কালের পুরাণ-ভারতের আন্না, বাংলাদেশে ঈদযাত্রীদের কান্না by সোহরাব হাসান

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের কোনো ব্যর্থতা নেই, কখনো ছিল না। তারা সব ক্ষেত্রে শতভাগ সফল। তারা ইচ্ছা করলে দেশটিকে সোনার পাতে মুড়ে দিতে পারত, জনগণকে প্রতি বেলা পোলাও-কোর্মা খাওয়াতে পারত। কিন্তু আগের সরকারের লুটপাটের কারণে সেটি করতে পারছে না। এ জন্য জনগণকে কিছুদিন কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে।


সমস্যা হলো, আগের সরকারও একই কথা বলেছে। তার আগের সরকারও। তার আগের সরকারও। এভাবে আমরা ইতিহাসের চাকা ২০১১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পেছনের দিকে নিলেও একই দৃশ্য দেখব, একই কথা শুনব।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে কয়েকজন মন্ত্রীর কিছু কিছু ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে ব্যর্থ মন্ত্রীদের সাফাইও গেয়েছেন। বলেছেন, তাঁরা দিন-রাত কাজ করছেন। সুতরাং তাঁদের ব্যর্থতাটা যেন বড় করে দেখা না হয়। কেননা ব্যর্থ ব্যর্থ বলে চিৎকার করলে ‘শত্রুর’ হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। শত্রু কে, তা তিনি খোলাসা করে না বললেও তাঁর মন্ত্রীরা, দলের নেতারা যথার্থই চিহ্নিত করে ফেলেছেন। তাঁরা বলেছেন, একশ্রেণীর সাংবাদিক ও বিরোধী দল সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশে একজন আন্না হাজারে সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
মন্ত্রীরা যে দিন-রাত কাজ করছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই কাজ জনগণের কল্যাণে না অকল্যাণে, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান লিখিত পরীক্ষা ছাড়া ২৪ হাজার লোককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। এর আগেও তাঁর সুপারিশে নাকি হাজার হাজার লোক ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। এই অদক্ষ ও যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়া চালকদের হাতে মানুষ মারা গেলে তার দায় কে নেবেন?
প্রধানমন্ত্রী সংসদে সমাপনী ভাষণে আরও বলেছেন, ‘পুরো দেশকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সমস্যা আসবে, সমাধান হবে, হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে যে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে, খানাখন্দের জন্য যানবাহন চলতে পারছে না, তা-ও কি দেশকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা বলে তিনি মনে করেন? কিংবা এই যে সারা দেশে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা সন্ত্রাস, মাস্তানি ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছে! এমন একটি অপকর্মের নাম বলা যাবে, যা বিএনপি আমলে যুবদল-ছাত্রদলের ক্যাডাররা করেছে, কিন্তু এখন ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা করছে না? নেই। খুন, চাঁদাবাজি, শিক্ষক প্রহার—সবকিছুই তারা করছে। তাহলে শত্রু তো ঘরেই খোঁজা উচিত।

২.
সাংবাদিক ইউনিয়নের ইফতার পার্টিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করুন। কিন্তু সমালোচনার নামে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবেন না। এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনাও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে দেশবাসী কী বার্তা পেল? বার্তা পেল যে মন্ত্রীরা যতই ব্যর্থ ও বিতর্কিত হোন, তাঁদের সরানো হবে না। যেমন আছে, তেমনই চলবে। সাংসদদের জন্য কী বার্তা? বেশি অধৈর্য হবেন না। সরকারের বেশি সমালোচনা করা যাবে না। দু-একটি ব্যর্থতার ঘটনা বড় করে দেখে সরকারের সাফল্য আড়াল করা যাবে না।
আসলে এই অবস্থানগত সুবিধাই আওয়ামী লীগ নিয়ে থাকে। তারা মনে করে, ‘অনগ্রসর’ জনগণ ও ‘অগ্রসর’ নাগরিক সমাজ আওয়ামী লীগকে সমর্থন না করে পারবে না। কেননা আওয়ামী লীগ বিদায় নিলে বিএনপি আসবে। দেশে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বোমাবাজি-গ্রেনেডবাজিতে বিচারক-আইনজীবী-পুলিশ মারা যাবে। বিদেশি কূটনীতিক আহত হবে। মানুষের মধ্যে মহা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। অতএব মন্ত্রী, নেতা ও কর্মী-ক্যাডাররা যত খারাপ কাজই করুক আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে যেতে হবে। বামদের অবস্থান শক্ত থাকলে না হয় বিকল্প ভাবা যেত।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষ এখনো মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তারা আস্থা রাখতে চাইছে সরকার বাকি সময়টা ভালো কিছু করবে। প্রধানমন্ত্রী সাংসদ ও দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শ তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, দলের নেতা-কর্মীদের জন্য অনেক বেশি জরুরি। তাঁদের কথায় ও আচরণে সামান্য ধৈর্যের ছাপ নেই। তাঁরা মৃদুকণ্ঠের সমালোচনাও সহ্য করতে পারেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনেক কষ্টে ৩৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। সত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে এলে দেশবাসী খুশি হতো। কিন্তু সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা যায় না। হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বিএনপি আমলে জিন্টুর ক্ষমা বেআইনি হলে আওয়ামী লীগ আমলে বিপ্লবের ক্ষমা আইনানুগ হয় কীভাবে?

৩.
এ মুহূর্তে আমরা মন্ত্রীদের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব নেব না। দেশবাসীই ঘরে বসে দেখছে, রাস্তায় নামলে দেখছে, এমনকি ঝিনাইদহে পুলিশ কর্মকর্তা মিরাজুল জীবন দিয়েও দেখেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলবেন কি, নৌপরিবহনমন্ত্রীর সড়কে কী কাজ? অন্য মন্ত্রণালয় কীভাবে চলবে, কারা গাড়ি চালাবে, কারা সেতু বানাবে, কারা কীভাবে লাইসেন্স দেবে, সে ব্যাপারে তাঁর বলার কি কোনো নৈতিক বা আইনি অধিকার আছে? তাঁর মন্ত্রণালয়াধীন লঞ্চ, স্টিমার, বন্দর কি ঠিকমতো চলছে? বুড়িগঙ্গায় যে ওয়াটার বাস নামানো হয়েছিল, সেগুলোর কী অবস্থা? ড্রেজারের অভাবে নৌপথ সচল রাখা যাচ্ছে না। নৌপরিবহনমন্ত্রী জ্ঞান অর্জনের জন্য যে এতবার বিদেশে গেলেন, কী জ্ঞান তিনি অর্জন করলেন দেশবাসী জানল না।
মন্ত্রিসভার সদস্যরা যদি এতই সফল ও সার্থক হয়ে থাকেন, তাহলে সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয় কেন? কেন জিনিসপত্রের দাম কমাতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁকেই বৈঠক করতে হয়। কেন সড়ক যোগাযোগের অর্থ বরাদ্দ এবং কাজ শুরু করতেও তাঁর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। তাহলে মন্ত্রীদের কাজ কী? শুধু হুকুম তামিল করা! সেই কাজ তো যেকোনো মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র কর্মকর্তাও করতে পারেন।
সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী চারদলীয় জোট সরকারকে দায়ী করেছেন। জোট সরকার বিদায় নিয়েছে ২০০৬ সালে। এখন ২০১১ সাল। অজুহাত দেখাবেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোনো কাজ হয়নি। প্রশ্ন হলো, গত আড়াই বছরে কেন সড়কগুলো মেরামত করা হলো না? মহাবিপর্যয়ের আগে তিনি কেন সড়কগুলো পরিদর্শন করলেন না?
সরকারের ৩৫টি মন্ত্রণালয় আছে। সবগুলো সম্পর্কে তো জনগণ অভিযোগ করছে না। গণমাধ্যমও সরকারের ঢালাও সমালোচনা করে না। বরং যেসব মন্ত্রণালয় ভালো চলছে, মন্ত্রীরা ভালো কাজ করছেন, সফলতা দেখাচ্ছেন, গণমাধ্যম সেসব মন্ত্রীর প্রশংসাই করছে। উদাহরণ হিসেবে কৃষি, খাদ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কথা বলতে পারি। তাঁদেরই পদত্যাগ দাবি করা হয়, যাঁরা পদের মর্যাদা রাখতে পারছেন না।
দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ নেই। কিন্তু মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না। শহীদ মিনারে নাগরিক সমাজ সমাবেশ ডেকে ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণের দাবি জানিয়েছে। আর কোনো কোনো মন্ত্রী হইচই করে উঠেছেন। একজন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, খদ্দর পরলেই নাকি আন্না হাজারে হওয়া যায় না। মুজিব কোট পরলেই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হওয়া যায়? যারা ব্যর্থ মন্ত্রীদের পদত্যাগ চেয়েছেন, তাঁরা কেউ সরকারের শত্রু নয়। তাঁরা চান ব্যর্থদের বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্র্রী দেশটা ভালোভাবে চালান। কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে বঞ্চিত, পীড়িত এবং সড়কের দুরবস্থার কারণে গৃহবন্দী মানুষকে শান্ত রাখা যাবে না। ঈদে বাড়ি যেতে লাখ লাখ মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে যোগাযোগ খাতের দুই মন্ত্রীর কারণে। অসহায় যাত্রীদের কান্না বা আহাজারি তাঁদের কানে পৌঁছায় না। কেননা বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে তাঁদের যেতে হয় না।

৪.
ভারতে নাগরিক আন্দোলনের নেতা আন্না হাজারের জয় হয়েছে। মনমোহন সিংয়ের সরকার তাঁর সব দাবি মেনে নিয়ে সংসদে লোকপাল বিল এনেছে, আগের বিল সংশোধন করেছে। সর্বদলীয় বৈঠক করে একটি সমাধানে এসেছে। আবার আন্না হাজারে ইস্যুতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে বিরোধী দলও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেনি। এরই নাম গণতন্ত্র।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ‘অখ্যাত ও অজ্ঞাত’ আন্না হাজারেকে চিঠি লিখে তাঁর সব দাবি মেনে নেওয়ার পর রোববার তিনি অনশন ভাঙেন। তাঁর সমর্থকেরা এটিকে জনগণের আন্দোলনের বিজয় হিসেবে দেখেছে। এর মানে সরকারের পরাজয় নয়। যেখানে জনগণের স্বার্থ জড়িত, যেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলের প্রশ্ন জড়িত সেখানে সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ—সবাই মিলে যে কাজ করা যায়, সেটি ভারত দেখিয়েছে।
ঘটনাটি বাংলাদেশে হলে কী হতো? ক্ষমতার শীর্ষ অবস্থান থেকে বলা হতো, আন্না হাজারে আবার কে? ভোট পেয়ে সংসদে আসার যোগ্যতা কি তাঁর আছে? জনগণ ভোট দিয়ে আমাদের ক্ষমতায় এনেছে, অতএব আমরা যা খুশি তাই করব। বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী এভাবে চিঠি দিয়ে দাবি মেনে নেওয়া দূরের কথা, তাঁর কথাকে আমলেই নিতেন না। সরকার পুলিশ দিয়ে তাঁর সমাবেশ ভেঙে দিত। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করত।
‘সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল’ কয়েকজন লেখক-বুদ্ধিজীবীর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঈদ উদ্যাপনের ঘোষণায় সরকারি মহল থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা শুরু হয়ে গেছে। যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, একজন মানুষও যদি ঈদ করতে বাড়ি যেতে না পারে, তিনিও শহীদ মিনারে ঈদ পালন করবেন। এটাই হয়তো ঈদে বিড়ম্বিত যাত্রীদের প্রতি মন্ত্রীর মশকরা। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি ঈদের আগে রাস্তা ঠিক করতে না পারেন, ট্রেনের সময়সূচি রক্ষা করতে না পারেন, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ না করতে পারেন, অন্তত ঘরমুখী মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।
সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা কথায় কথায় ভারতের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উদাহরণ দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ, মধ্য আয়ের দেশ ইত্যাদি হওয়ার স্বপ্ন দেখান। কিন্তু ভারতের নেতারা যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করেন, সংসদের ভেতরে-বাইরে যেভাবে গণতন্ত্র চর্চা করেন, তার ছিটেফোঁটাও যদি তাঁরা অনুসরণ করতেন, তাহলে দেশটির এ দুরবস্থা হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.