বার্লিন দেয়ালের ৫০ বছর by দাউদ হায়দার
ভূগোল এই রকম : ভেডিং জেলা (এখন বলা হয় 'মিটে' বা মধ্যজেলা)। পশ্চিমাংশ অ্যালায়েড ফোর্স ফ্রান্সের দখলে। পূর্বাংশ পূর্ব বার্লিনের। পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনেই বার্ন আউয়ার স্ট্রাসে (সড়ক)। মাঝখানে আড়াই মিটার কংক্রিট দেয়াল।
১৩ আগস্ট, ১৯৬১ সাল। শুরু হলো বার্লিন দেয়ালগাঁথা।
১৩ আগস্ট, ১৯৬১ সাল। শুরু হলো বার্লিন দেয়ালগাঁথা।
ঠিক গাঁথা নয়, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা হলো পূর্বাংশ। দশ দিন পর কংক্রিটে নির্মিত দেয়াল। এক সপ্তাহের মধ্যেই (৩০ আগস্ট, ১৯৬১) গাঁথা হয়ে যায় ৩৯ কিলোমিটার। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ব্যস্ত পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকার, দেয়ালগাঁথায়। এক বছর পার হওয়ার আগেই ১৬১ কিলোমিটার বার্লিন দেয়ালগাঁথা শেষ। যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাঁটাতারের ব্যারিকেড ছিল, তাও সরিয়ে ফেলা হয়। বার্লিন দেয়ালগাঁথার নির্দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের হাইকমান্ডের। কিন্তু মূল নির্দেশ কার ছিল, এখনও সমূহ তর্ক-বিতর্ক। তবে ত্রুক্রশচেভ পূর্ব বার্লিন চলে এসেছিলেন দেয়ালগাঁথার অগ্রগতি দেখতে। দেয়ালগাঁথা হচ্ছে, তিনি পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে দেখছেন। যেন তদারকি করছেন তার হাসিমুখ। এ দৃশ্যটি টিভিতে এতবার প্রদর্শিত হয়েছে যে, মনে হয় ত্রুক্রশচেভই রাজমিস্ত্রি।
বার্লিন দেয়ালগাঁথা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। দেয়ালধসের সৌভাগ্য হয়েছে। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সাল। সন্ধ্যা। ইলশেগুঁড়ির মতো বৃষ্টি। তীব্র শীত। সঙ্গে হাওয়া। কে তখন পরোয়া করে ঠাণ্ডার। শীতের। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট সংলগ্ন দেয়ালে উঠে পড়লাম। নানা কণ্ঠের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখরিত। গোটা তল্লাটে উৎসব যেন। কেবল ওই অঞ্চলেই নয়, বার্লিনজুড়েই। পশ্চিম বার্লিনের নেতারা জড়ো হচ্ছেন। পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে নেতারা উড়ে আসছেন প্লেনে।
রাত গড়াচ্ছে। দেয়ালের ওপর থেকে লাফিয়ে নামছি পূর্ব বার্লিনের জমিনে (পারিজার প্লাৎসে)। অবাক মানি, এত লোকের হাতে হাতুড়ি, শাবল এলো কোত্থেকে? একজন ৭০-ঊর্ধ্ব বয়স্কের হাতে একটি শাবল। দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করে ক্লান্ত। বিশ্রাম নিচ্ছেন। এক টুকরোও ভাঙতে পারেনি। অনুরোধ করলাম, তার শাবল পেতে পারি কি-না। 'ওহ! তুমি ভারতীয়! ঠিক আছে, পাঁচ মিনিটের বেশি নয়।' _জোয়ান বয়স, গাগতরে, কব্জিতে বৃদ্ধের চেয়ে শক্তি বেশি। ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলাম। পাঁচ মিনিটও গত হয়নি, 'বৃদ্ধের রাগমাখা ধমক, ফেরত দিচ্ছ না হে?'
_দৃশ্যটি চোখে খেলছে এখনও। তার হাতে শাবল সঁপে দেওয়ার মুহূর্তেই একদল যুবক-যুবতীর কে বা কারা ছিনিয়ে নিয়ে গেল শাবল। বৃদ্ধ হতবাক। কিয়ৎক্ষণ। সব দুঃখ ভুলে হেসে বলেন, 'ভাঙুক। ওরাই তো ভাঙবে। আমরা পারিনি। ওরাই তো তীব্র আন্দোলন করে দেয়াল ধসের সৈনিক। ওরাই তো যোদ্ধা।' শাবল ছিনতাইকারীরা পশ্চিম বার্লিনের। সন্দেহ নেই। বলার আগেই, বাংলা-কণ্ঠ কানে ঢোকে। 'শাবলডা আমারে ক্যান দিলেন না? হেই মাইয়াগুলারে ক্যান দিলেন?' চোখ ঘুরিয়ে দেখি বাংলাদেশের একজন। ছাত্র। আমার পরিচিত। হাতুড়ি-শাবল না পেয়ে বার কয়েক লাত্থি মারেন দেয়ালে। পায়ে চোট পেয়ে কুঁকিয়ে বলেন, 'ঘুষি মাইরা ভাঙুম।' বলি, হারুন, নিশ্চয় তুমি হারকিউলিস।
আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে বার্লিন দেয়ালগাঁথা দেখিনি। না দেখলেও দেখা যেন। গত বারো দিন ধরে জার্মানির প্রতিটি টিভি চ্যানেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেয়ালগাঁথার তথ্যচিত্র দেখাচ্ছে। সব দৃশ্যই হৃদয়বিদারক। চোখে জল আসে। দেয়ালগাঁথা হচ্ছে। পূর্ব বার্লিন থেকে মানুষ টপকিয়ে পশ্চিম বার্লিনে চেষ্টা করছে ঢোকার, পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে।
বার্লিন দেয়াল টপকাতে গিয়ে_ বার্লিনের নানা জায়গায়_ পুলিশের গুলিতে মৃতের সংখ্যা হাজারাধিক। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইতে নামধামসহ পরিসংখ্যান প্রকাশিত। কবে, কখন, কোথায়, কে নিহত।
১৯ জানুয়ারি ১৯৮৯ সাল। পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রকর্তা এরিখ হোনেকার পূর্ব বার্লিনের এক জনসভায় ঘোষণা করছেন আরও ১০০ বছর বার্লিন দেয়াল থাকবে।' _হায়! দশ মাসও পূর্ণ হয়নি!! দেয়াল বিধ্বস্ত।
বার্লিন দেয়াল তৈরি কি হঠাৎ পরিকল্পিত?_ অবশ্যই নয়। গভীর রাজনীতির সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সমস্যাও জড়িত। দুই জার্মানি বিভক্ত হওয়ার পর পশ্চিম জার্মানি অ্যালায়েড কোর্সের অধীনে। পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়ার কব্জায়। পশ্চিম জার্মানির দশ ডয়েচ মার্কের সমান জিডিআরের (পূর্ব জার্মানি) ১০০ ডয়েচ মার্ক। পূর্ব জার্মানির সর্বোচ্চ বেতন ৫০০ থেকে আটশ'। পশ্চিম জার্মানিসহ পশ্চিম বার্লিনের মানুষ পূর্ব বার্লিনে গিয়ে ট্রাকভর্তি করে বাজার করছে ১০০ ডয়েচ মার্ক দিয়ে। ফলে পূর্ব বার্লিনের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও কিনতে পারছে না। হাহাকার। এ ক্ষেত্রে কী করণীয় তবে? পশ্চিম জার্মানির জন্য উন্মুক্ত হাট বসাবে, নাকি দেয়াল দিয়ে দেশের মানুষ বাঁচবে?_ বাঁচানোর দায় সরকারের। নয় কি? বার্লিন দেয়ালগাঁথার ৫০ বছরপূর্তি নিয়ে জার্মানি এখন অনুষ্ঠান-বিশ্লেষণে মশগুল।
বার্লিন, জার্মানি
daudhaider21@gmail.com
বার্লিন দেয়ালগাঁথা দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। দেয়ালধসের সৌভাগ্য হয়েছে। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সাল। সন্ধ্যা। ইলশেগুঁড়ির মতো বৃষ্টি। তীব্র শীত। সঙ্গে হাওয়া। কে তখন পরোয়া করে ঠাণ্ডার। শীতের। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট সংলগ্ন দেয়ালে উঠে পড়লাম। নানা কণ্ঠের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখরিত। গোটা তল্লাটে উৎসব যেন। কেবল ওই অঞ্চলেই নয়, বার্লিনজুড়েই। পশ্চিম বার্লিনের নেতারা জড়ো হচ্ছেন। পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে নেতারা উড়ে আসছেন প্লেনে।
রাত গড়াচ্ছে। দেয়ালের ওপর থেকে লাফিয়ে নামছি পূর্ব বার্লিনের জমিনে (পারিজার প্লাৎসে)। অবাক মানি, এত লোকের হাতে হাতুড়ি, শাবল এলো কোত্থেকে? একজন ৭০-ঊর্ধ্ব বয়স্কের হাতে একটি শাবল। দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করে ক্লান্ত। বিশ্রাম নিচ্ছেন। এক টুকরোও ভাঙতে পারেনি। অনুরোধ করলাম, তার শাবল পেতে পারি কি-না। 'ওহ! তুমি ভারতীয়! ঠিক আছে, পাঁচ মিনিটের বেশি নয়।' _জোয়ান বয়স, গাগতরে, কব্জিতে বৃদ্ধের চেয়ে শক্তি বেশি। ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলাম। পাঁচ মিনিটও গত হয়নি, 'বৃদ্ধের রাগমাখা ধমক, ফেরত দিচ্ছ না হে?'
_দৃশ্যটি চোখে খেলছে এখনও। তার হাতে শাবল সঁপে দেওয়ার মুহূর্তেই একদল যুবক-যুবতীর কে বা কারা ছিনিয়ে নিয়ে গেল শাবল। বৃদ্ধ হতবাক। কিয়ৎক্ষণ। সব দুঃখ ভুলে হেসে বলেন, 'ভাঙুক। ওরাই তো ভাঙবে। আমরা পারিনি। ওরাই তো তীব্র আন্দোলন করে দেয়াল ধসের সৈনিক। ওরাই তো যোদ্ধা।' শাবল ছিনতাইকারীরা পশ্চিম বার্লিনের। সন্দেহ নেই। বলার আগেই, বাংলা-কণ্ঠ কানে ঢোকে। 'শাবলডা আমারে ক্যান দিলেন না? হেই মাইয়াগুলারে ক্যান দিলেন?' চোখ ঘুরিয়ে দেখি বাংলাদেশের একজন। ছাত্র। আমার পরিচিত। হাতুড়ি-শাবল না পেয়ে বার কয়েক লাত্থি মারেন দেয়ালে। পায়ে চোট পেয়ে কুঁকিয়ে বলেন, 'ঘুষি মাইরা ভাঙুম।' বলি, হারুন, নিশ্চয় তুমি হারকিউলিস।
আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে বার্লিন দেয়ালগাঁথা দেখিনি। না দেখলেও দেখা যেন। গত বারো দিন ধরে জার্মানির প্রতিটি টিভি চ্যানেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেয়ালগাঁথার তথ্যচিত্র দেখাচ্ছে। সব দৃশ্যই হৃদয়বিদারক। চোখে জল আসে। দেয়ালগাঁথা হচ্ছে। পূর্ব বার্লিন থেকে মানুষ টপকিয়ে পশ্চিম বার্লিনে চেষ্টা করছে ঢোকার, পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে।
বার্লিন দেয়াল টপকাতে গিয়ে_ বার্লিনের নানা জায়গায়_ পুলিশের গুলিতে মৃতের সংখ্যা হাজারাধিক। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইতে নামধামসহ পরিসংখ্যান প্রকাশিত। কবে, কখন, কোথায়, কে নিহত।
১৯ জানুয়ারি ১৯৮৯ সাল। পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রকর্তা এরিখ হোনেকার পূর্ব বার্লিনের এক জনসভায় ঘোষণা করছেন আরও ১০০ বছর বার্লিন দেয়াল থাকবে।' _হায়! দশ মাসও পূর্ণ হয়নি!! দেয়াল বিধ্বস্ত।
বার্লিন দেয়াল তৈরি কি হঠাৎ পরিকল্পিত?_ অবশ্যই নয়। গভীর রাজনীতির সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সমস্যাও জড়িত। দুই জার্মানি বিভক্ত হওয়ার পর পশ্চিম জার্মানি অ্যালায়েড কোর্সের অধীনে। পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়ার কব্জায়। পশ্চিম জার্মানির দশ ডয়েচ মার্কের সমান জিডিআরের (পূর্ব জার্মানি) ১০০ ডয়েচ মার্ক। পূর্ব জার্মানির সর্বোচ্চ বেতন ৫০০ থেকে আটশ'। পশ্চিম জার্মানিসহ পশ্চিম বার্লিনের মানুষ পূর্ব বার্লিনে গিয়ে ট্রাকভর্তি করে বাজার করছে ১০০ ডয়েচ মার্ক দিয়ে। ফলে পূর্ব বার্লিনের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও কিনতে পারছে না। হাহাকার। এ ক্ষেত্রে কী করণীয় তবে? পশ্চিম জার্মানির জন্য উন্মুক্ত হাট বসাবে, নাকি দেয়াল দিয়ে দেশের মানুষ বাঁচবে?_ বাঁচানোর দায় সরকারের। নয় কি? বার্লিন দেয়ালগাঁথার ৫০ বছরপূর্তি নিয়ে জার্মানি এখন অনুষ্ঠান-বিশ্লেষণে মশগুল।
বার্লিন, জার্মানি
daudhaider21@gmail.com
No comments