আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২৪)-আমার ক্রিকেট খেলা by আলী যাকের

আমি হয়তো আগেই বলেছি যে খেলাধুলায় আমার হাতেখড়ি গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে। এই ধূপখোলা মাঠের ডি-ফেক্টো মালিক ছিল ইস্ট এন্ড ক্লাব। ওই রকম সুন্দর ক্লাবঘর তখন আর কারো ছিল বলে মনে পড়ে না। ক্রিকেট এবং ফুটবল_উভয় খেলায়ই আমার আগ্রহ ছিল; যদিও পরবর্তী সময়ে ক্রিকেট খেলায় বেশি মনোযোগী হওয়ার ফলে কিছু


নামধাম হয়েছিল। তবে বর্ষাকালে ফুটবল খেলার আনন্দই ছিল অন্য রকম। মাঠের এখানে-সেখানে পানি জমে যেত আর আমাদের লক্ষ্য ছিল বলটাকে নিয়ে কোনোমতে সেই জলাধারে পেঁৗছে যাওয়া। সেখানে বলকে কেন্দ্র করে খেলার চেয়েও অধিক এক কসরত হতো শুরু। কে কত ভালো স্নাইড করতে পারে তা-ই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই স্নাইড করাকে আমরা স্লিপ কাটা বলতাম। মানুষের দীর্ঘজীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো একটি ঘটনা, তা যতই গুরুত্বহীন হোক না কেন, সে কখনো ভোলে না। আমার মনে পড়ে, একবার ইস্ট এন্ড ক্লাবের দুই নম্বর দলের সঙ্গে বহিরাগত কোনো এক দলের খেলা ছিল। আমাদের দলে আমার বন্ধু মোহিত লেফ্ট আউটে খেলছিল। আমি রাইট ইনে। বাঁ দিক দিয়ে বল নিয়ে তিন-চার জনকে ডজ করে মোহিত বলটা মাইনাস করল গোলমুখে। আমি এক কোণে ওই বলটিরই অপেক্ষায় ছিলাম। বলটি ত্বরিত ডান পায়ে রিসিভ করে বাঁ পায়ে গোলপোস্টের কোনাকুনি শট নিলাম। প্রতিপক্ষের গোলকিপার তার বাঁয়ে ডাইভ দিল বটে, কিন্তু বলের নাগাল পেল না। সেই বল ততক্ষণে জড়িয়ে গেছে জালে। ধূপখোলা মাঠ ঘিরে ছিল আমাদের সমর্থকরা। হৈ হৈ করে দৌড়ে এল মাঠে। আমার ওই ওজনদার দেহটি কখন সবার মাথার ওপর উঠে গেছে, আমি টেরও পাইনি। খেলা শেষে তখনকার বাংলাদেশের অগ্রণী খেলোয়াড়রা_যারা ইস্ট এন্ড ক্লাবে খেলতেন, যেমন সিরাজ ভাই, ইদ্রিস ভাই, কবির ভাই এঁরা আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, গোলটা দারুণ হয়েছে। আমরা সেই খেলায় এক গোলেই জিতেছিলাম। যেসব স্বনামধন্য খেলোয়াড়ের নাম এখানে আমি উল্লেখ করলাম, তাঁরা সবাই ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের সমবয়সী। এঁরা সবাই এখন গত হয়েছেন। বলতে গেলে অতি অল্প বয়সে। আমার খেলাধুলার ক্ষেত্রে এঁরা ছিলেন আমার গুরু এবং নিরন্তর উৎসাহদাতা। সিরাজ ভাই স্ট্রাইকার হিসেবে ওই ছোট্ট ক্লাবে খেলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান একাদশে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। অসাধারণ ড্রিবল করতেন এবং অনেক দূর থেকে গোলের দিকে বলটাকে আস্তে করে ভাসিয়ে দিতেন। রংধনুর মতো একেবারে ওপর দিকে উঠে হঠাৎ করে গোলপোস্টের সামনে এসে গোলের ভেতর ঢুকে যেত। আমরা সেইসব দিনে ওটাকে রেইনবো শট বলতাম। কবির ভাই ডিফেন্সে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেলে কারো পক্ষে তা কাটিয়ে আমাদের গোলের দিকে আসা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখন আরেকজন ছিলেন হান্নান ভাই। ইনিও আমার বড় ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন এবং খুব ভালো ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতেন। কবজির মোচড়ে অফ স্পিন করায় আমার কিছুটা খ্যাতি ছিল। হান্নান ভাই নেট প্র্যাকটিসের সময় পিচের ওপর দাগ দিয়ে বলতেন, বলটা এইখানে ফেলবে এবং তাঁর পরামর্শ যে সঠিক সেটা বোঝানোর জন্য তিনি তাঁর ব্যাটটাকে তুলে ধরতেন আর আমার ঘূর্ণির মতো বল তাঁর মিডল স্টাম্প উড়িয়ে দিত। অবশ্য এরপর যখন আমি ইস্ট এন্ড ক্লাবের প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পেলাম, তখন ব্যাটিংয়ের প্রতি আমার আগ্রহ অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল এবং ইস্ট এন্ড ক্লাবের ওপেনিং প্লেয়ার হিসেবে হাসান ভাই অর্থাৎ অভিনেতা হাসান ইমাম এবং আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে, তখন সোহরাব নামে একজন বোলার ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে তাঁর উদ্যম ফাস্ট বোলিংয়ে ঝড় তুলেছে। ঢাকার কোনো একটি দল এহেন সোহরাবকে নিয়ে আমাদের মাঠে এল ইস্ট এন্ড ক্লাবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে। তখন আর্মগার্ড, হেলমেট কিংবা শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গকে বাঁচানোর জন্য প্যাডের কথা ভাবাই যেত না। কিন্তু মনে ছিল, অদম্য সাহস এবং আকাশের মতো উঁচু প্রত্যয়। এই নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম সোহরাবের বিরুদ্ধে। মাঠে নামার আগে হাসান ভাই আমাকে পরামর্শ দিলেন_মাথায়, শরীরে, হাতে কিংবা পায়ে যেখানে যত জোরেই বল লাগুক, উইকেটকে আগলে রাখতে হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি উইকেট আগলে একেবারে সোজা ব্যাটে বল ঠেকাতে লাগলাম, যাকে বলে কপি বুক ক্রিকেট আর হাসান ভাই ডানে, বাঁয়ে মারতে লাগলেন। ওঁর কাভার ড্রাইভ দেখার মতো ছিল। ঢাকায় আসার আগে হাসান ভাই নিয়মিত বর্ধমানে এবং কলকাতায় ক্রিকেট খেলতেন। অতএব তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল সব ধরনের বল খেলার। প্রায় এক ঘণ্টা আমি রক্ষণাত্মক ক্রিকেট খেলার পর সোহরাবের একটা বাউন্সার দেখে লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। হুক শট আমার প্রিয়। আমি ডান পায়ে ভর রেখে সজোরে মিড উইকেটের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম ব্যাট। বলটা মিড উইকেট এবং স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে সোজা চলে গেল বাউন্ডারির ওপারে। আনন্দে মনটা নেচে উঠল। এই আনন্দ লিখে বোঝানো দুষ্কর। সোহরাবের দল ওই দিন ইস্ট এন্ড ক্লাবের কাছে হেরে ফিরেছিল ধূপখোলা ময়দান থেকে। (চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.