নদীর কান্না-তিস্তায় সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহ
হুমকিতে দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প ও জীববৈচিত্র্য পরিমল মজুমদার, রংপুর ও স্বপন চৌধুরী, গঙ্গাচড়া (রংপুর)
তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ এযাবৎকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মরে যাচ্ছে তিস্তা। উজান থেকে ভাটিতে যেখানে এসে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলেছে- এ ৩০০ কিলোমিটার নদী এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায় মরে যাচ্ছে বড় বড় গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ এযাবৎকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মরে যাচ্ছে তিস্তা। উজান থেকে ভাটিতে যেখানে এসে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলেছে- এ ৩০০ কিলোমিটার নদী এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায় মরে যাচ্ছে বড় বড় গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
অভিন্ন এই নদীর পানিতে বাংলাদেশের অধিকার থাকলেও ভারতের সঙ্গে চুক্তি না হওয়ায় এখনো অনিশ্চয়তার বরফ গলেনি। আর তাতে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমির চাষাবাদ নিয়ে দেখা দিয়েছে মারাত্মক অনিশ্চয়তা।
তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্প ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে সর্বকালের সবচেয়ে কম পানিপ্রবাহ তিস্তায় বিরাজ করছে। তিস্তা ব্যারাজে পানির প্রবাহ এক হাজার সাড়ে ৪০০ কিউসেকের আশপাশে থাকছে। গতকাল শনিবার ব্যারাজ এলাকায় পানির প্রবাহ ছিল এক হাজার ২০০ কিউসেক। অথচ এ সময় ব্যারাজের উজানে চার থেকে ছয় হাজার কিউসেক পানির প্রবাহ থাকার কথা।'
এ কর্মকর্তা জানান, কর্তৃপক্ষ ব্যারাজের সব গেট বন্ধ করে প্রতিদিনই এই পানি ঘুরিয়ে নিচ্ছে তাদের সেচ খালে। এ অবস্থায় ভাটিতে এই প্রবাহ একেবারেই কমে যাওয়ায়, এর প্রভাবে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদী মরে যাচ্ছে।
হিমালয়ের চো লামু লেক থেকে তিস্তার উৎপত্তি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় এ নদীর উৎস হওয়ায় উজানে তিস্তা ছিল উচ্ছল ও দুর্বার। ১৯৭৭ সালে উজানে পশ্চিবঙ্গের গজলডোবা নামক স্থানে ভারত একটি ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার এই দুর্বার গতিকে থামিয়ে দেয়। তিস্তার মূল স্রোতধারাকে ব্যারাজের বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে তারা উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন সেচকাজে ব্যবহার করে। গজলডোবা ব্যারেজ থেকে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়, ওই পরিমাণ পানি প্রায় ৭০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারাজে এসে পৌঁছে। তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু ফিতার আকার ধারণ করে। এরপর তিস্তা ব্যারাজের গেট খুলে মাঝেমধ্যে যে পানি দেওয়া হয়, ওই পানিতে নদীর বুক ভেজে না। কোনো রকম তির তির করে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভাটিতে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পানিপ্রবাহ কমে আসার মানে হচ্ছে- ভারত গজলডোবা ব্যারাজ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে ক্যানেলের মাধ্যমে মহানন্দা নদী দিয়ে বিহারের মেতী নদীতে নিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলার ৩৫টি উপজেলায় এই সেচ প্রকল্প থেকে বোরো মৌসুমে পানি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে ১৯৮০ সালে ব্যারাজ ও সেচ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু আগেই উজানে গজলডোবায় ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া শুরু করলে এ অঞ্চলের লাখ লাখ হেক্টর জমি এখন হুমকির মুখে। এর মধ্যে পানি পাচ্ছেন না বগুড়া ও জয়পুরহাটের কৃষকরা।
তিস্তার নাব্যতা কমে যাওয়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্পের আওতাধীন রোপা আমন নিয়ে শঙ্কায় আছেন রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারীর কৃষক। পানি স্বল্পতার কারণে এবার নীলফামারী সদর, জলঢাকা, সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ, রংপুর সদর, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, দিনাজপুরের চিরির বন্দর, পার্বতীপুর ও খানসামা উপজেলার মাত্র ৪৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাওয়ার কথা কৃষকদের। ১৫ জানুয়ারি থেকে এ সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। কারণ, নদীর পলি সংস্কারের জন্য ১৫ মার্চ কাজের শেষ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
ওই সময়ের আগে ব্যারাজ এলাকায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক হবে না বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আতিকুর রহমান।
সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা জমির মালিক নীলফামারীর চাঁপানি গ্রামের কৃষক ছোলেমান আলী বলেন, 'এবার যে কি হৈবে আল্লায় জানে। নদীত অ্যাকনাও পানি নাই।' উত্তর চাঁপানি গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি না হলে এ সেচ প্রল্পের আওতায় জমি চাষ করে লাভ নাই। চাষ করলে নিজে শ্যালো কিনে জমিতে সেচ দিতে হবে।'
প্রকল্পের মূল খালের (ক্যানেল) আশপাশের জমি কমান্ড এলাকা বলে পরিচিত। গত ২২ জানুয়ারি তিস্তার কমান্ড এলাকায় সেচ দেওয়া শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরই মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ জমিতে বোরোর চারা রোপণ করা হয়েছে। কমান্ড এলাকার কৃষক নওশাদ আলী পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতেই এ বছর তুলনামূলকভাবে পানি কম আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মার্চ মাসে যখন পানির চাহিদা বাড়বে- তখন আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০ বিঘা জমিতে বোরোর চারা লাগিয়েছেন কৃষক মাসুদ রানা। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেলে বোরোর আবাদই হবে না। ব্যয়বহুল এই আবাদ থেকে ফসল তুলতে না পারলে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে তিনি জানান।
এদিকে যেখান থেকে তিস্তা বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ কমরছে, সেখান থেকে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পর্যন্ত যেখানে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিলিত হয়েছে, এই দীর্ঘ ১৫০ কিলোমিটারের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে তিস্তা তার নাব্যতা হরিয়ে শীর্ণ, কঙ্কালসার।
নদীপারের মানুষজন জানায়, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দুই কূল ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠে তিস্তা। ঘরবাড়ি, ফসল সবকিছু উজাড় করে ফেলে। বারবার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তিস্তা পারের মানুষ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎসজীবীরা তাদের বাপ-দাদার পুরনো পেশা ছেড়ে এখন দিনমজুর কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিচ্ছে কাজের আশায়। ছোট ছোট খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বালুচর পাড়ি দিয়ে গন্তব্য কিংবা হাট-বাজার করতে হয় বলে ক্রমেই বসতি গুটিয়ে ফেলছে নদীপারের মানুষরা। ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে যারা এরপরও টিকে আছে, তারা এ-চর ও-চর করে যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছে। পাহাড়ি নদী ও স্বচ্ছ পানি হওয়ায় এ নদীতে পলি মাটির আস্তরণ পড়ে না। কিন্তু বর্ষা চলে যাওয়ার পর নদীর বুকজুড়ে বালির বিশাল আস্তরণ পড়ে। এ কারণে নদীতে চর পড়ে যাদের জমি ভেসে উঠেছে, তারা অর্থ ও উপকরণের অভাবে ফসল ফলাতে পারছে না। এভাবেই এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে চরের ঐতিহ্যবাহী ফসল বাঙ্গি, তরমুজ, সাতপুঁথি, ধনে আর মৌরি।
পানির অভাব, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জীববৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। বড় বড় গাছপালা মরে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় ভূগর্ভের গভীর থেকে অগভীর ও গভীর নলকূপ দিয়ে ব্যাপক পানি উত্তোলন করায় মাটির স্তরের মধ্যবর্তী স্থান শূন্য হয়ে বাতাস প্রবেশ করছে। ফলে ভূগর্ভে অক্সিজেনের বিস্তৃতি ঘটেছে। এই অক্সিজেন, লৌহ ও আর্সেনিক যৌগের (আর্সেনোপাইরাইট) সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে মুক্ত আর্সেনিকের সৃষ্টি হচ্ছে। এই মুক্ত আর্সেনিক-ই মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের গজলডোবায় তিস্তার ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে প্রথমে নদীর স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এরপর এর ৭০ কিলোমিটার ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করায় এর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ একেবারেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নদীর বুকে পানি না থাকায় তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর প্রভাবে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে গেছে। তিস্তার শাখা-প্রশাখাগুলো পানির অভাবে মরে যাওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায়, বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন ধরনের গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ড. আইনুন নিশাত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের পানির নাব্যতা নিয়ে বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, 'তাঁরা পানির প্রবাহ স্বাভাবিক বলতে বোঝেন- সেচ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যাচ্ছে কি না। কিন্তু নদীকে বাঁচাতে গেলে ওই প্রবাহে চলে না। নদী বাঁচে এমন পানির প্রবাহ চাই।'
নদী মরে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত দুই দেশের দুটি ব্যারাজকেই দায়ী করেন এ নদী বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, 'তিস্তাকে বাঁচাতে হলে এর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। এ জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।'
তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্প ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে সর্বকালের সবচেয়ে কম পানিপ্রবাহ তিস্তায় বিরাজ করছে। তিস্তা ব্যারাজে পানির প্রবাহ এক হাজার সাড়ে ৪০০ কিউসেকের আশপাশে থাকছে। গতকাল শনিবার ব্যারাজ এলাকায় পানির প্রবাহ ছিল এক হাজার ২০০ কিউসেক। অথচ এ সময় ব্যারাজের উজানে চার থেকে ছয় হাজার কিউসেক পানির প্রবাহ থাকার কথা।'
এ কর্মকর্তা জানান, কর্তৃপক্ষ ব্যারাজের সব গেট বন্ধ করে প্রতিদিনই এই পানি ঘুরিয়ে নিচ্ছে তাদের সেচ খালে। এ অবস্থায় ভাটিতে এই প্রবাহ একেবারেই কমে যাওয়ায়, এর প্রভাবে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদী মরে যাচ্ছে।
হিমালয়ের চো লামু লেক থেকে তিস্তার উৎপত্তি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় এ নদীর উৎস হওয়ায় উজানে তিস্তা ছিল উচ্ছল ও দুর্বার। ১৯৭৭ সালে উজানে পশ্চিবঙ্গের গজলডোবা নামক স্থানে ভারত একটি ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার এই দুর্বার গতিকে থামিয়ে দেয়। তিস্তার মূল স্রোতধারাকে ব্যারাজের বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে তারা উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন সেচকাজে ব্যবহার করে। গজলডোবা ব্যারেজ থেকে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়, ওই পরিমাণ পানি প্রায় ৭০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারাজে এসে পৌঁছে। তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু ফিতার আকার ধারণ করে। এরপর তিস্তা ব্যারাজের গেট খুলে মাঝেমধ্যে যে পানি দেওয়া হয়, ওই পানিতে নদীর বুক ভেজে না। কোনো রকম তির তির করে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভাটিতে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পানিপ্রবাহ কমে আসার মানে হচ্ছে- ভারত গজলডোবা ব্যারাজ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে ক্যানেলের মাধ্যমে মহানন্দা নদী দিয়ে বিহারের মেতী নদীতে নিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলার ৩৫টি উপজেলায় এই সেচ প্রকল্প থেকে বোরো মৌসুমে পানি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে ১৯৮০ সালে ব্যারাজ ও সেচ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু আগেই উজানে গজলডোবায় ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া শুরু করলে এ অঞ্চলের লাখ লাখ হেক্টর জমি এখন হুমকির মুখে। এর মধ্যে পানি পাচ্ছেন না বগুড়া ও জয়পুরহাটের কৃষকরা।
তিস্তার নাব্যতা কমে যাওয়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্পের আওতাধীন রোপা আমন নিয়ে শঙ্কায় আছেন রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারীর কৃষক। পানি স্বল্পতার কারণে এবার নীলফামারী সদর, জলঢাকা, সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ, রংপুর সদর, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, দিনাজপুরের চিরির বন্দর, পার্বতীপুর ও খানসামা উপজেলার মাত্র ৪৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাওয়ার কথা কৃষকদের। ১৫ জানুয়ারি থেকে এ সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। কারণ, নদীর পলি সংস্কারের জন্য ১৫ মার্চ কাজের শেষ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
ওই সময়ের আগে ব্যারাজ এলাকায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক হবে না বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আতিকুর রহমান।
সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা জমির মালিক নীলফামারীর চাঁপানি গ্রামের কৃষক ছোলেমান আলী বলেন, 'এবার যে কি হৈবে আল্লায় জানে। নদীত অ্যাকনাও পানি নাই।' উত্তর চাঁপানি গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি না হলে এ সেচ প্রল্পের আওতায় জমি চাষ করে লাভ নাই। চাষ করলে নিজে শ্যালো কিনে জমিতে সেচ দিতে হবে।'
প্রকল্পের মূল খালের (ক্যানেল) আশপাশের জমি কমান্ড এলাকা বলে পরিচিত। গত ২২ জানুয়ারি তিস্তার কমান্ড এলাকায় সেচ দেওয়া শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরই মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ জমিতে বোরোর চারা রোপণ করা হয়েছে। কমান্ড এলাকার কৃষক নওশাদ আলী পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতেই এ বছর তুলনামূলকভাবে পানি কম আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মার্চ মাসে যখন পানির চাহিদা বাড়বে- তখন আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০ বিঘা জমিতে বোরোর চারা লাগিয়েছেন কৃষক মাসুদ রানা। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেলে বোরোর আবাদই হবে না। ব্যয়বহুল এই আবাদ থেকে ফসল তুলতে না পারলে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে তিনি জানান।
এদিকে যেখান থেকে তিস্তা বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ কমরছে, সেখান থেকে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পর্যন্ত যেখানে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিলিত হয়েছে, এই দীর্ঘ ১৫০ কিলোমিটারের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে তিস্তা তার নাব্যতা হরিয়ে শীর্ণ, কঙ্কালসার।
নদীপারের মানুষজন জানায়, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দুই কূল ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠে তিস্তা। ঘরবাড়ি, ফসল সবকিছু উজাড় করে ফেলে। বারবার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তিস্তা পারের মানুষ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎসজীবীরা তাদের বাপ-দাদার পুরনো পেশা ছেড়ে এখন দিনমজুর কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিচ্ছে কাজের আশায়। ছোট ছোট খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বালুচর পাড়ি দিয়ে গন্তব্য কিংবা হাট-বাজার করতে হয় বলে ক্রমেই বসতি গুটিয়ে ফেলছে নদীপারের মানুষরা। ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে যারা এরপরও টিকে আছে, তারা এ-চর ও-চর করে যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছে। পাহাড়ি নদী ও স্বচ্ছ পানি হওয়ায় এ নদীতে পলি মাটির আস্তরণ পড়ে না। কিন্তু বর্ষা চলে যাওয়ার পর নদীর বুকজুড়ে বালির বিশাল আস্তরণ পড়ে। এ কারণে নদীতে চর পড়ে যাদের জমি ভেসে উঠেছে, তারা অর্থ ও উপকরণের অভাবে ফসল ফলাতে পারছে না। এভাবেই এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে চরের ঐতিহ্যবাহী ফসল বাঙ্গি, তরমুজ, সাতপুঁথি, ধনে আর মৌরি।
পানির অভাব, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জীববৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। বড় বড় গাছপালা মরে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় ভূগর্ভের গভীর থেকে অগভীর ও গভীর নলকূপ দিয়ে ব্যাপক পানি উত্তোলন করায় মাটির স্তরের মধ্যবর্তী স্থান শূন্য হয়ে বাতাস প্রবেশ করছে। ফলে ভূগর্ভে অক্সিজেনের বিস্তৃতি ঘটেছে। এই অক্সিজেন, লৌহ ও আর্সেনিক যৌগের (আর্সেনোপাইরাইট) সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে মুক্ত আর্সেনিকের সৃষ্টি হচ্ছে। এই মুক্ত আর্সেনিক-ই মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের গজলডোবায় তিস্তার ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে প্রথমে নদীর স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এরপর এর ৭০ কিলোমিটার ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করায় এর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ একেবারেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নদীর বুকে পানি না থাকায় তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর প্রভাবে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে গেছে। তিস্তার শাখা-প্রশাখাগুলো পানির অভাবে মরে যাওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায়, বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন ধরনের গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ড. আইনুন নিশাত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের পানির নাব্যতা নিয়ে বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, 'তাঁরা পানির প্রবাহ স্বাভাবিক বলতে বোঝেন- সেচ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যাচ্ছে কি না। কিন্তু নদীকে বাঁচাতে গেলে ওই প্রবাহে চলে না। নদী বাঁচে এমন পানির প্রবাহ চাই।'
নদী মরে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত দুই দেশের দুটি ব্যারাজকেই দায়ী করেন এ নদী বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, 'তিস্তাকে বাঁচাতে হলে এর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। এ জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।'
No comments