ইউরোপের চিঠি-মার্কিন ঋণসংকট: পেছন ফিরে দেখা by পিটার কাস্টার্স

আর্থিক বাজারে সংকট ঘনীভূত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী কারণে আজকের অবস্থায় নিপতিত হলো, তা বিশ্লেষণে গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ৩১ জুলাই কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সদস্যরা ওয়াশিংটন সরকারের তথাকথিত ‘ঋণখেলাপি’ হওয়া ঠেকানোর উদ্দেশ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছান।


কয়েক মাসের লাগসই আলোচনা চলার পর এই অনানুষ্ঠানিক মতৈক্য হয়। তার পরের দুই দিনের মধ্যে মার্কিন প্রতিনিধি সভা ও সিনেটে এটা পাস হয়। আর যে দিনটিতে (২ আগস্ট) যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ঋণের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়, সেদিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সর্বোচ্চ সীমা বাড়ানোর বিলে স্বাক্ষর করেন। ওয়াশিংটনে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। তবু চুক্তিটি সঙ্গে সঙ্গে বহু দিক থেকে প্রশ্নের মুখে পড়ে—সরকারি ঋণমুক্তির প্রধান বোঝা শ্রমজীবী মানুষের ওপর চাপানোর অভিযোগের পাশাপাশি আরও অনেক প্রশ্ন ওঠে। ঋণসীমা আগের চেয়ে ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়ানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা আবারও রিপাবলিকানদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে মেনে নিয়েছেন, দেশের অতি সম্পদশালী ব্যক্তি ও করপোরেশনগুলোর করের পরিমাণ বাড়ানো হবে না। আলোচনায় উভয় দলের কংগ্রেস সদস্যরা সরকারের বাজেটে আংশিক ভারসাম্য ফেরানোর লক্ষ্যে ব্যয়সংকোচনের ব্যাপারে একমত হন। বাজেট ব্যয় হ্রাসের ক্ষেত্রে গরিবের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে—পক্ষপাতিত্ব ধনীদের প্রতি। বাজেট হ্রাসের তিন-চতুর্থাংশই সামাজিক কর্মসূচি, যেমন—স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ এমন বিস্ময়কর পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে যত্নবান বিশ্লেষণ খুব কম। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তাই এর ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যেমন দরকার, তেমনি এ ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টিও প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গত শতকের আশির দশক থেকে শুরু করাই ভালো। তখন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের হাতে। তাঁর শাসনের সূচনাতেই ১৯৮১ সালে তথাকথিত ‘কর বিপ্লব’ ঘটানো হয়। এ কুখ্যাত পদক্ষেপ নাগরিকদের আয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। অতিসম্পদশালী ব্যক্তিরা কর কমানোর ফলে লাভবান হয়; আর সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে কাটছাঁট শুরু হয়। রিগ্যানের বাজেটীয় পদক্ষেপগুলোয় পক্ষপাতিত্ব খুব স্পষ্ট ছিল। তথাপি কোনো ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট পাওয়া যায়নি, বরং তাঁর শাসনকালে বাজেট-ঘাটতি ক্রমাগত নাটকীয় হারে বেড়েছে। আগের কয়েক দশকের চেয়ে দ্রুত বাজেট-ঘাটতি বাড়ছিল। মার্কিন অর্থ দপ্তরের পরিসংখ্যানে এর স্বীকৃতি মেলে: যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ ১৯৮২ সালে যেখানে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে রিগ্যানের মেয়াদ শেষে ১৯৮৯ সালে তা আড়াই গুণ বেড়ে প্রায় ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়নে দাঁড়ায়। ঋণের পরিমাণ এত বিপুল পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রতিবছর সামরিক বাজেট বেড়েছে। মজার ব্যাপার হলো, কংগ্রেসে সাম্প্রতিক দেনদরবারে ওবামার অর্থ দপ্তরের সেনাপতি গাইটনার রিপাবলিকান সদস্যদের বোঝাতে গিয়ে সুবিধামতো দোহাই দিচ্ছিলেন সিকি শতাব্দী আগে ঋণসীমা বাড়ানোর জন্য রোনাল্ড রিগ্যানের আবেদনটির। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থায় আসার পেছনে যে নকশা কাজ করেছে, সেটা রিগ্যানই গড়ে দিয়েছিলেন।
কংগ্রেস সদস্যদের দেনদরবারে আরেকটি আয়রনি আছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করেছেন, দুই অঙ্কের ঘাটতি ব্যয়ের মাধ্যমে—সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে—অথচ বিরোধী রিপাবলিকানদলীয় কংগ্রেস সদস্যরাই সবচেয়ে জোরালোভাবে বলেছেন বার্ষিক বাজেটে ভারসাম্য আনা দরকার। গত ৩০ বছরে বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালের তুলনা করলে দেখা যায়, কোনো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টই অর্থ ব্যয়ে হিসাবি ছিলেন না। উল্টোটাই বরং সত্যি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাজেটে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার একমাত্র চেষ্টা করা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে, ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ে। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট দেখা গেলেও ২০০১ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঋণ দ্রুত বাড়তে থাকে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপরিশোধিত ঋণ ছিল প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন, অথচ ২০০৯ সালে বুশ ক্ষমতা ছাড়ার সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ ট্রিলিয়নে। সরকারি ঋণ দ্রুত বাড়ার কারণও ছিল স্পষ্ট। তখন রিপাবলিকান নীতিনির্ধারণে প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল: উচ্চ আয় শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের কর হ্রাস, আর সেই সঙ্গে মার্কিন সেনাবাহিনী ও মার্কিন যুদ্ধে বরাদ্দের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি। বর্ধিত ঋণের সমস্যা তখনো অনেকাংশে সমরতন্ত্রের প্রতি সরকারি ঝোঁকের কারণে উদ্দীপিত হয়।
বাজেটে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে রিপাবলিকান এজেন্ডা স্পষ্টতই যথেষ্ট আত্মসমালোচনামূলক নয়, তবে অর্থনীতিতে প্রণোদনা সৃষ্টি করতে সামরিক বরাদ্দ কাজে লাগানো রিপাবলিকানদের একচেটিয়া ব্যাপার নয়। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়ে সরকারি ঋণ এ কারণেই অনেক বেড়েছে। তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত সামরিক ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও অতীতের চেয়ে অনেক সক্রিয়ভাবে এ সরকার বেসামরিক ব্যয়কে অর্থনীতিতে প্রণোদনা দিতে কাজে লাগাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ক্ষমতাসীন থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় ছিল সারা দুনিয়ার সামরিক ব্যয়ের অর্ধেক; তথাপি সামরিক কাজে ঋণের অর্থ ব্যয় রিপাবলিকানদেরই বিশেষ সম্পত্তি বলে মনে হয়। প্রতিটি রিপাবলিকান সরকারের সময় দুটি সমান্তরাল ঊর্ধ্বমুখী ধরন দেখতে পাওয়া যায়—ক. বার্ষিক সামরিক বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং খ. যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ বৃদ্ধি। সমান্তরাল এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা মন্দাবস্থা থেকে অর্থনীতিকে টেনে তোলার উদ্দেশ্যে নীতিনির্ধারণের একটি সুনির্দিষ্ট ধরন। রিগ্যান ও বুশ উভয়ের সময়ে সামরিক বিমান নির্মাণ বা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির পেছনে অযথা ব্যয় এত বেশি ছিল যে এটা হয়ে উঠেছিল একক গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদক।
কংগ্রেসে এবারকার মতৈক্যের ফলোআপ হিসেবে ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বাজেট ব্যয় সংকোচনের অংশবিশেষ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা এখনো দ্বিদলীয় কংগ্রেস কমিটি ঠিক করেনি। মার্কিন বিশ্লেষকেরা যুক্তি দিচ্ছেন, ধৈর্য ধারণ করতে হবে; আর কংগ্রেস সদস্যরা হয়তো আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামরিক ব্যয় কমানোর সম্ভাব্যতা অবশেষে আলোচ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১০ বছর ধরে বার্ষিক গড়ে ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন সামরিক ব্যয় হ্রাসের প্রস্তাবও উঠেছে। এ পরিমাণটা বেশ বড় মনে হলেও গত ৩০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণসমস্যা তীব্রতর করার পেছনে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি যে ভূমিকা রেখেছে, তা বিবেচনায় নিতান্তই নগণ্য। তা ছাড়া কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা খুবই পরিষ্কার। ঋণসীমা নিয়ে শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বিশ্বের আর্থিক বাজারে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলেছে, তা বিবেচনায় অপেক্ষায় থাকা হঠকারী হবে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ মেয়াদে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণদাতাদের অর্থ পরিশোধ করতে সক্ষম কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকায় দুনিয়াব্যাপী স্টক মার্কেটে শেয়ারের দাম কমেছে। তবে ঋণসংকটে শুধু যুক্তরাষ্ট্র একাই পড়েনি, এ সংকট ইউরোপের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ঋণসংকটের সঙ্গে এক করে পাঠ করতে হবে। আর্থিক বাজার তদারকি শিথিল করা—এরও সূচনা আশির দশকে—রাষ্ট্রের ঋণ দ্রুত বাড়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ; তথাপি এ কথা বলা অসংগত হবে না যে সামরিক কেইনসবাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বহু দিনের নির্ভরতা বর্তমান ঋণসংকটের অন্যতম প্রধান উপাদান।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.