জাতিসংঘের সাত দূতের উসকানিমূলক বিবৃতি-উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী খনির কয়লা উত্তোলন by মেহেদী হাসান
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে ওই এলাকার জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাতজন বিশেষ দূত (স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার)। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এর মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
কেননা বাংলাদেশ কয়লা উত্তোলন করবে কি করবে না কিংবা করলে কী উপায়ে করবে, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একান্তই এ দেশের। অথচ নজিরবিহীন এক বিবৃতি দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাপক পরিসরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। জাতিসংঘের ওই র্যাপোর্টিয়াররা কখনো ওই দেশগুলোর ব্যাপারে এমন কোনো বিবৃতি দেননি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকলেও জাতিসংঘের ওই দূতরা এ ধরনের বিবৃতি দেন না। অথচ কয়েক হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া নিয়ে তাঁরা নজিরবিহীন উদ্বেগ দেখিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গতকাল সোমবার দুপুরে কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগ জানানো-সংক্রান্ত কোনো চিঠি জাতিসংঘ থেকে আসেনি। সেটি এলে এবং বাংলাদেশ প্রয়োজন মনে করলে তার জেনেভায় জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে জবাব দেবে। তিনি আরো বলেন, 'পুরো বিষয়টিকে বিতর্কিত করা হয়েছে। কোনো দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে তুলবে, তা একান্তই ওই দেশের ব্যাপার। আর ওই র্যাপোর্টিয়াররা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনকারী অন্য দেশগুলোর ব্যাপারে এ ধরনের কোনো বিবৃতি দেননি।'
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত বছর বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে 'আদিবাসী' আখ্যায়িত করে ইস্যু সৃষ্টির মাধ্যমে জাতিসংঘে এ দেশকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলেছিল। এবার কয়লা ইস্যুতেও বাংলাদেশকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
সূত্র আরো জানায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা করে বিবৃতি উদ্দেশ্যপূর্ণও হতে পারে। এর পেছনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কয়লা খনি কোনো দলের বিষয় নয়। এটি এ দেশের ও তার জনগণের। কয়লা খনি থেকে উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত থাকলে তা নিয়ে জাতিসংঘের কাছে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হওয়া উচিত। অভ্যন্তরীণ ও সার্বভৌম বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের কাছে গেলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকারবিষয়ক এক সেমিনারে বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্ব দায়ী হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এ দেশের আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, উন্নত বিশ্বের কারণে বাংলাদেশে এত বড় মানবাধিকার বিপর্যয়ের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বা তার স্পেশাল র্যাপোর্টিয়াররা কোনো বিবৃতি দেন না বা উদ্বেগ প্রকাশ করেন না। অথচ কয়লা খনি নিয়ে বাংলাদেশ তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।
জানা গেছে, বিশ্বের অন্তত ২৩টি দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হয়। এতে কয়লা খনির আশপাশে বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও মানবাধিকারবিষয়ক দূতরা মুখ খোলেননি। তাই বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের বিবৃতি নজিরবিহীন।
বিবৃতিতে যা আছে : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনারের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে 'বাংলাদেশ ওপেন-পিট কোল মাইন থ্রেটেনস ফান্ডামেন্টাল রাইটস, ওয়ার্ন ইউএন এক্সপার্টস' শিরোনামে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন, 'উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি খনন ইস্যুতে যেকোনো নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। নীতি প্রণয়নের আগে অন্তর্বর্তী সময়ে ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হবে না।'
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, 'জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদল সতর্ক করে বলেছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে এবং তা মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।'
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, 'খননের জন্য ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়ন করা হলে ঝুঁকির মুখে থাকা কৃষক সম্প্রদায় বাস্তুচ্যুত হবে। এ ছাড়া খনি উন্নয়নের ফলে ওই অঞ্চলের আরো কয়েক হাজার মানুষের পানির উৎস ও বাস্তুসংস্থানের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।' তাঁরা বলেছেন, ফুলবাড়ী প্রকল্পের ফলে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তুচ্যুত হবে। এ ছাড়া সেচের জন্য পানিপ্রবাহ ও কূপগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে দুই লাখ ২০ হাজার জন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, জাতীয় কয়লানীতি এ-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বিবেচনাধীন। তবে যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন এবং ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়নের অনুমতি দেওয়া হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, প্রায় ছয় হাজার হেক্টর আয়তনের ওই খনি থেকে খনন-পরবর্তী ৩৬ বছরে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা পাওয়া যেতে পারে বলা হচ্ছে। তবে এটি প্রায় ১২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ধ্বংস করবে।
বিবৃতির বাকি অংশে জাতিসংঘের সাতজন স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারের বক্তব্য স্থান পেয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার অলিভার ডি শাটার বলেছেন, 'বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং এক-চতুর্থাংশের চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। শিল্পবিষয়ক প্রকল্পের কারণে বিসর্জন নয় বরং স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন জোরদার করতে হবে।' তিনি আরো বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ ওই এলাকাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উর্বর কৃষি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। সেখানে ধান, গমের মতো খাদ্যশস্য ফলিয়ে কৃষকরা তাঁদের পরিবারের খাদ্যের জোগান দেন এবং গোটা দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়তা করেন।'
নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ক্যাটারিনা ডি আলবুকুয়ারকি বলেছেন, কৃষিজমির পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশি মৎস্য ক্ষেত্র এবং প্রায় ৫০ হাজার ফলদ গাছ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ওই এলাকায় পানির স্তর ১৫ থেকে ২৫ মিটার নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করে বলেছেন, প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার মানুষের পানি পাওয়ার অধিকার ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
আবাসনবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার র্যাকুয়েল রোলনিক ও আদিবাসীবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার জেমস আনায়া বলেছেন, সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাহিলি ও পাহান নৃগোষ্ঠীর সব গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই জনগোষ্ঠীর সম্মতি ছাড়া বাস্তুচ্যুত করা গ্রহণযোগ্য হবে না।
মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফ্র্যাংক লা রুই এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সমিতির অধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার মাইনা কিআই জানান, ফুলবাড়ী কয়লা খনি ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদকারী মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়নের ফলে তাঁদের উদ্বেগ আরো জোরালো হয়েছে।
চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ম্যাগডালিনা স্যাপালভেদা বলেন, বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় উন্নয়ন কৌশলে মানবাধিকারের নীতিমালা সংযোজন করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফুলবাড়ী কয়লা খনি উদ্যোক্তাদের প্রলুব্ধ করতে পারে। তবে পরিবেশগত বিপর্যয় ফুলবাড়ী এলাকার অনেক মানুষের জীবনে নেমে আসবে এবং তারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির শিকার হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাপক পরিসরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। জাতিসংঘের ওই র্যাপোর্টিয়াররা কখনো ওই দেশগুলোর ব্যাপারে এমন কোনো বিবৃতি দেননি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকলেও জাতিসংঘের ওই দূতরা এ ধরনের বিবৃতি দেন না। অথচ কয়েক হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া নিয়ে তাঁরা নজিরবিহীন উদ্বেগ দেখিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গতকাল সোমবার দুপুরে কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগ জানানো-সংক্রান্ত কোনো চিঠি জাতিসংঘ থেকে আসেনি। সেটি এলে এবং বাংলাদেশ প্রয়োজন মনে করলে তার জেনেভায় জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে জবাব দেবে। তিনি আরো বলেন, 'পুরো বিষয়টিকে বিতর্কিত করা হয়েছে। কোনো দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে তুলবে, তা একান্তই ওই দেশের ব্যাপার। আর ওই র্যাপোর্টিয়াররা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনকারী অন্য দেশগুলোর ব্যাপারে এ ধরনের কোনো বিবৃতি দেননি।'
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত বছর বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে 'আদিবাসী' আখ্যায়িত করে ইস্যু সৃষ্টির মাধ্যমে জাতিসংঘে এ দেশকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলেছিল। এবার কয়লা ইস্যুতেও বাংলাদেশকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
সূত্র আরো জানায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা করে বিবৃতি উদ্দেশ্যপূর্ণও হতে পারে। এর পেছনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কয়লা খনি কোনো দলের বিষয় নয়। এটি এ দেশের ও তার জনগণের। কয়লা খনি থেকে উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত থাকলে তা নিয়ে জাতিসংঘের কাছে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হওয়া উচিত। অভ্যন্তরীণ ও সার্বভৌম বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের কাছে গেলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকারবিষয়ক এক সেমিনারে বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্ব দায়ী হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এ দেশের আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, উন্নত বিশ্বের কারণে বাংলাদেশে এত বড় মানবাধিকার বিপর্যয়ের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বা তার স্পেশাল র্যাপোর্টিয়াররা কোনো বিবৃতি দেন না বা উদ্বেগ প্রকাশ করেন না। অথচ কয়লা খনি নিয়ে বাংলাদেশ তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।
জানা গেছে, বিশ্বের অন্তত ২৩টি দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হয়। এতে কয়লা খনির আশপাশে বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও মানবাধিকারবিষয়ক দূতরা মুখ খোলেননি। তাই বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের বিবৃতি নজিরবিহীন।
বিবৃতিতে যা আছে : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনারের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে 'বাংলাদেশ ওপেন-পিট কোল মাইন থ্রেটেনস ফান্ডামেন্টাল রাইটস, ওয়ার্ন ইউএন এক্সপার্টস' শিরোনামে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন, 'উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি খনন ইস্যুতে যেকোনো নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। নীতি প্রণয়নের আগে অন্তর্বর্তী সময়ে ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হবে না।'
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, 'জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদল সতর্ক করে বলেছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে এবং তা মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।'
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, 'খননের জন্য ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়ন করা হলে ঝুঁকির মুখে থাকা কৃষক সম্প্রদায় বাস্তুচ্যুত হবে। এ ছাড়া খনি উন্নয়নের ফলে ওই অঞ্চলের আরো কয়েক হাজার মানুষের পানির উৎস ও বাস্তুসংস্থানের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।' তাঁরা বলেছেন, ফুলবাড়ী প্রকল্পের ফলে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তুচ্যুত হবে। এ ছাড়া সেচের জন্য পানিপ্রবাহ ও কূপগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে দুই লাখ ২০ হাজার জন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, জাতীয় কয়লানীতি এ-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বিবেচনাধীন। তবে যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন এবং ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়নের অনুমতি দেওয়া হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, প্রায় ছয় হাজার হেক্টর আয়তনের ওই খনি থেকে খনন-পরবর্তী ৩৬ বছরে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা পাওয়া যেতে পারে বলা হচ্ছে। তবে এটি প্রায় ১২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ধ্বংস করবে।
বিবৃতির বাকি অংশে জাতিসংঘের সাতজন স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারের বক্তব্য স্থান পেয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার অলিভার ডি শাটার বলেছেন, 'বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং এক-চতুর্থাংশের চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। শিল্পবিষয়ক প্রকল্পের কারণে বিসর্জন নয় বরং স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন জোরদার করতে হবে।' তিনি আরো বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ ওই এলাকাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উর্বর কৃষি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। সেখানে ধান, গমের মতো খাদ্যশস্য ফলিয়ে কৃষকরা তাঁদের পরিবারের খাদ্যের জোগান দেন এবং গোটা দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়তা করেন।'
নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ক্যাটারিনা ডি আলবুকুয়ারকি বলেছেন, কৃষিজমির পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশি মৎস্য ক্ষেত্র এবং প্রায় ৫০ হাজার ফলদ গাছ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ওই এলাকায় পানির স্তর ১৫ থেকে ২৫ মিটার নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করে বলেছেন, প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার মানুষের পানি পাওয়ার অধিকার ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
আবাসনবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার র্যাকুয়েল রোলনিক ও আদিবাসীবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার জেমস আনায়া বলেছেন, সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাহিলি ও পাহান নৃগোষ্ঠীর সব গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই জনগোষ্ঠীর সম্মতি ছাড়া বাস্তুচ্যুত করা গ্রহণযোগ্য হবে না।
মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফ্র্যাংক লা রুই এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সমিতির অধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার মাইনা কিআই জানান, ফুলবাড়ী কয়লা খনি ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদকারী মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়নের ফলে তাঁদের উদ্বেগ আরো জোরালো হয়েছে।
চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ম্যাগডালিনা স্যাপালভেদা বলেন, বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় উন্নয়ন কৌশলে মানবাধিকারের নীতিমালা সংযোজন করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফুলবাড়ী কয়লা খনি উদ্যোক্তাদের প্রলুব্ধ করতে পারে। তবে পরিবেশগত বিপর্যয় ফুলবাড়ী এলাকার অনেক মানুষের জীবনে নেমে আসবে এবং তারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির শিকার হবে।
No comments