ফেনী নদীর পাঁচালি by মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে সুউচ্চ ভগবানটিলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার ৫৫ কিলোমিটার পূর্বে এবং পানছড়ি উপজেলার ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান এই টিলার। দুই প্রান্তে ঝরনাধারা। ঝরনার স্বচ্ছ পানি বয়ে যায় আধা কিলোমিটার দূরত্বের দুটি নালায়।
সাত কিলোমিটার পরে আচালং গ্রামে এসে দুটি নালা মিলিত হয় একটি ছড়ায়। পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে ছুফি টিলার ধারে আসতে আসতে ছড়া পরিণত হয় খালে। এর দুই কিলোমিটার পরে অযোধ্যা বাজারের পাশে এটি পরিণত হয় সম্পূর্ণ নদীতে, যার নাম ফেনী নদী। পুরো ফেনী নদীর মধ্যে ৮৬ কিলোমিটার সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত। এরপর আমলীঘাট থেকে মুহুরী প্রকল্প পর্যন্ত নদী সীমান্ত রেখা এঁকে দিয়েছে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার মধ্যে।
আঁকাবাঁকা এই ছোট নদীটি উৎপত্তিস্থলের কিছু দূর থেকে মিরসরাইয়ের আমলীঘাট পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। তবে বেশির ভাগ এলাকা ভারতের দখলে। আর যেখানে ভারতীয় দখল নেই, সেসব অঞ্চলে আছে বাংলাদেশিদের নানা রকম বিরূপ কর্মকাণ্ড। ১৯৮৪ সালে মুহুরী প্রকল্পে রেগুলেটর স্থাপনের মধ্য দিয়ে নদীটির স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করা হয়।
ফরিদপুরে অবস্থিত দেশের একমাত্র নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়েও ফেনী নদী সম্পর্কে আশানুরূপ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রতিবেদকের দীর্ঘ (৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত) অনুসন্ধানে জানা গেছে নানা তথ্য। কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক সরেজমিনে ঘুরে আবিষ্কার করেছেন ফেনী নদী এবং নদীকে ঘিরে স্থানীয় জনপদে ভাঙা-গড়ার নানা ইতিহাস।
ভগবানটিলা ও নদীর জন্ম বৃত্তান্ত : মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে ৪৮ কিলোমিটার পূর্বে তাইন্দং বাজার। তারও সাত কিলোমিটার পূর্বে ভগবানটিলা। তাইন্দং বাজার থেকে পূর্বে ফেনী ছড়া বিওপি, তানাক্কাপাড়া বিওপি ও বান্দরসিং বিওপি অতিক্রম করে ভি টিলা (ভগবানটিলা) বিওপি। এই সীমান্ত ফাঁড়ির কমান্ডার সুবেদার বখত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এই টিলার পূর্বে ও উত্তরে ভারতীয় সীমান্ত। টিলা থেকে প্রবাহিত হওয়া দুটি ঝরনাধারাই হলো ফেনী নদীর মূল উৎপত্তি।
স্থানীয় কালুমিয়ার ছেলে জসীম উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রতিবেদক যান দুটি ঝরনায়। ভগবানটিলার উত্তর প্রান্ত থেকে প্রবাহিত হওয়া ঝরনার পানি বয়ে গেছে তালগাছতলপাড়ার বুকচিরে। লালমোহনের টিলার দক্ষিণ ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া এই নালাকে স্থানীয় বাসিন্দারা নাম দিয়েছে ফেনী গাং (উত্তর)। আর আধা কিলোমিটার দূরবর্তী চালতাতলপাড়ার বুকচিরে বয়ে যাওয়া নালার নাম দক্ষিণ ফেনী গাং। এই পানি প্রবাহিত হয় ভগবানটিলার দক্ষিণ প্রান্তের ঝরনা থেকে।
গত বছরের ২৬ অক্টোবর এ প্রতিবেদক সরেজমিনে যান আচালং সীমান্তে। ভগবানটিলা থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে এর অবস্থান। এখানে এসে দুটি নালা একটি ছড়ায় পরিণত হয়েছে। তবে ছড়ার কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আচালং গ্রামে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি।
বিজিবির আচালং সীমান্ত ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, এই সীমান্ত দিয়ে ফেনী ছড়া বয়ে গেছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এর অবস্থান। বিএসএফের আধিপত্য বিস্তারের ফলে এখানকার সবাই তটস্থ থাকে।
ফেনী নদীর আচালং, রামগড় ও আমলীঘাট সীমান্তে ভারতীয় দাপট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমলীঘাট ও রামগড় সীমান্ত থেকে পানি প্রত্যাহার করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে ভারতের উপেন্দ্রনগর ও সাবরুম শহরের। মাটিরাঙ্গার আচালং সীমান্তে এক হাজার ৭০০ একর জমি দখলে নিয়েছে ভারত।
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মিরসরাইয়ের আমলীঘাট সীমান্ত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর ওপারে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ভারতীয় শ্রমিকরা নদীর ধারেই আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে ব্লক তৈরি করছে। সেই কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি পাইপ বসিয়ে পানি প্রত্যাহারের কাজও অব্যাহত রেখেছে তারা।
অনুরূপভাবে রামগড় সীমান্তে ১৭টি পাইপ বসিয়ে পানি তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাবরুম শহরে। সাবরুম শহরের তীব্র পানি সংকট মেটানোর একমাত্র সহায় হিসেবে ভারত ব্যবহার করছে এই নদীকে। পাশাপাশি নদীর পাড়ে ব্লক বসানোর কাজও চালিয়ে যাচ্ছে।
আমলীঘাট সীমান্তের বাসিন্দা ইতিহাসবিদ আহমদ মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নো ম্যানস ল্যান্ড' আখ্যা দিয়ে বিএসএফের সদস্যরা বাংলাদেশি কাউকে নদীর পানি ছুঁতেও দেয় না। অথচ তাদের প্রান্তে ব্লক বসানো চলছে এবং পানিও তুলে নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, 'এই নদীর পানিচুক্তি এখনো ঝুলে আছে। সুতরাং এই নদীতে ভারতের আধিপত্য বিস্তার করা কোনোভাবেই শুভ নয়।'
রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাবরুম শহরে পানির সংকট। সেই সংকট মেটাতে ফেনী নদী শুকিয়ে যাবে- এটি যুক্তিযুক্ত নয়। বিএসএফ কোনো বাংলাদেশিকে নদীতে নামতে পর্যন্ত দিচ্ছে না। অথচ সম্পূর্ণ নদীই আমাদের।'
দখলবাজি : ওপরের অংশে যেমন ভারতীয় দখলদারি, তেমনি ফেনী নদীর নিচের অংশেও চলছে বাংলাদেশিদের নানাবিধ দখলের মহোৎসব। চলছে নদী দখল করে দিঘি খনন। অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে নদীর বালু। এর ফলে একদিকে গতিপথ সংকুচিত হয়ে নদী নাব্যতা হারাতে বসেছে, অন্যদিকে বর্ষায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির একটি ফাঁদ তৈরি হচ্ছে।
আমলীঘাট থেকে মুহুরী প্রকল্প পর্যন্ত ফেনী নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। বেশ কয়েক দিন ধরে এই প্রতিবেদক পুরো নদী ঘুরে বেড়ান। এ সময় দেখা যায়, আমলীঘাট থেকে ধুমঘাট পর্যন্ত চলছে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। কোথাও নদীর গতিপথ বদলে দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন দিঘি খননের কাজ চলছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সীমান্ত মুহুরী প্রকল্পের মূল গেট। আলমপুর ও সুজাপুর গ্রামের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। প্রকল্পের গেট থেকে পূর্ব দিকে ধুমঘাট পর্যন্ত ইঞ্জিনচালিত বোটে চড়ে ঘুরে দেখা যায়, কোথাও ভাঙন, কোথাও বা দখল। ভাঙনে সোনাগাজী অঞ্চলের মুন্সীগ্রামের একটি অংশ তলিয়ে গেছে নদীতে। এরপর মিরসরাই অঞ্চলের মোবারকঘোনা আবাসন প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, নদীর পানি কম থাকার সুযোগে গতিপথ দখলে নিয়ে সেখানে খনন করা হচ্ছে নতুন নতুন দিঘি। বাদামতলী, গুচ্ছগ্রাম, ফরহাদনগর, নোয়াবপুর ও শুক্কুরবারইয়ারহাট এলাকা পর্যন্ত একইভাবে দিঘি খননের দৃশ্য দেখা যায়।
বাদামতলী এলাকায় ফেনী নদীতে এসে মিলিত হয়েছে ভারত থেকে আসা সিলোনিয়া ও মুহুরী নদী। তিন নদীর মিলিত প্রবাহ বেশি থাকায় মুহুরী প্রকল্প এলাকায় নদীর আকার প্রায় দ্বিগুণ প্রশস্ত। আর এই নদীর ওপর নির্ভর করে আছে পাশের গ্রামগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ।
ধুমঘাট থেকে আমলীঘাট পর্যন্ত নদী ঘুরে দেখা যায়, কিছুদূর পরপর বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। পাইপ দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন করা হয় অপরিকল্পিতভাবে। ফলে নদী নাব্যতা সংকটে পড়ার এবং বর্ষায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টির তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
যে কারণে নদীর এত গুরুত্ব : গত কয়েক বছরে কৃষি ও মৎস্য খাতে বিপ্লব ঘটেছে ফেনী জেলার ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম ও চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলায়। অভাবনীয় এই পরিবর্তনের নেপথ্য ফেনী নদী।
ফেনী নদীকে ঘিরে ১৯৮৬ সালে গড়ে ওঠে মুহুরী সেচ প্রকল্প। প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পে ব্যয় হয় ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় বছরে ৭৫ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয়। এটিকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মৎস্য প্রকল্প। এসব প্রকল্পে উৎপাদিত মাছ দিয়ে মেটে পুরো চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ চাহিদা। বছরে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদিত হয় এ প্রকল্পের পানি দিয়ে। এ ছাড়া ফেনী নদীর সাতটি পয়েন্টে বালু উত্তোলন করা হয় সারা বছর। মৎস্য ও কৃষি চাষ এবং বালু উত্তোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে লাখো মানুষ।
ফেনী জেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মুহুরী প্রকল্পের সেচের আওতায় ফেনী জেলায় ১৫ হাজার মেট্রিকটন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে এ প্রকল্পের সেচের আওতায় মিরসরাইয়েও প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হওয়ার কথা জানালেন মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী।
নদী রক্ষার আন্দোলন : মিরসরাই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ফোরাম নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ফেনী নদী রক্ষায় আন্দোলন করছে। ফোরামের সভাপতি ডা. মো. জামসেদ আলম এ নদীর নানা তথ্য অনুসন্ধানে রামগড়, মাটিরাঙ্গা ও ভগবানটিলায় গিয়েছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের অনুসন্ধানে কোথাও এ নদীর গতিপথ ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। ভারতের এই নদীতে ভাগ বসানো অযৌক্তিক। এই নদী আন্তর্জাতিক নয়, এটি বাংলাদেশের সম্পদ। অথচ এর সুফল ভোগ করতে পারছে না দেশের মানুষ।'
আঁকাবাঁকা এই ছোট নদীটি উৎপত্তিস্থলের কিছু দূর থেকে মিরসরাইয়ের আমলীঘাট পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। তবে বেশির ভাগ এলাকা ভারতের দখলে। আর যেখানে ভারতীয় দখল নেই, সেসব অঞ্চলে আছে বাংলাদেশিদের নানা রকম বিরূপ কর্মকাণ্ড। ১৯৮৪ সালে মুহুরী প্রকল্পে রেগুলেটর স্থাপনের মধ্য দিয়ে নদীটির স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করা হয়।
ফরিদপুরে অবস্থিত দেশের একমাত্র নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়েও ফেনী নদী সম্পর্কে আশানুরূপ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রতিবেদকের দীর্ঘ (৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত) অনুসন্ধানে জানা গেছে নানা তথ্য। কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক সরেজমিনে ঘুরে আবিষ্কার করেছেন ফেনী নদী এবং নদীকে ঘিরে স্থানীয় জনপদে ভাঙা-গড়ার নানা ইতিহাস।
ভগবানটিলা ও নদীর জন্ম বৃত্তান্ত : মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে ৪৮ কিলোমিটার পূর্বে তাইন্দং বাজার। তারও সাত কিলোমিটার পূর্বে ভগবানটিলা। তাইন্দং বাজার থেকে পূর্বে ফেনী ছড়া বিওপি, তানাক্কাপাড়া বিওপি ও বান্দরসিং বিওপি অতিক্রম করে ভি টিলা (ভগবানটিলা) বিওপি। এই সীমান্ত ফাঁড়ির কমান্ডার সুবেদার বখত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এই টিলার পূর্বে ও উত্তরে ভারতীয় সীমান্ত। টিলা থেকে প্রবাহিত হওয়া দুটি ঝরনাধারাই হলো ফেনী নদীর মূল উৎপত্তি।
স্থানীয় কালুমিয়ার ছেলে জসীম উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রতিবেদক যান দুটি ঝরনায়। ভগবানটিলার উত্তর প্রান্ত থেকে প্রবাহিত হওয়া ঝরনার পানি বয়ে গেছে তালগাছতলপাড়ার বুকচিরে। লালমোহনের টিলার দক্ষিণ ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া এই নালাকে স্থানীয় বাসিন্দারা নাম দিয়েছে ফেনী গাং (উত্তর)। আর আধা কিলোমিটার দূরবর্তী চালতাতলপাড়ার বুকচিরে বয়ে যাওয়া নালার নাম দক্ষিণ ফেনী গাং। এই পানি প্রবাহিত হয় ভগবানটিলার দক্ষিণ প্রান্তের ঝরনা থেকে।
গত বছরের ২৬ অক্টোবর এ প্রতিবেদক সরেজমিনে যান আচালং সীমান্তে। ভগবানটিলা থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে এর অবস্থান। এখানে এসে দুটি নালা একটি ছড়ায় পরিণত হয়েছে। তবে ছড়ার কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আচালং গ্রামে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি।
বিজিবির আচালং সীমান্ত ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, এই সীমান্ত দিয়ে ফেনী ছড়া বয়ে গেছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এর অবস্থান। বিএসএফের আধিপত্য বিস্তারের ফলে এখানকার সবাই তটস্থ থাকে।
ফেনী নদীর আচালং, রামগড় ও আমলীঘাট সীমান্তে ভারতীয় দাপট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমলীঘাট ও রামগড় সীমান্ত থেকে পানি প্রত্যাহার করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে ভারতের উপেন্দ্রনগর ও সাবরুম শহরের। মাটিরাঙ্গার আচালং সীমান্তে এক হাজার ৭০০ একর জমি দখলে নিয়েছে ভারত।
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মিরসরাইয়ের আমলীঘাট সীমান্ত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর ওপারে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ভারতীয় শ্রমিকরা নদীর ধারেই আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে ব্লক তৈরি করছে। সেই কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি পাইপ বসিয়ে পানি প্রত্যাহারের কাজও অব্যাহত রেখেছে তারা।
অনুরূপভাবে রামগড় সীমান্তে ১৭টি পাইপ বসিয়ে পানি তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাবরুম শহরে। সাবরুম শহরের তীব্র পানি সংকট মেটানোর একমাত্র সহায় হিসেবে ভারত ব্যবহার করছে এই নদীকে। পাশাপাশি নদীর পাড়ে ব্লক বসানোর কাজও চালিয়ে যাচ্ছে।
আমলীঘাট সীমান্তের বাসিন্দা ইতিহাসবিদ আহমদ মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নো ম্যানস ল্যান্ড' আখ্যা দিয়ে বিএসএফের সদস্যরা বাংলাদেশি কাউকে নদীর পানি ছুঁতেও দেয় না। অথচ তাদের প্রান্তে ব্লক বসানো চলছে এবং পানিও তুলে নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, 'এই নদীর পানিচুক্তি এখনো ঝুলে আছে। সুতরাং এই নদীতে ভারতের আধিপত্য বিস্তার করা কোনোভাবেই শুভ নয়।'
রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাবরুম শহরে পানির সংকট। সেই সংকট মেটাতে ফেনী নদী শুকিয়ে যাবে- এটি যুক্তিযুক্ত নয়। বিএসএফ কোনো বাংলাদেশিকে নদীতে নামতে পর্যন্ত দিচ্ছে না। অথচ সম্পূর্ণ নদীই আমাদের।'
দখলবাজি : ওপরের অংশে যেমন ভারতীয় দখলদারি, তেমনি ফেনী নদীর নিচের অংশেও চলছে বাংলাদেশিদের নানাবিধ দখলের মহোৎসব। চলছে নদী দখল করে দিঘি খনন। অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে নদীর বালু। এর ফলে একদিকে গতিপথ সংকুচিত হয়ে নদী নাব্যতা হারাতে বসেছে, অন্যদিকে বর্ষায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির একটি ফাঁদ তৈরি হচ্ছে।
আমলীঘাট থেকে মুহুরী প্রকল্প পর্যন্ত ফেনী নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। বেশ কয়েক দিন ধরে এই প্রতিবেদক পুরো নদী ঘুরে বেড়ান। এ সময় দেখা যায়, আমলীঘাট থেকে ধুমঘাট পর্যন্ত চলছে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। কোথাও নদীর গতিপথ বদলে দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন দিঘি খননের কাজ চলছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সীমান্ত মুহুরী প্রকল্পের মূল গেট। আলমপুর ও সুজাপুর গ্রামের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। প্রকল্পের গেট থেকে পূর্ব দিকে ধুমঘাট পর্যন্ত ইঞ্জিনচালিত বোটে চড়ে ঘুরে দেখা যায়, কোথাও ভাঙন, কোথাও বা দখল। ভাঙনে সোনাগাজী অঞ্চলের মুন্সীগ্রামের একটি অংশ তলিয়ে গেছে নদীতে। এরপর মিরসরাই অঞ্চলের মোবারকঘোনা আবাসন প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, নদীর পানি কম থাকার সুযোগে গতিপথ দখলে নিয়ে সেখানে খনন করা হচ্ছে নতুন নতুন দিঘি। বাদামতলী, গুচ্ছগ্রাম, ফরহাদনগর, নোয়াবপুর ও শুক্কুরবারইয়ারহাট এলাকা পর্যন্ত একইভাবে দিঘি খননের দৃশ্য দেখা যায়।
বাদামতলী এলাকায় ফেনী নদীতে এসে মিলিত হয়েছে ভারত থেকে আসা সিলোনিয়া ও মুহুরী নদী। তিন নদীর মিলিত প্রবাহ বেশি থাকায় মুহুরী প্রকল্প এলাকায় নদীর আকার প্রায় দ্বিগুণ প্রশস্ত। আর এই নদীর ওপর নির্ভর করে আছে পাশের গ্রামগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ।
ধুমঘাট থেকে আমলীঘাট পর্যন্ত নদী ঘুরে দেখা যায়, কিছুদূর পরপর বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। পাইপ দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন করা হয় অপরিকল্পিতভাবে। ফলে নদী নাব্যতা সংকটে পড়ার এবং বর্ষায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টির তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
যে কারণে নদীর এত গুরুত্ব : গত কয়েক বছরে কৃষি ও মৎস্য খাতে বিপ্লব ঘটেছে ফেনী জেলার ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম ও চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলায়। অভাবনীয় এই পরিবর্তনের নেপথ্য ফেনী নদী।
ফেনী নদীকে ঘিরে ১৯৮৬ সালে গড়ে ওঠে মুহুরী সেচ প্রকল্প। প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পে ব্যয় হয় ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় বছরে ৭৫ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয়। এটিকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মৎস্য প্রকল্প। এসব প্রকল্পে উৎপাদিত মাছ দিয়ে মেটে পুরো চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ চাহিদা। বছরে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদিত হয় এ প্রকল্পের পানি দিয়ে। এ ছাড়া ফেনী নদীর সাতটি পয়েন্টে বালু উত্তোলন করা হয় সারা বছর। মৎস্য ও কৃষি চাষ এবং বালু উত্তোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে লাখো মানুষ।
ফেনী জেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মুহুরী প্রকল্পের সেচের আওতায় ফেনী জেলায় ১৫ হাজার মেট্রিকটন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে এ প্রকল্পের সেচের আওতায় মিরসরাইয়েও প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হওয়ার কথা জানালেন মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী।
নদী রক্ষার আন্দোলন : মিরসরাই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ফোরাম নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ফেনী নদী রক্ষায় আন্দোলন করছে। ফোরামের সভাপতি ডা. মো. জামসেদ আলম এ নদীর নানা তথ্য অনুসন্ধানে রামগড়, মাটিরাঙ্গা ও ভগবানটিলায় গিয়েছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের অনুসন্ধানে কোথাও এ নদীর গতিপথ ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। ভারতের এই নদীতে ভাগ বসানো অযৌক্তিক। এই নদী আন্তর্জাতিক নয়, এটি বাংলাদেশের সম্পদ। অথচ এর সুফল ভোগ করতে পারছে না দেশের মানুষ।'
No comments