চরাচর-কালের সাক্ষী কালীগঞ্জের বধ্যভূমি by সাইফুল ইসলাম খান

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন। সময় বিকেল ৩টা। পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। মৃদু হিম হাওয়ায় হালকা শীতের আমেজ। শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড়ে খলাপাড়া গ্রামের লোকজন কেউবা ঘরে ফিরছে, কেউবা মাঠে কৃষিকাজে ব্যস্ত। নদীর পশ্চিম তীরস্থিত ন্যাশনাল জুট মিলের পাশের রাস্তা দিয়ে বেলা ১১টায় আর্মিদের যে গাড়িগুলো গিয়েছিল


জামালপুরের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে, তারাও কিছুক্ষণ আগে ফিরে গেছে তাদের ক্যাম্পের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি ফিরে যাওয়াতে অনেকের ভেতরেই এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস। কিন্তু হঠ্যাৎ গ্রামের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে মুহুর্মুহু ভেসে আসে গুলির শব্দ। এরপর অনেক মানুষের কান্না আর চিৎকারের শব্দ। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহব্বল গ্রামবাসী বুঝতে পারে, চলছে হত্যাযজ্ঞ। বিহব্বলতা কেটে গেলে তারা গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করে। সূর্য ডোবার আগেই জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে খলাপাড়া। কিন্তু ততক্ষণে শীতলক্ষ্যার নীল জলে বইছে রক্তের স্রোতধারা। আর ন্যাশনাল জুট মিলের বড় পুকুরপাড়ে শতাধিক লাশ, আর পুকুরের পানিতে মিশে আছে শহীদের রক্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অসংখ্য মর্মস্পর্শী ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো এ ঘটনাটি ঘটে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুরে অবস্থিত ন্যাশনাল জুট মিলের অভ্যন্তরে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে, বিজয়ের আসন্ন লগ্নে ন্যাশনাল জুট মিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদিন হত্যা করে মুক্তিকামী ১০৬ জনকে। তাঁরা সবাই ছিলেন ন্যাশনাল জুট মিলের কর্মকর্তা- কর্মচারী। মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেও তাঁরা ছিলেন মুক্তিকামী ও নানাভাবে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নভেম্বর মাসে তাঁরা ঠিক করে, মুক্তিযোদ্ধাদের শীতবস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার। কিন্তু তাঁদের এ পরিকল্পনার তথ্য পেঁৗছে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে। বধ্যভূমি থেকে ক্যাম্পের দূরত্ব ১.৫ কিলোমিটার। ঘটনার দিন একদল পাকিস্তানি সৈন্য বেলা ১১টার দিকে ন্যাশনাল জুট মিলে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করে। সেখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা না পেয়ে তারা জামালপুরের দিকে যায়। জামালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে তারা আবার ন্যাশনাল জুট মিলে ফিরে আসে। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা জুট মিলের ১০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ধরে এনে মিলের ভেতরে অবস্থিত পুকুরপাড়ে দুটি লাইনে দাঁড় করায়। এর পর বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয় লাইনে গুলিবর্ষণ। ব্রাশফায়ার করে ও পরে বেয়নেট চার্জ করে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দুইজন। বাকি ১০৪ জন সবাই শহীদ হন। শহীদদের কেউই স্থানীয় বাসিন্দা নন, সবাই দেশের অন্যান্য জেলার বাসিন্দা। সেদিনই রাতের বেলা একদল মুক্তিযোদ্ধা জুট মিলের ভেতরে প্রবেশ করে ও আহত ৩ জনকে উদ্ধার করে দালানবাজারে নিয়ে যায়। আহতরা সেখানে মারা যান। তাঁদের মধ্যে আছেন মিলের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার দিনাজপুরের আবু তালেব, টাইমকিপার আহছান উল্লাহ ও শ্যামচরণ ঘোষ। তাঁদের কবর জামালপুর বাজারের আশপাশে দেওয়া হয়। বাকি ১০১ জনের লাশ দুই দিন পুকুরপাড়ে পড়ে থাকে। দুই দিন পর মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী মিলে সব শহীদের লাশ জুট মিলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় দুটি গর্ত খনন করে গণকবর দেয়। ঠিক এ জায়গাটির ওপরই ন্যাশনাল জুট মিল কর্তৃপক্ষ ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করে স্মৃতিফলক 'শহীদ স্মরণে'। এলাকার লোকজন প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর এ বধ্যভূমির স্মৃতিফলকে গভীর শ্রদ্ধায় ফুলেল ভালোবাসা জানায়। দুই বছর ধরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের উদ্যোগে যথাযথ মর্যাদায় ১ ডিসেম্বর এ বধ্যভূমিতে শুয়ে থাকা অজানা শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের কোনো কার্যক্রম এখনো গৃহীত হয়নি। তবুও এ বধ্যভূমিতে শুয়ে থাকা অমর শহীদদের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এলাকাবাসী। তাদের চোখের ভাষায় ফুটে ওঠে, আমরা তোমাদের ভুলিনি, কখনোই ভুলব না।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.