ে শেষে মন খারাপ করে বসে থাকা। ঘরের ভাত খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো- আর কী। আমি ভাবছি যারা প্লট কিনল, তারা বাড়ি বানায় না কেন? ঢাকা থেকে এ স্থানটা মোটেও দূরে নয়। প্লট কিনেছে গাছ লাগাতে? এখন কেউ যদি বাড়ি বানায় তো গাছগুলো কেটে ফেলবে? তখন গাছগুলো কাদবে না। রং-চং মেখে নিজের গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছি, কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলাতে না পেরে বিরক্ত হচ্ছি। জানি এই প্রশ্নগুলো কাউকে করলেই জীবন সাথী বলবেন- তোমার এত প্রশ্ন কেন? এত প্রশ্ন তোমার করার দরকার কী? এত কথা জানতে হয় না, তুমি জানো না? এগুলো শুনব জেনেও আমি প্রশ্নগুলো আবাসন সংশ্লিষ্ট মানুষদের করে ফেলি। তখন তাঁরা আমাকে বিস্তারিত জবাব জানান। এ শতকের প্রথম দিকে তাঁদের এই আবাসন প্রকল্প জন্ম নেয়। প্রায় চার-পাঁচটি গ্রাম অধিগ্রহণ করে এর চলা শুরু হয়। এর মাঝের খালটি সরকারি। সেটার কোনো ক্ষতি না করেই তাঁরা খালটির দুই পাড় বাঁধিয়ে লেকের মতো করে নেবেন। কিন্তু আশপাশের গ্রামের লোক খুব দুষ্ট। তারা রাত করে এসে খালের আশপাশের মাটি কেটে নিয়ে যায়। ফলফলাদি গাছ-বৃক্ষ রক্ষায় তাদের প্রহরা বসাতে হয়েছে। এতে অনেক খরচ হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পরিবেশ ও আবাসন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর এ আবাসনটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে মামলা চলছে বিধায় কেউ বাড়ি করতে পারছে না। এখন সরকার বলছে, সব ভেঙেচুরে আগের মতো করে দিতে। যেমনটি আগে ছিল। ওই প্রকল্পে প্রায় লাখখানেক বৃক্ষ আছে। যারা শিকড় গেড়ে নিজেদের মতো করে পরিপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। ওখানকার ফলাদি ট্রাক ভরে ঢাকায় আসে- হাজার হাজার পাখির অভয়ারণ্য সেটা। আমি জানি না আবাসন প্রকল্পের মালিকরা কতটা দোষী। আর প্রকল্পটি ভেঙে ফেলার যুক্তিটা কতটা যুক্তিযুক্ত। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সরকার কত জমি অধিগ্রহণ করেছে- এ জীবনে তার হিসাব আমার কাছে নেই। কিন্তু তারা জমি গ্রহণ করে ন্যায্য পাওনা মেটান না কখনোই, এটা আমরা সবাই জানি। জীবনের প্রয়োজনে আবাসন সীমানা বাড়াতে হচ্ছে- তাও সত্য। এ প্রকল্পের জমিগুলোও হয়তো ন্যায়ভাবে গ্রহণ করা হয়নি, তাও সত্য। গ্রামের পর গ্রাম দখল করে প্লট বানাতে নষ্ট হয়েছে নাম না জানা, জানা দামি বৃক্ষ। কারো মন ভেঙেছে, কারো গ্রাম ভেঙেছে; কিন্তু প্লটগুলো যে জ্যামিতিক দেয়ালে গাঁথা হয়েছে, তা তো রাতের আঁধারে হয়নি। কোনো না কোনো সরকারের চোখের সামনেই এই অধিগ্রহণ, দখল হয়েছে, মাটি ভরাট হয়েছে। গাছ লাগানো হয়েছে, সীমানা বাঁধা হয়েছে, নামফলক হয়েছে, গাছে ফল ধরেছে, পাখিরা অভয়ারণ্য খুঁজে পেয়েছে, তখন সরকার কোথায় ছিল? তারা বোধ হয় তখন একদল আর একদলকে দোষারোপ করতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের অভ্যন্তরে ভীষণভাবে ব্যস্ত ছিল। থাকবেই তো- এটাই তো তাদের প্রদান কাজ। কিন্তু এখন যে মামলা চলছে তাতে সরকার ও পরিবেশ বাদীরা জিতলে? ওই গাছগুলো? যাদের দাবিই সত্য বলে প্রমাণিত হোক না কেন, গাছগুলো কিন্তু ভীষণ সত্য! ওরা কিন্তু ঢাকা শহরকে প্রচণ্ডভাবে অঙ্েিজন বিলি করে যাচ্ছে! গাছের যে খুব প্রয়োজন পরিবেশের খাতিরে আর গাছের যে প্রাণ আছে, তা জানতে কি আর জগদীশ চন্দ্র বসু হতে হয়? বীজের খোসায় ভালোই ঘুমিয়েছিল বীজের অন্তর- তাকে কেনই বা জাগানো হলো, কেনই এখন তাদের হত্যার কথা উঠছে। আমাদের সরকাররা ধারাবাহিকভাবেই এমন কেন?
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments