নদীতে পানি নেই, তার পরও ভারতের প্রস্তাবে সম্মতি by শফিকুল ইসলাম জুয়েল ও নিজাম উদ্দিন লাভলু

চুক্তি ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ২৪টি লো-লিফট পাম্পের সাহায্যে ফেনী নদী থেকে অবিরাম পানি তোলার পর এবার নালা কেটে প্রতিদিন আরো দুই কিউসেক পানি নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। ভারতের এ প্রস্তাবে সম্মতিও দিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ এরই মধ্যে পানি শুকিয়ে অসংখ্য চর জেগেছে ফেনী নদীতে।


ফলে একসময়ের খরস্রোতা নদী এখন মৃতপ্রায়।
এ প্রসঙ্গে মিরসরাইয়ের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ফোরামের সভাপতি ও পানি বিশেষজ্ঞ ডা. জামশেদ আলম উদ্বেগ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফেনী নদী বাংলাদেশের নিজস্ব নদী। ভারত অন্যায়ভাবে এ নদীতে ভাগ বসিয়েছে। অবৈধভাবে অসংখ্য পাম্প বসিয়ে অবিরাম পানি তুলে নেওয়ায় নদীটি শুকিয়ে যাচ্ছে। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরি সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে নতুন নালা খনন করে পানি তুলে নেওয়া হলে ফেনী নদী মরা নদীতে পরিণত হবে। ধ্বংস হবে মুহুরি সেচ প্রকল্প।'
অন্যদিকে, পাউবোর খাগড়াছড়ি উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গতকাল সোমবার দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম সীমান্তে ফেনী নদী পরিদর্শন করেছেন। ভারতের প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও কারিগরি দিক পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে তাঁর মনে হয়েছে, কৌশলগত দিক থেকে প্রকল্পটি বাংলাদেশেরই অনুকূলে। আর দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকল্পটিতে অনুমোদন দিয়েছেন।
বিশিষ্ট নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ ইনামুল হক গতকাল টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের বৃষ্টি সংরক্ষণ এলাকা ৬০ শতাংশ, আর ভারতের ৪০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ভারত ফেনী নদীর পানি অর্ধেক নিতে চাইলে তা ন্যায়সংগত হবে না। আর নতুন করে পানি নেওয়ার যে উদ্যোগ ভারত নিয়েছে, সেটিও নৈতিকতাবর্হিভূত। কারণ, ভারত লো-লিফট পাম্পের সাহায্যে দীর্ঘদিন ধরে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এবার নতুন করে প্রতিদিন দুই কিউসেক পানি তুলতে চাইলে বাংলাদেশের প্রতিবাদ করা উচিত। তা ছাড়া পানি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তাদের সব কটি পাম্প বন্ধ করে পরিমাপের পরই কেবল সম্মতি দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে শুধু আমলীঘাট এলাকায় (ফেনী নদীতে দুই দেশের শেষ সীমান্ত) নয়; সমতল ভূমির একাধিক স্থানেও পানিপ্রবাহ পরিমাপ করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য রামগড় ১৬ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ নাঈম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফেনী নদীর পানি ব্যবহার করে ভারত সাবরুম মহকুমা শহর ও আশপাশের পানির চাহিদা পূরণের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেরও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে রামগড় পৌর এলাকাসহ আশপাশের জন্য এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা খুবই জরুরি।'
জানা গেছে, নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে নালা খনন করে প্রতিদিন প্রায় দুই কিউসেক পানি প্রত্যাহারের ভারতীয় উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের নতুন প্রকল্প সরেজমিনে দেখতে গতকাল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুমের সীমান্তবর্তী দোলবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করে। ত্রিপুরার পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার তপন লোদসহ সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্মকর্তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে তাঁদের প্রকল্পের বিষয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন।
পাউবো সূত্র জানায়, ভারত দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমা শহরে পানীয় জল এবং সেচকাজের চাহিদা মেটানোর জন্য ফেনী নদী থেকে দুই কিউসেক পানি তুলে নিতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে। গত বছরও ভারত রামগড়ের দারোগাপাড়া অংশে ফেনী নদীর মাঝখানে পাঁচ মিটার চওড়া ও ২০ মিটার গভীর পাকা কূপ নির্মাণ করে পাইপ বসিয়ে পাম্পের সাহায্যে পানি নেওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ জোর আপত্তি জানালে তা বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিনে নদী এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে রামগড়, মাটিরাঙ্গা, উত্তর ফটিকছড়ি, মিরসরাইসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। কোথাও কোথাও নদীর এক পাশে সরু নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে প্রবাহ কমে গেলে নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ ও ফসল মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
পাউবোর পানি পরিমাপ শাখার রামগড়ের গেজ রিডার আনোয়ার উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নেওয়া পরিসংখ্যানে ফেনী নদীর পানির লেভেল ১২ দশমিক ৫৬ মিটার পাওয়া গেছে। চৈত্রের খরায় পানির এ লেভেল আরো কমে যাবে।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত দক্ষিণ ত্রিপুরার অমরপুর মহকুমার শিলাছড়ি থেকে সাবরুম মহকুমার আমলীঘাট পর্যন্ত সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২৪টি লো লিফট পাম্প বসিয়ে পানি তুলে নিচ্ছে। নদীতীরের ৩০ থেকে ৫০ গজের মধ্যে অবৈধভাবে পাকা পাম্প হাউসগুলো নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে ভারত, যার পরিমাণ দৈনিক প্রায় ৭৫ কিউসেক।
পাউবোর নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে ফেনী নদীর পানিপ্রবাহ অত্যধিক কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের যৌথ পর্যবেক্ষকদল সরেজমিনে পরিদর্শন ও অনুসন্ধান করে পানিপ্রবাহ হ্রাসের কারণ উদ্ঘাটন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
আরো জানা গেছে, আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ভারত প্রকল্পটির কাজ শুরু করবে।
রামগড়ের প্রবীণ ব্যক্তি আবদুল গফুর সর্দার বলেন, 'ফেনী নদী দিয়েই একসময় ফেনীর শুভপুর থেকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, অযোদ্ধা ও তবলছড়ি পর্যন্ত মানুষ যাতায়াত করত। নৌকায় করে কৃষকরা তাঁদের পণ্য আনা-নেওয়া করতেন। নদীটি ছিল তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। অথচ এ নদীতে এখন গোসল করার পানিও পাওয়া যায় না।'
মুক্তিযোদ্ধা ও রামগড় উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ছালেহ আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কোনো ভারতীয় নাগরিক ফেনী নদীতে পা ফেলতে পারত না। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর থেকে ভারত এ নদীর পানি তুলে নিচ্ছে। এখন তারা পুরো নদীই গিলে খেতে চাইছে।'

No comments

Powered by Blogger.