র‌্যাবের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা

প্রশ্নের তীর নয়, এবার সরাসরি অভিযুক্ত করা হলো এলিট ফোর্স র‌্যাবকে। অভিযোগ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, নিপীড়ন ও গুম করার। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ২০০৪ সালে যে বাহিনীর জন্ম হয়েছিল, সেই বাহিনী আজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত।


নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে র‌্যাবের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলে এই বাহিনী ভেঙে দেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে সংস্থার প্রতিবেদনে। র‌্যাবের দায়মুক্তির পাশাপাশি র‌্যাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও স্থান পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে র‌্যাব। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি), পুলিশ, কোস্টগার্ড ও আনসার-ভিডিপির সদস্যদের নিয়ে গঠিত বাহিনী প্রথম অপারেশনে যায় ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল। রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। ওই দিন তারা মাঠে নামার পর থেকেই র‌্যাব আলোচনায় চলে আসে। কয়েক বছর ধরেই আলোচিত ঘটনা হচ্ছে র‌্যাবের ক্রসফায়ার। ক্রসফায়ারের যেকোনো ঘটনায় মৃত্যুর পর একটি গল্প বলে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত যত গল্প পাওয়া গেছে সবই প্রায় একধরনের। এই ক্রসফায়ার-গল্প বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে এর নাম একসময় বদলে যায়। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ নিয়ে সোচ্চার হলেও নিজেদের মতো করে কাজ চালিয়ে গেছে র‌্যাব। ক্রসফায়ারে মৃত ব্যক্তিদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে হিউম্যান রাইটসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অনেকে বেরিয়ে আসার পর নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। র‌্যাবের নির্যাতনের সাম্প্রতিক উদাহরণ লিমন। যে কিশোরের এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, সেই কিশোর র‌্যাবের গুলিতে একটি পা হারিয়ে আজ পঙ্গু। র‌্যাব মহাপরিচালক এটাকে ভুল বলে স্বীকার করলেও লিমনকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করাটাই যেন এখন র‌্যাবের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
র‌্যাবের এই কার্যকলাপে বিগত সরকার থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারেরও সমর্থন রয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল মহলকে সব সময়ই র‌্যাবকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে। এ সমর্থনই র‌্যাবকে বেপরোয়া হতে উৎসাহ জুগিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে লিমনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের দায়িত্বশীল মহল যেভাবে র‌্যাবকে সমর্থন জুগিয়েছে, তাতে র‌্যাব যে ভবিষ্যতেও মানবাধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পিছপা হবে না, সেটাই বা কে বলতে পারে!
র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে। সেই র‌্যাব এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। র‌্যাবের ভেতরে কেউ অন্যায় করলে তার জন্য একটি বাহিনীর দুর্নাম হয়ে যায়। কিন্তু এই দুর্নাম এড়ানো সম্ভব। র‌্যাবের ভেতরে কেউ অন্যায় করলে তার শাস্তি হওয়া উচিত। শুধু বিভাগীয় তদন্ত করে নিজেদের মতো করেই ব্যাপারটির নিষ্পত্তি হওয়া উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম গোপনীয়তা না রেখে র‌্যাবের কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতা। র‌্যাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখছে না_এটা ঠিক নয়। কিন্তু সেই ভূমিকা রাখতে গিয়ে র‌্যাব মানবাধিকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না সেটাই দেখার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.