চলি্লশ বছরের বাংলাদেশ :নারীর অগ্রযাত্রা by মামুন রশীদ
Ab¨vb¨ †`‡ki g‡Zv evsjv‡`‡kI K¨vwiqvwi¯Ø ev PvKwiRxex bvix‡`i mvg‡bI Kg©‡¶‡Îi c_wU ZZ mnR ev gm„Y bq| cÖK…Zc‡¶ GKRb bvix‡K Zvi cyi“l mnKg©x ev cÖwZ‡hvMxi PvB‡Z w™^¸Y fv‡jv n‡Z nq| †`‡ki PvKwiRxex bvix‡`i mvg‡b GLbI GKwU Kv‡Pi †`qvj `„k¨gvb| †hwU bvix‡`i mî¢vebv‡K AvU‡K †i‡L‡Q| †hme bvix GB Kv‡Pi †`qvj Uc‡K ev AwZεg K‡i AMÖmi n‡Z Pvb Zv‡`i mvg‡b i‡q‡Q bvbv
cÖwZeíãKZv| Kg©‡¶‡Î ev †ckvq kxl© ch©v‡q †cuŠQv‡Z †M‡j bvix‡`i †hme `y`©kvq co‡Z nq Zv BDwbfvm©vj ev me©Rbxb| GKRb †ckvRxex wn‡m‡e Avgvi `xN© Kg©Rxe‡b bvix‡`i kxl©c‡` Avmxb nIqvi †¶‡Î `y`©kv ev `y‡f©v‡M co‡Z †`‡LwQ
স্বাধীনতা অর্জন-পরবর্তী গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১১০ মার্কিন ডলার ও দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৪ শতাংশ। তখন দেশটা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, বরং সামাজিক দিক থেকেও পিছিয়ে ছিল।
বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৭ শতাংশে। সর্বশেষ ২০১০ সালের পারিবারিক আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের হার কমে ৩১.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালে জনগণের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৬৮.৯ বছর, যা ১৯৭৪ সালে ছিল ৪৬.২ বছর। ২০১১ অর্থবছরে জনগণের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৮১৮ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এখানে দেশের অল্প কয়েকটি সাফল্য বা অগ্রগতির কথা বলা হলো মাত্র। বাংলাদেশের সাফল্য বা অগ্রগতির তালিকা আরও অনেক বড়। তবে সুখের বিষয় হলো, এ সময়ে সবচেয়ে উলেল্গখযোগ্য পরিবর্তনটি সাধিত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নে।
এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের নেপথ্যে বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, আগের তুলনায় দেশের শ্রমবাজারে নারী সমাজের অংশগ্রহণ ও তাদের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়া। বিগত বছরগুলোতে দেশে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে নারীদের কর্মসংস্থান উলেল্গখযোগ্য হারে বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে যেখানে নারীর কর্মসংস্থানের হার ছিল ৮.৪ শতাংশ, সেখানে তা ২০০৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪.৫ শতাংশে। এটি কেবল তৈরি পোশাক খাতে নারীদের কর্মসংস্থানের সুবাদেই যে সম্ভব হয়েছে সেটিই একমাত্র সত্যি নয়। বরং হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, রিয়েল এস্টেট বা আবাসন শিল্প, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং ও বীমার মতো নন-ট্র্যাডিশনাল ও বিকাশমান খাতগুলোতেও যে নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে সেটিও এক স্বীকার্য সত্য। বিশেষ করে বিগত এক দশক বা এর চেয়ে আরও কিছু বেশি সময় ধরে দেশের সেবা খাতগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে এসব খাতে নারীদের অংশগ্রহণের হার এখনও অনেক কম। তবে সেবা খাতগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু তাদের কাছ থেকে সেবা নেওয়ার চাহিদা বাড়ার সুবাদে। আর পেশিশক্তি তথা কায়িক শ্রমের চেয়ে মানসিক দিকটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই মূলত নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। অর্থাৎ নিয়োগ কর্তাদের কাছে শারীরিক শক্তির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বদৌলতে কর্মক্ষেত্রে নারীর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার বেড়ে যাওয়ার সুবাদে তাদের সামনে বেশি মূল্যের বা বেতনের অর্থাৎ নামিদামি চাকরি পাওয়ার প্রবণতাও মোটামুটি বাড়ছে। তবে সব খাতেই সমান সুযোগও যে সৃষ্টি হয়নি সেটিও বিচার্য বিষয়। এ ছাড়া সব খাতের চিত্রটাও সমান নয়। আবার খাতভিত্তিক পর্যালোচনা করলেও বৈষম্য বা অসঙ্গতি দেখা যায়। আমরা সর্বান্তঃকরণে বিভিন্ন খাতের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে নারীদের আসীন দেখতে চাইলেও এখনও তা সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে পুরুষের সঙ্গে সংখ্যাগত অনুপাত বিবেচনা করলেও আমরা দেখি যে, শীর্ষ বা নেতৃস্থানীয় পদগুলোতে নারীর অবস্থান যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ে সমাসীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না বাংলাদেশের নারীদের। এর নেপথ্যে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথম ও প্রধান কারণ হলো, শীর্ষ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় বেশিসংখ্যক নারী না থাকা, তা অফিস প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠন যেটাই হোক। দ্বিতীয়ত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের হার বাড়লেও কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। মাধ্যমিক বা এসএসসি পর্যন্ত পুরুষের চেয়ে নারীর শিক্ষার হার বেশি। কিন্তু এরপরই তা কমতে থাকে। এভাবে উচ্চশিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে দক্ষ নারীর সংখ্যা কমে যায়। মোট নারী শ্রমশক্তির মাত্র ১.৩৯ শতাংশের পোস্টগ্র্যাজুয়েট বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। তৃতীয়ত, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা এখনও পর্যন্ত পুরুষের তুলনায় বেশি কমই বৈকি। দেশের বর্তমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর অনুপাত হলো ৩ :১। এ ছাড়া নারীদের বেকারত্বের হারও পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি। যেখানে ৭.৫ শতাংশ নারী বেকার, সেখানে পুরুষ বেকারত্বের হার হলো ৪.৩ শতাংশ। চতুর্থত, পুরুষের তুলনায় নারীরাই কম বেতনের বা মজুরির চাকরি বা কাজ করে থাকে। দেশে নারীরা গড়ে পুরুষের ৭০ শতাংশ পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। পুরুষের তুলনায় নারীদের কম বেতন বা মজুরি পাওয়ার কারণ হলো, তাদের বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক খাত ও তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করেন বলে। নারীদের মোট কর্মস্থানের ৮৫.৬৯ শতাংশই কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে।
শুধু বাংলাদেশেই চাকরির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ বা উপস্থিতির হার কম নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ-প্রবণতাও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও একজন সার্বক্ষণিক নারী শ্রমিক যে পরিমাণ আয় করেন তা একজন সার্বক্ষণিক পুরুষ শ্রমিকের আয়ের ৮০ শতাংশের সমান। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের আয় ২০ শতাংশ কম হয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণেই এ ধরনের বৈষম্য হয়ে থাকে। সন্তান প্রসবজনিত কারণে নারীদের বেশ কিছু সময় কাজের বাইরে থাকতে হয় বলে তাদের মাতৃত্ব ও ক্যারিয়ার বা কর্মজীবন নিয়ে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়। এমনকি অনেক উন্নতশীল দেশেও চাকরির বাজারে টিকে থাকার জন্য বহু নারী মাতৃত্ব বিসর্জন দেন ও বিয়ে করা থেকে বিরত থাকেন। এ ধরনের প্রবণতা কিন্তু মানবসভ্যতার জন্য বাস্তব কিংবা আকাঙ্ক্ষিত সমাধান নয়। সুতরাং অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্যারিয়ারিস্ট বা চাকরিজীবী নারীদের সামনেও কর্মক্ষেত্রের পথটি তত সহজ বা মসৃণ নয়। প্রকৃতপক্ষে একজন নারীকে তার পুরুষ সহকর্মী বা প্রতিযোগীর চাইতে দ্বিগুণ ভালো হতে হয়। দেশের চাকরিজীবী নারীদের সামনে এখনও একটি কাচের দেয়াল দৃশ্যমান। যেটি নারীদের সম্ভাবনাকে আটকে রেখেছে। যেসব নারী এই কাচের দেয়াল টপকে বা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে চান তাদের সামনে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। কর্মক্ষেত্রে বা পেশায় শীর্ষ পর্যায়ে পেঁৗছাতে গেলে নারীদের যেসব দুর্দশায় পড়তে হয় তা ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন। একজন পেশাজীবী হিসেবে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে নারীদের শীর্ষপদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে দুর্দশা বা দুর্ভোগে পড়তে দেখেছি। এবারে আমি নারীদের পেশা বিষয়ে কিছু পরামর্শ তুলে ধরছি :
প্রথমত, সরবরাহ বা জোগান ঘাটতি। নারীদের সামনে জ্ঞান অর্জন ও অনুধাবন বা বোঝাপড়ার সুযোগ খুবই সীমিত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু সফল নারী থাকলেও তাদের সংখ্যা প্রত্যাশা ও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য, যারা পেশাগত উন্নয়নের আশায় উন্মুখ থাকা নারীদের নির্দেশনা ও উপদেশ দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষেত্রে সাধারণত নারীদের জন্য পরামর্শদাতার অভাব আছে। সে জন্য নিয়োগকর্তাদের নারী পরামর্শক নেওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু এ ধরনের একটি নেতৃত্বের মডেল বসিয়ে দেওয়ার চেয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তৃতীয়ত, নারীদের জন্য একটি লেভেল পেল্গয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে বা সংগঠনে পুরুষদের মতো নারীদেরও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারী ও নেতৃত্ব নিয়ে যাতে অসচেতনভাবে অনুমান, দুর্বলতা, পক্ষপাতের কারণে কোনো কিছু না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। চতুর্থত, আমাদের অবশ্যই অনুমার্নিনর্ভর কার্যক্রম সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন_ নারীদের নতুন কোনো কাজ, দায়িত্ব ও পদোন্নতি দেওয়া বা অফার করার আগে এবং তাদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা না করে নিছক অনুমানের ভিত্তিতে এমনটা ভাবা বা করা উচিত হবে না যে, তারা তা করতে পারবেন না। পঞ্চমত, নারীদের তাদের কাজ করার পূর্ণ ক্ষমতা ও সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের উচিত হবে, নারীদের বর্তমান দায়িত্বের সঙ্গে বা এর আওতায় নতুন কোনো কাজ ও প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া। যাতে তারা নিজেদের সামর্থ্য, সক্ষমতা, বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বৃহত্তর দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা-দক্ষতা প্রমাণ করার সুযোগ পান। ষষ্ঠত, আমাদের অবশ্যই নারীদের দেওয়া আইডিয়া বা ধারণাগুলোও আমলে নিতে হবে। কারণ, পুরুষ সহকর্মীরা অনেক ক্ষেত্রেই নারী সহকর্মীদের ধারণাগুলোকে খাটো করে দেখেন বা অবমূল্যায়ন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ_ কোনো মিটিং বা সভাগুলোতে সাধারণত কোনো নারী কর্মকর্তা বা সহকর্মীর কথা ততক্ষণ পর্যন্ত শোনা হয় না, যতক্ষণ কোনো পুরুষ সহকর্মী একই কথা বলেন এবং সেটাকে নিজের পরামর্শ বা উপদেশ বলে দাবি করেন। সে জন্য যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের অভিমত বা পরামর্শ-উপদেশ গ্রহণে বৈষম্য করা হয় বা ঔদাসীন্য দেখানো হয় এবং তাদের সক্ষমতাকে আমলে নেওয়া হয় না, সেখানে আমাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ করা বাঞ্ছনীয়।
সপ্তমত, নারীর মাতৃত্ব ও পেশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা বেশ কঠিন। সে জন্য নারীকে তার পেশা ও মাতৃত্বের তথা সন্তান-সন্ততি নেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার সুযোগ দেওয়া উচিত আমাদের। চাকরি বা কাজের ধরনেই নারীর জন্য এমন শ্রদ্ধামূলক ব্যবস্থা থাকা দরকার, যা তার পেশা ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয়। এর বিনিময়ে তারাও সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে কয়েকগুণ বেশি প্রতিদান দিতে পারে। আমরা প্রায়শই চাকরিজীবী নারীদের মাতৃত্ব ও পেশা নিয়ে উভয় সংকট পড়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকি। কর্মজীবী নারীরা যখন মাতৃত্বজনিত ছুটি শেষে কাজে যোগ দেয়, ওই সময়ে তাদের জন্য আমরা কর্মসূচি হাতে নিতে পারি, যা তাদের বেশ কাজে আসবে। কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো নারীরা মাতৃত্বজনিত ছুটিতে থাকার সময়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুবই ভালো ধারণা। শেষত, পুরুষ সহকর্মীদের উচিত নারী সহকর্মীদের পরামর্শ দেওয়া। পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে সময়ে সময়ে ভালো পরামর্শ পেলে মেধাবী নারীরা বুঝতে পারেন সুযোগ পেলে তা কীভাবে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কাজে লাগানো যায়। কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে নারী ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য পুরুষ ও নারীদের নিয়ে একটি ফোকাস গ্রুপ বা ডাইভারসিটি চ্যাম্পিয়ন দল থাকতে পারে। এগুলোই শুধু চাকরিজীবী নারীদের জন্য অকাট্য পরামর্শ নয়। এর বাইরেও তাদের আরও অনেক ইস্যু আছে। চাকরিজীবী নারীরা পরিবারে ও সমাজে সচরাচর যেসব দুর্দশার মুখোমুখি হন তা নিয়ে আমি আলোচনা করিনি। তবে এ ক্ষেত্রে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, নারীরা কর্মক্ষেত্রের চেয়ে পরিবার ও সমাজে কম দুর্দশা বা সমস্যায় পড়েন না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই তা চোখে পড়ে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীর ক্ষমতায়নে সহযোগিতা করাটা কিন্তু নারীর জন্য কোনো পক্ষপাত বা আনুকূল্য নয়। বরং এটি হলো আমাদের নিজেদেরই এবং প্রকারান্তরে জাতিকেই সহযোগিতা বা আনুকূল্য প্রদানের শামিল। কারণ, এর ফলে একদিন নারীর কর্মস্থল ও দেশ দুটিই উপকৃত হয়। বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের এক হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের হার বাড়িয়ে পুরুষের সমান পর্যায়ে উন্নীত করা হলে তাতে বিভিন্ন দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) উলেল্গখযোগ্য হারে বাড়বে। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার এই হার ইতালিতে ২১ শতাংশ, স্পেনে ১৯ শতাংশ, জাপানে ১৬ শতাংশ, আমেরিকা, ফ্রান্স ও জার্মানিতে ৯ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৮ শতাংশ হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে নারীদের অবদান হিসাবে ধরলে বা বিবেচনায় নিলে যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে খুব শিগগির দুই অঙ্কের কোটায় উন্নীত হবে তা সবাই ধারণা করতে পারেন।
এ কথা স্বীকার করতে হবে, এ দেশের নারীদের মধ্যেও এখন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের ক্যারিয়ার বা পেশাগত উন্নতি সাধন ও নেতৃত্বের আসনে বসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। এসব দৃঢ়প্রত্যয়ী নারীর আছে ১৫০ শতাংশ প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি প্রমাণের জন্য তারা অতিরিক্ত কাজ করতে পারেন। তাদের মধ্যে যেমন আনুগত্য আছে তেমনি অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করে উপরের দিকে ওঠার আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠেই নয়, বরং এসবের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও পুরুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশের নারী। সে ক্ষেত্রেও রয়েছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে অনেক নতুন উদাহরণ।
বাংলাদেশের অগণিত নারী উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ যারা অতীতাশ্রয়ী না হয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের পানে কাজ করে যাচ্ছেন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন কর্মক্ষেত্র এবং পরিবারের মধ্যে একটি সম্ভাব্য ভারসাম্য আনতে, তাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সবাই 'জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে'।
মামুন রশীদ :ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও পরিচালক
স্বাধীনতা অর্জন-পরবর্তী গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১১০ মার্কিন ডলার ও দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৪ শতাংশ। তখন দেশটা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, বরং সামাজিক দিক থেকেও পিছিয়ে ছিল।
বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৭ শতাংশে। সর্বশেষ ২০১০ সালের পারিবারিক আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের হার কমে ৩১.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালে জনগণের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৬৮.৯ বছর, যা ১৯৭৪ সালে ছিল ৪৬.২ বছর। ২০১১ অর্থবছরে জনগণের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৮১৮ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এখানে দেশের অল্প কয়েকটি সাফল্য বা অগ্রগতির কথা বলা হলো মাত্র। বাংলাদেশের সাফল্য বা অগ্রগতির তালিকা আরও অনেক বড়। তবে সুখের বিষয় হলো, এ সময়ে সবচেয়ে উলেল্গখযোগ্য পরিবর্তনটি সাধিত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নে।
এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের নেপথ্যে বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, আগের তুলনায় দেশের শ্রমবাজারে নারী সমাজের অংশগ্রহণ ও তাদের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়া। বিগত বছরগুলোতে দেশে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে নারীদের কর্মসংস্থান উলেল্গখযোগ্য হারে বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে যেখানে নারীর কর্মসংস্থানের হার ছিল ৮.৪ শতাংশ, সেখানে তা ২০০৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪.৫ শতাংশে। এটি কেবল তৈরি পোশাক খাতে নারীদের কর্মসংস্থানের সুবাদেই যে সম্ভব হয়েছে সেটিই একমাত্র সত্যি নয়। বরং হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, রিয়েল এস্টেট বা আবাসন শিল্প, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং ও বীমার মতো নন-ট্র্যাডিশনাল ও বিকাশমান খাতগুলোতেও যে নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে সেটিও এক স্বীকার্য সত্য। বিশেষ করে বিগত এক দশক বা এর চেয়ে আরও কিছু বেশি সময় ধরে দেশের সেবা খাতগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে এসব খাতে নারীদের অংশগ্রহণের হার এখনও অনেক কম। তবে সেবা খাতগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু তাদের কাছ থেকে সেবা নেওয়ার চাহিদা বাড়ার সুবাদে। আর পেশিশক্তি তথা কায়িক শ্রমের চেয়ে মানসিক দিকটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই মূলত নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। অর্থাৎ নিয়োগ কর্তাদের কাছে শারীরিক শক্তির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বদৌলতে কর্মক্ষেত্রে নারীর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার বেড়ে যাওয়ার সুবাদে তাদের সামনে বেশি মূল্যের বা বেতনের অর্থাৎ নামিদামি চাকরি পাওয়ার প্রবণতাও মোটামুটি বাড়ছে। তবে সব খাতেই সমান সুযোগও যে সৃষ্টি হয়নি সেটিও বিচার্য বিষয়। এ ছাড়া সব খাতের চিত্রটাও সমান নয়। আবার খাতভিত্তিক পর্যালোচনা করলেও বৈষম্য বা অসঙ্গতি দেখা যায়। আমরা সর্বান্তঃকরণে বিভিন্ন খাতের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে নারীদের আসীন দেখতে চাইলেও এখনও তা সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে পুরুষের সঙ্গে সংখ্যাগত অনুপাত বিবেচনা করলেও আমরা দেখি যে, শীর্ষ বা নেতৃস্থানীয় পদগুলোতে নারীর অবস্থান যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ে সমাসীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না বাংলাদেশের নারীদের। এর নেপথ্যে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথম ও প্রধান কারণ হলো, শীর্ষ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় বেশিসংখ্যক নারী না থাকা, তা অফিস প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠন যেটাই হোক। দ্বিতীয়ত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের হার বাড়লেও কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। মাধ্যমিক বা এসএসসি পর্যন্ত পুরুষের চেয়ে নারীর শিক্ষার হার বেশি। কিন্তু এরপরই তা কমতে থাকে। এভাবে উচ্চশিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে দক্ষ নারীর সংখ্যা কমে যায়। মোট নারী শ্রমশক্তির মাত্র ১.৩৯ শতাংশের পোস্টগ্র্যাজুয়েট বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। তৃতীয়ত, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা এখনও পর্যন্ত পুরুষের তুলনায় বেশি কমই বৈকি। দেশের বর্তমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর অনুপাত হলো ৩ :১। এ ছাড়া নারীদের বেকারত্বের হারও পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি। যেখানে ৭.৫ শতাংশ নারী বেকার, সেখানে পুরুষ বেকারত্বের হার হলো ৪.৩ শতাংশ। চতুর্থত, পুরুষের তুলনায় নারীরাই কম বেতনের বা মজুরির চাকরি বা কাজ করে থাকে। দেশে নারীরা গড়ে পুরুষের ৭০ শতাংশ পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। পুরুষের তুলনায় নারীদের কম বেতন বা মজুরি পাওয়ার কারণ হলো, তাদের বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক খাত ও তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করেন বলে। নারীদের মোট কর্মস্থানের ৮৫.৬৯ শতাংশই কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে।
শুধু বাংলাদেশেই চাকরির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ বা উপস্থিতির হার কম নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ-প্রবণতাও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও একজন সার্বক্ষণিক নারী শ্রমিক যে পরিমাণ আয় করেন তা একজন সার্বক্ষণিক পুরুষ শ্রমিকের আয়ের ৮০ শতাংশের সমান। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের আয় ২০ শতাংশ কম হয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণেই এ ধরনের বৈষম্য হয়ে থাকে। সন্তান প্রসবজনিত কারণে নারীদের বেশ কিছু সময় কাজের বাইরে থাকতে হয় বলে তাদের মাতৃত্ব ও ক্যারিয়ার বা কর্মজীবন নিয়ে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়। এমনকি অনেক উন্নতশীল দেশেও চাকরির বাজারে টিকে থাকার জন্য বহু নারী মাতৃত্ব বিসর্জন দেন ও বিয়ে করা থেকে বিরত থাকেন। এ ধরনের প্রবণতা কিন্তু মানবসভ্যতার জন্য বাস্তব কিংবা আকাঙ্ক্ষিত সমাধান নয়। সুতরাং অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্যারিয়ারিস্ট বা চাকরিজীবী নারীদের সামনেও কর্মক্ষেত্রের পথটি তত সহজ বা মসৃণ নয়। প্রকৃতপক্ষে একজন নারীকে তার পুরুষ সহকর্মী বা প্রতিযোগীর চাইতে দ্বিগুণ ভালো হতে হয়। দেশের চাকরিজীবী নারীদের সামনে এখনও একটি কাচের দেয়াল দৃশ্যমান। যেটি নারীদের সম্ভাবনাকে আটকে রেখেছে। যেসব নারী এই কাচের দেয়াল টপকে বা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে চান তাদের সামনে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। কর্মক্ষেত্রে বা পেশায় শীর্ষ পর্যায়ে পেঁৗছাতে গেলে নারীদের যেসব দুর্দশায় পড়তে হয় তা ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন। একজন পেশাজীবী হিসেবে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে নারীদের শীর্ষপদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে দুর্দশা বা দুর্ভোগে পড়তে দেখেছি। এবারে আমি নারীদের পেশা বিষয়ে কিছু পরামর্শ তুলে ধরছি :
প্রথমত, সরবরাহ বা জোগান ঘাটতি। নারীদের সামনে জ্ঞান অর্জন ও অনুধাবন বা বোঝাপড়ার সুযোগ খুবই সীমিত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু সফল নারী থাকলেও তাদের সংখ্যা প্রত্যাশা ও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য, যারা পেশাগত উন্নয়নের আশায় উন্মুখ থাকা নারীদের নির্দেশনা ও উপদেশ দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষেত্রে সাধারণত নারীদের জন্য পরামর্শদাতার অভাব আছে। সে জন্য নিয়োগকর্তাদের নারী পরামর্শক নেওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু এ ধরনের একটি নেতৃত্বের মডেল বসিয়ে দেওয়ার চেয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তৃতীয়ত, নারীদের জন্য একটি লেভেল পেল্গয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে বা সংগঠনে পুরুষদের মতো নারীদেরও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারী ও নেতৃত্ব নিয়ে যাতে অসচেতনভাবে অনুমান, দুর্বলতা, পক্ষপাতের কারণে কোনো কিছু না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। চতুর্থত, আমাদের অবশ্যই অনুমার্নিনর্ভর কার্যক্রম সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন_ নারীদের নতুন কোনো কাজ, দায়িত্ব ও পদোন্নতি দেওয়া বা অফার করার আগে এবং তাদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা না করে নিছক অনুমানের ভিত্তিতে এমনটা ভাবা বা করা উচিত হবে না যে, তারা তা করতে পারবেন না। পঞ্চমত, নারীদের তাদের কাজ করার পূর্ণ ক্ষমতা ও সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের উচিত হবে, নারীদের বর্তমান দায়িত্বের সঙ্গে বা এর আওতায় নতুন কোনো কাজ ও প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া। যাতে তারা নিজেদের সামর্থ্য, সক্ষমতা, বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বৃহত্তর দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা-দক্ষতা প্রমাণ করার সুযোগ পান। ষষ্ঠত, আমাদের অবশ্যই নারীদের দেওয়া আইডিয়া বা ধারণাগুলোও আমলে নিতে হবে। কারণ, পুরুষ সহকর্মীরা অনেক ক্ষেত্রেই নারী সহকর্মীদের ধারণাগুলোকে খাটো করে দেখেন বা অবমূল্যায়ন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ_ কোনো মিটিং বা সভাগুলোতে সাধারণত কোনো নারী কর্মকর্তা বা সহকর্মীর কথা ততক্ষণ পর্যন্ত শোনা হয় না, যতক্ষণ কোনো পুরুষ সহকর্মী একই কথা বলেন এবং সেটাকে নিজের পরামর্শ বা উপদেশ বলে দাবি করেন। সে জন্য যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের অভিমত বা পরামর্শ-উপদেশ গ্রহণে বৈষম্য করা হয় বা ঔদাসীন্য দেখানো হয় এবং তাদের সক্ষমতাকে আমলে নেওয়া হয় না, সেখানে আমাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ করা বাঞ্ছনীয়।
সপ্তমত, নারীর মাতৃত্ব ও পেশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা বেশ কঠিন। সে জন্য নারীকে তার পেশা ও মাতৃত্বের তথা সন্তান-সন্ততি নেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার সুযোগ দেওয়া উচিত আমাদের। চাকরি বা কাজের ধরনেই নারীর জন্য এমন শ্রদ্ধামূলক ব্যবস্থা থাকা দরকার, যা তার পেশা ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয়। এর বিনিময়ে তারাও সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে কয়েকগুণ বেশি প্রতিদান দিতে পারে। আমরা প্রায়শই চাকরিজীবী নারীদের মাতৃত্ব ও পেশা নিয়ে উভয় সংকট পড়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকি। কর্মজীবী নারীরা যখন মাতৃত্বজনিত ছুটি শেষে কাজে যোগ দেয়, ওই সময়ে তাদের জন্য আমরা কর্মসূচি হাতে নিতে পারি, যা তাদের বেশ কাজে আসবে। কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো নারীরা মাতৃত্বজনিত ছুটিতে থাকার সময়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুবই ভালো ধারণা। শেষত, পুরুষ সহকর্মীদের উচিত নারী সহকর্মীদের পরামর্শ দেওয়া। পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে সময়ে সময়ে ভালো পরামর্শ পেলে মেধাবী নারীরা বুঝতে পারেন সুযোগ পেলে তা কীভাবে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কাজে লাগানো যায়। কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে নারী ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য পুরুষ ও নারীদের নিয়ে একটি ফোকাস গ্রুপ বা ডাইভারসিটি চ্যাম্পিয়ন দল থাকতে পারে। এগুলোই শুধু চাকরিজীবী নারীদের জন্য অকাট্য পরামর্শ নয়। এর বাইরেও তাদের আরও অনেক ইস্যু আছে। চাকরিজীবী নারীরা পরিবারে ও সমাজে সচরাচর যেসব দুর্দশার মুখোমুখি হন তা নিয়ে আমি আলোচনা করিনি। তবে এ ক্ষেত্রে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, নারীরা কর্মক্ষেত্রের চেয়ে পরিবার ও সমাজে কম দুর্দশা বা সমস্যায় পড়েন না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই তা চোখে পড়ে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীর ক্ষমতায়নে সহযোগিতা করাটা কিন্তু নারীর জন্য কোনো পক্ষপাত বা আনুকূল্য নয়। বরং এটি হলো আমাদের নিজেদেরই এবং প্রকারান্তরে জাতিকেই সহযোগিতা বা আনুকূল্য প্রদানের শামিল। কারণ, এর ফলে একদিন নারীর কর্মস্থল ও দেশ দুটিই উপকৃত হয়। বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের এক হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের হার বাড়িয়ে পুরুষের সমান পর্যায়ে উন্নীত করা হলে তাতে বিভিন্ন দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) উলেল্গখযোগ্য হারে বাড়বে। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার এই হার ইতালিতে ২১ শতাংশ, স্পেনে ১৯ শতাংশ, জাপানে ১৬ শতাংশ, আমেরিকা, ফ্রান্স ও জার্মানিতে ৯ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৮ শতাংশ হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে নারীদের অবদান হিসাবে ধরলে বা বিবেচনায় নিলে যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে খুব শিগগির দুই অঙ্কের কোটায় উন্নীত হবে তা সবাই ধারণা করতে পারেন।
এ কথা স্বীকার করতে হবে, এ দেশের নারীদের মধ্যেও এখন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের ক্যারিয়ার বা পেশাগত উন্নতি সাধন ও নেতৃত্বের আসনে বসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। এসব দৃঢ়প্রত্যয়ী নারীর আছে ১৫০ শতাংশ প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি প্রমাণের জন্য তারা অতিরিক্ত কাজ করতে পারেন। তাদের মধ্যে যেমন আনুগত্য আছে তেমনি অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করে উপরের দিকে ওঠার আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠেই নয়, বরং এসবের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও পুরুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশের নারী। সে ক্ষেত্রেও রয়েছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে অনেক নতুন উদাহরণ।
বাংলাদেশের অগণিত নারী উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ যারা অতীতাশ্রয়ী না হয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের পানে কাজ করে যাচ্ছেন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন কর্মক্ষেত্র এবং পরিবারের মধ্যে একটি সম্ভাব্য ভারসাম্য আনতে, তাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সবাই 'জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে'।
মামুন রশীদ :ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও পরিচালক
No comments