শিক্ষাঙ্গন-কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ by মোঃ আখতার হোসেন

হার-জিত'-এর আপেক্ষিক প্রতিযোগিতা যথাসম্ভব পরিহার করে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা সমুন্নত রেখে সর্বজনীন প্রত্যাশার মোহনায় পেঁৗছাতে হবে। এ গন্তব্যে আমরা যত তাড়াতাড়ি পেঁৗছতে পারব, এ প্রতিষ্ঠানের জন্য, আমাদের সবার জন্য ততই মঙ্গল।


অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী মাতৃসম এ প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক, ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আবার ফিরে আসুক, সবার স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাচ্ছন্দ্য পদচারণায় 'প্রকৃতি-কন্যা'র সবুজ অঙ্গন আবার মুখরিত হোক_ মাহে রমজানের এই পবিত্র মাসে এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি


ময়মনসিংহে অবস্থিত 'বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়' কৃষিশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এটি শুধু আমাদের দেশে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমনকি সারা বিশ্বে এ প্রতিষ্ঠানের আলাদা খ্যাতি রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী, এর শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা। সেদিক থেকে আমরা গর্ব করতেই পারি। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার এই দেশে খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূূর্ণতা অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ আমাদের এই প্রতিষ্ঠিত সুনামকে কিছুটা হলেও ধূসর করেছে। বিগত কয়েক দিন পত্রিকার পাতায় মোটা অক্ষরে এ প্রতিষ্ঠানের সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো গবেষণা প্রকল্পে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কিংবা উদ্ভাবিত প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন অথবা প্রযুক্তি প্রয়োগে অভাবিত সাফল্য অর্জন প্রভৃতি বিষয়ে সংবাদ পরিবেশিত হলে আমরা যেমন উচ্ছ্বসিত হই, তেমন নেতিবাচক কোনো সংবাদে আমরা ব্যথিত হই, বিব্রত হই। আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। সাম্প্র্রতিক ঘটনাপ্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এবং বিচলিত করেছে ।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বিএসসি এনিম্যাল সায়েন্স (অনার্স) কোর্স' নতুন করে চালু না করা প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধসহ দেশের সব পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (বিমক) থেকে প্রেরিত এক পত্রের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত। বিমক থেকে ১৭ জুলাই ইস্যুকৃত ওই পত্র প্রত্যাহারের জন্য পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীরা ২৭ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস পরীক্ষা বর্জনসহ সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ২ আগস্ট প্রশাসন ভবনের প্রধান ফটকে অবস্থান নিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। একই সময় ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কাছে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এবং বিমক-এর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানান। এতে কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদের শিক্ষার্থীরা পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ক্যাম্পাসে উত্তেজনা দেখা দেয় । ফলে শ্রাবণের সিক্ত পরিবেশে কিছুটা হলেও উত্তাপ অনুভূত হয়। এক পর্যায়ে পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনে ব্যাপক ভাংচুর করেন, যা পরদিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। এসব প্রেক্ষাপটে প্রশাসন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে অনেকের কাছে প্রতীয়মান। এমনি অবস্থায় উভয় অনুষদের সংক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মাত্রা ক্রমান্বয়ে তীব্র হতে থাকে। ইতিমধ্যে ভিন্ন একটি ঘটনায় বোটানিক্যাল গার্ডেনে ছিনতাইয়ের অভিযোগে দু'জন ছাত্রকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অর্পণ, প্রক্টরের বাসায় হামলা, ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতির আলটিমেটাম, মৌন মিছিল, শিক্ষকদের উদ্দেশে ছাত্রদের কটূক্তি, চার ছাত্রকে পুনরায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অর্পণ, প্রতিবাদে প্রশাসনিক ভবনে পুনরায় ভাংচুর, শিক্ষকদের ওপর হামলা প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটতে থাকে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ছাত্রদের এই হামলায় একজন শিক্ষক গুরুতর আহত হন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হন। এমতাবস্থায় শিক্ষক সমিতি জরুরি সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ক্লাস বর্জনসহ রোববার পর্যন্ত দোষী ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনকে সময় বেঁধে দেয়। এদিকে ছাত্রলীগ বাকৃবি শাখা 'শিক্ষক কর্তৃক লাঞ্ছিত' হওয়ার অভিযোগ এনে প্রক্টরের পদত্যাগ এবং দোষী শিক্ষকদের বিচার চেয়ে বুধবার পর্যন্ত প্রশাসনকে সময় বেঁধে দেয়। ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের নাটকীয় অবনতি ঘটে, যা শিক্ষার পরিবেশকে বিঘি্নত করেছে। প্রশাসন এ পর্যায়ে সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রশাসনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এদিকে বাংলদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা বাকৃবি ক্যাম্পাসে এসে ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করেন। তাদের এই সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান।
ইতিমধ্যে ১০ আগস্ট বুধবার নতুন উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাভাবিকভাবেই এটি হবে তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতেও কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মীমাংসিত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, নবনিযুক্ত ভাইস চ্যান্সেলরের সুযোগ্য নেতৃত্বে এবারও এ সংকট থেকে আমরা উত্তরিত হবো। বিশ্ববিদ্যালয় আবার তার নিজস্ব কক্ষপথে নতুন ছন্দে প্রত্যাবর্তন করবে।
রমজান মাস সংযমের মাস। সিয়াম সাধনার এ মাস আমাদের অধিকতর সংযত ও সহনশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। যে কোনো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও অতীতে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম কখনও থমকে যায়নি_ এটি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গৌরবময় সংস্কৃতি। এর কৃতিত্ব ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার। ছাত্র-শিক্ষকদের মধে মধুর সম্পর্ক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। শিক্ষার্থীদের যেমন এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন ও ডিগ্রি অর্জন করতে হবে, তেমনি শিক্ষকমণ্ডলীকেও পাঠদান এবং গবেষণাকর্মে পুনরায় মনোনিবেশ করতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের যথাযথ মান-মর্যাদা অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি-শৃৃঙ্খলার অবনতি হলে অথবা শিক্ষার পরিবেশ বিঘি্নত হলে সততার সঙ্গে প্রচলিত আইনে যথাসময়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন। কথায় আছে, 'সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।' যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে হয়তোবা এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরিহার করা যেত। যে শিক্ষক গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অথবা যে প্রবীণ শিক্ষক তার নিজের ছাত্রদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন তারা কীভাবে এ ঘটনা সহসা ভুলে যাবেন? আবার শিক্ষার্থীরা তাদের ভাষায় 'শিক্ষক কর্তৃক লাঞ্ছিত' হওয়ার অভিযোগ এনে কীভাবে শিক্ষকদের সামনে পাঠ গ্রহণ করতে আসবেন? শিক্ষার্থীরা প্রায়শ শিক্ষকদের পিতৃসম বলে সম্বোধন করেন। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, পিতা তো প্রয়োজনে তার সন্তানকে তিরস্কার করতেই পারেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়_ শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী কেউ কারও প্রতিপক্ষ নন । বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রধান এই দুই অংশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস অবশ্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
'জ্ঞান, দক্ষতা ও চরিত্র'_ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে খচিত এই চিরন্তন বাণীর প্রতি আমরা কতটা অবিচল_ সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। চুরি বা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার সঙ্গে আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার অভিযোগ যখন শুনি তখন আমরা লজ্জিত ও বিব্রত হই। আমরা জানি, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মেধার অধিকারীরাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। মেধাবী এই ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীকক্ষ এবং গবেষণাগারে শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কৃষি-বিষয়ক বিভিন্ন জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে দেশের দরিদ্র কৃষকের মুখে হাসি ফোটাবে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সর্বজনীন এ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। 'হার-জিত'-এর আপেক্ষিক প্রতিযোগিতা যথাসম্ভব পরিহার করে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা সমুন্নত রেখে সর্বজনীন প্রত্যাশার মোহনায় পৌঁছাতে হবে। এ গন্তব্যে আমরা যত তাড়াতাড়ি পেঁৗছতে পারব, এ প্রতিষ্ঠানের জন্য, আমাদের সবার জন্য ততই মঙ্গল। অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী মাতৃসম এ প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক, ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আবার ফিরে আসুক, সবার স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাচ্ছন্দ্য পদচারণায় 'প্রকৃতি-কন্যা'র সবুজ অঙ্গন আবার মুখরিত হোক_ মাহে রমজানের এই পবিত্র মাসে এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

প্রফেসর ড. মোঃ আখতার হোসেন : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
akhtardso@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.