প্রীতিলতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কয়েকটি কথা by হায়দার আকবর খান রনো
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের শততম জন্মবর্ষ পূর্ণ হলো ৫ মে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে কোথাও এই মহীয়সী সংগ্রামী নারীর জীবনাদর্শ ও দেশের জন্য মহান আত্মত্যাগ নিয়ে কোনো খবরের কাগজে প্রতিবেদন ছাপা হয়নি বা কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কোনো আলোচনা হয়নি।
এর আগেও দেখেছি, স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির শততমবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছিল, আমরা তা স্মরণ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মহান বিপ্লবী নেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর শততম জন্মবার্ষিকী ভারতবর্ষে পালিত হলেও বাংলাদেশের কেউ জানতেও পারল না কবে এই দিনটি পার হয়ে গেছে। মহান বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মশতবর্ষ কলকাতায় ও চট্টগ্রামে পালিত হয়েছিল বেসরকারি উদ্যোগে। কলকাতা থেকে সূর্য সেনের কয়েকজন সহযোদ্ধা, যাঁরা তখনো জীবিত ছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশে এসেছিলেন; কিন্তু ঢাকায় তাঁদের কোনো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এসব মহান রাজনৈতিক নেতা ও বিপ্লবীকে ভুলে যাওয়া অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য জাতি হিসেবে লজ্জার কথা।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা_তাঁদের ভুলে যাওয়া কোনো অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি বলে আমার মনে হয় না। এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার পরিচায়ক মাত্র। এমনকি সেই পাকিস্তানি মানসিকতার জের এখনো চলে আসছে বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।
আমাদের দেশে সাধারণত স্বাধীনতার ইতিহাস শুরু করা হয় ১৯৪৭ সাল তথা পাকিস্তান আমল থেকে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তা নিঃসন্দেহে গৌরবের। ষাটের দশকে আমি নিজেও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। সেই আন্দোলনের পরিণতিতে ১৯৭১ সালের যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, তা নিয়ে মহান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নিজেরও গর্ব আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে পাকিস্তান আমলের আগে যে ব্রিটিশবিরোধী মহান রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে, যার ঐতিহ্যের অধিকারী উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান_এ তিন দেশেরই জনগণ, সেই মহান ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ভুলে গেলে চলবে না। ভারত ও বাংলাদেশের আছে একই সাধারণ ইতিহাস, একই সাধারণ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং একই ভাষা (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা, আসামের অংশবিশেষের জনগণের ভাষা হলো বাংলা)। তাই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয় দেশের সাধারণ সম্পত্তি। বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, মীর মশাররফ হোসেন, লালন শাহ, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ আমাদের দুই দেশের মহান সম্পদ। এ তো গেল সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা। যেসব রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁদের কি দেশ বিভাগের মতোই ভাগ করা যাবে? নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তো বটেই (যাঁর অন্তর্ধান ঘটেছিল ১৯৪৫ সালে), এমনকি মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল গাফফার খান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়ক এবং একই ঐতিহ্যের অংশ। তাঁদের প্রত্যেককেই আমরা যদি শ্রদ্ধা জানাতে না পারি, তবে সে কলঙ্ক আমাদের, অন্য কারোর নয়।
প্রসঙ্গক্রমে আসতে পারে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাম। তিনিও যে ইতিহাসের অংশ, সেটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাঁকে আমরা সম্মান জানাতে পারছি না। কারণ তাঁর রাজনীতিটা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী। উপরন্তু তিনি বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছিলেন, তাতে বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে নিন্দা ও ধিক্কারই তাঁর পাওনা ছিল।
আমাদের দেশে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো বটেই, এমনকি অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর মধ্যেও ভাবখানা এমন যেন ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস। তার আগের ইতিহাস যেন আমাদের পাঠ্য নয়। কিন্তু ২০০ বছরের সশস্ত্র ও নিরস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা ব্রিটিশকে তাড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই সংগ্রামের মধ্যে ছিল তিনটি ধারা। প্রথমত সশস্ত্র ধারা, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, যাকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন_ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, যার প্রধান নেতা বা নেত্রী ছিলেন নানা সাহেব, তাতিয়া তোপি, ঝাঁসির রানি প্রমুখ। এই সংগ্রাম ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াই। সশস্ত্র সংগ্রামের নবপর্যায়ের ধারা তৈরি হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে তৃতীয় দশক পর্যন্ত, যাঁর নায়ক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ (একপর্যায় পর্যন্ত)। সূর্য সেন, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু এবং অনুশীলন, যুগান্তর দলের নেতারা। আরো পরে আমরা দেখব মহান জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দু ফৌজের সশস্ত্র যুদ্ধ, যাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ছিলেন সেনাপতি ও সাধারণ সৈনিকের পদে। ১৯৪৬ সালের বোম্বাইয়ের মহান নৌ-বিদ্রোহ ব্রিটিশ যুগের সর্বশেষ সশস্ত্র সংগ্রামের ঘটনা, সেটিও ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াই।
সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি ছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে দেশ কাঁপানো গণ-আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, লবণ আন্দোলন ও ভারত ছাড় আন্দোলন। তৃতীয় আরেকটি ধারাও ছিল, তা হলো, শ্রমিক-কৃষকের জঙ্গি সংগ্রাম, যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্টরা। এই তিন ধারার যোগফলেই এসেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে পথভ্রষ্ট, বিভক্ত ও দুর্বল করার জন্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আনুকূল্যে গড়ে উঠেছিল একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন, দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন। বাংলাদেশের মুসলমান জনগণ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে যাঁরা এ দেশের জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁরা সবাই একদিন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা বা কর্মী ছিলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান_সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাজনীতির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন। ষাটের দশকে বাঙালি জনগণের পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনায় যে বিশাল জাগরণ ঘটেছিল, তা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য নেতৃত্বের কারণেই।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে নয়। উপরন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা কেবল পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে নতুন এক দেশ করিনি, অর্থাৎ আরেকটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করিনি (অথবা অনেকে যেভাবে বলেন, লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেছি মাত্র; তা কিন্তু নয়), আমরা জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্ব খণ্ডন করেই প্রগতিশীল চেতনার জন্ম দিয়েছি। সে জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানের আরেকটি সংস্করণ নয়, যদিও তেমনটি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গেই বলতে হয় যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমোদন অথবা সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' শব্দ যোগ ইত্যাদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
আবারও বলতে চাই যে পাকিস্তানি ভাবধারা নানাভাবে আমাদের শাসকবর্গ ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একাদশের মধ্যে সচেতন বা অসচেতনভাবে আছে বলেই আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করি, যে মহান ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা ঝাঁসির রানি, তিতুমীর, ভগৎ সিং, সূর্য সেন, বাঘা যতীন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু অথবা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, খান আবদুল গাফফার খান প্রমুখ। এসব নেতার কোনো কোনো ভূমিকা নিয়ে হয়তো কারোর সমালোচনা থাকতে পারে। কোনো রাজনৈতিক নেতাই সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। কিন্তু তাঁরা সবাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যোদ্ধা হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধেয় এবং আমাদের ঐতিহ্যের অংশ।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। পাকিস্তান আমলে লেখক খন্দকার ইলিয়াস একটি বহুল প্রচারিত ও বহুল প্রশংসিত বই লিখেছিলেন 'ভাসানী যখন ইউরোপে'। আইয়ুব সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার হাইকোর্টে রিট হয়েছিল, হাইকোর্ট অবশ্য নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছিলেন। হাইকোর্টের বিচারক নিষিদ্ধ রাখার পক্ষে যেসব যুক্তি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সূর্য সেনের প্রসঙ্গটি এসেছিল। বিচারকের মতে, সূর্য সেন ছিলেন ডাকাত ও হত্যাকারী, উপরন্তু হিন্দু। যে বইয়ে সূর্য সেনের প্রশংসা করা হয়েছে, সেই বই নাকি পাকিস্তানে চলতে দেওয়া যায় না। বইটির এক স্থানে মওলানা ভাসানী দেশপ্রেমিক সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন, লেখক নিজেও শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। এটাই ছিল অপরাধ। এটাই ছিল পাকিস্তানি মানসিকতা। বর্তমানে এতটা সোচ্চার না হলেও সেই পাকিস্তানি মানসিকতা কি একবারে শেষ হয়ে গেছে? আমার সন্দেহ আছে। অন্যথায় বীরকন্যা স্বাধীনতার যোদ্ধা প্রীতিলতা কেন মিডিয়ায় এতটা উপেক্ষিত হবেন? কেন দেখতে পাই না জন্মশতবর্ষে রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান? প্রীতিলতার নামে ও সূর্য সেনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থাকলেও কেন নেই সেখানে তাঁদের কোনো আবক্ষ মূর্তি। যে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে প্রীতিলতা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, চট্টগ্রামের সেই ইউরোপিয়ান ক্লাবটিকে কেন এখনো মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়নি। এটি এখন একটি সরকারি অফিস। অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় আছে। প্রীতিলতার বা সংগ্রামের চিহ্নমাত্র নেই।
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের একটি মূর্তি আছে, জে এম সেন হলের পাশে তাও আবার খাঁচার মধ্যে বন্দি অবস্থায়। ছি! ছি! এ যে কত বড় লজ্জার কথা। লিখতেও সংকোচ বোধ হচ্ছে।
আশা করি, আমরা যেন ব্রিটিশবিরোধী ঐতিহ্যপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাসকে খণ্ডিত না করি অথবা ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা না করি কিংবা সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে বিকৃত করার চেষ্টা না করি।
ঝাঁসির রানি, তিতুমীর, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, কানাই লাল, বাঘা যতীন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার যে মহান ঐতিহ্য তৈরি করে গেছেন, আমরা যেন তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও যেন স্থান পান এসব জাতীয় বীর। আমাদের শিশুরা যেন গড়ে ওঠে তাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। মহীয়সী বীর নারী ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অকুতোভয় যোদ্ধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি সশস্ত্র সালাম ও শ্রদ্ধা।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্টনেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা_তাঁদের ভুলে যাওয়া কোনো অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি বলে আমার মনে হয় না। এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার পরিচায়ক মাত্র। এমনকি সেই পাকিস্তানি মানসিকতার জের এখনো চলে আসছে বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।
আমাদের দেশে সাধারণত স্বাধীনতার ইতিহাস শুরু করা হয় ১৯৪৭ সাল তথা পাকিস্তান আমল থেকে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তা নিঃসন্দেহে গৌরবের। ষাটের দশকে আমি নিজেও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। সেই আন্দোলনের পরিণতিতে ১৯৭১ সালের যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, তা নিয়ে মহান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নিজেরও গর্ব আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে পাকিস্তান আমলের আগে যে ব্রিটিশবিরোধী মহান রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে, যার ঐতিহ্যের অধিকারী উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান_এ তিন দেশেরই জনগণ, সেই মহান ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ভুলে গেলে চলবে না। ভারত ও বাংলাদেশের আছে একই সাধারণ ইতিহাস, একই সাধারণ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং একই ভাষা (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা, আসামের অংশবিশেষের জনগণের ভাষা হলো বাংলা)। তাই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয় দেশের সাধারণ সম্পত্তি। বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, মীর মশাররফ হোসেন, লালন শাহ, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ আমাদের দুই দেশের মহান সম্পদ। এ তো গেল সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা। যেসব রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁদের কি দেশ বিভাগের মতোই ভাগ করা যাবে? নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তো বটেই (যাঁর অন্তর্ধান ঘটেছিল ১৯৪৫ সালে), এমনকি মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল গাফফার খান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়ক এবং একই ঐতিহ্যের অংশ। তাঁদের প্রত্যেককেই আমরা যদি শ্রদ্ধা জানাতে না পারি, তবে সে কলঙ্ক আমাদের, অন্য কারোর নয়।
প্রসঙ্গক্রমে আসতে পারে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাম। তিনিও যে ইতিহাসের অংশ, সেটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাঁকে আমরা সম্মান জানাতে পারছি না। কারণ তাঁর রাজনীতিটা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী। উপরন্তু তিনি বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছিলেন, তাতে বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে নিন্দা ও ধিক্কারই তাঁর পাওনা ছিল।
আমাদের দেশে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো বটেই, এমনকি অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর মধ্যেও ভাবখানা এমন যেন ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস। তার আগের ইতিহাস যেন আমাদের পাঠ্য নয়। কিন্তু ২০০ বছরের সশস্ত্র ও নিরস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা ব্রিটিশকে তাড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই সংগ্রামের মধ্যে ছিল তিনটি ধারা। প্রথমত সশস্ত্র ধারা, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, যাকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন_ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, যার প্রধান নেতা বা নেত্রী ছিলেন নানা সাহেব, তাতিয়া তোপি, ঝাঁসির রানি প্রমুখ। এই সংগ্রাম ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াই। সশস্ত্র সংগ্রামের নবপর্যায়ের ধারা তৈরি হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে তৃতীয় দশক পর্যন্ত, যাঁর নায়ক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ (একপর্যায় পর্যন্ত)। সূর্য সেন, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু এবং অনুশীলন, যুগান্তর দলের নেতারা। আরো পরে আমরা দেখব মহান জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দু ফৌজের সশস্ত্র যুদ্ধ, যাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ছিলেন সেনাপতি ও সাধারণ সৈনিকের পদে। ১৯৪৬ সালের বোম্বাইয়ের মহান নৌ-বিদ্রোহ ব্রিটিশ যুগের সর্বশেষ সশস্ত্র সংগ্রামের ঘটনা, সেটিও ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াই।
সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি ছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে দেশ কাঁপানো গণ-আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, লবণ আন্দোলন ও ভারত ছাড় আন্দোলন। তৃতীয় আরেকটি ধারাও ছিল, তা হলো, শ্রমিক-কৃষকের জঙ্গি সংগ্রাম, যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্টরা। এই তিন ধারার যোগফলেই এসেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে পথভ্রষ্ট, বিভক্ত ও দুর্বল করার জন্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আনুকূল্যে গড়ে উঠেছিল একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন, দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন। বাংলাদেশের মুসলমান জনগণ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে যাঁরা এ দেশের জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁরা সবাই একদিন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা বা কর্মী ছিলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান_সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাজনীতির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন। ষাটের দশকে বাঙালি জনগণের পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনায় যে বিশাল জাগরণ ঘটেছিল, তা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য নেতৃত্বের কারণেই।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে নয়। উপরন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা কেবল পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে নতুন এক দেশ করিনি, অর্থাৎ আরেকটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করিনি (অথবা অনেকে যেভাবে বলেন, লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেছি মাত্র; তা কিন্তু নয়), আমরা জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্ব খণ্ডন করেই প্রগতিশীল চেতনার জন্ম দিয়েছি। সে জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানের আরেকটি সংস্করণ নয়, যদিও তেমনটি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গেই বলতে হয় যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমোদন অথবা সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' শব্দ যোগ ইত্যাদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
আবারও বলতে চাই যে পাকিস্তানি ভাবধারা নানাভাবে আমাদের শাসকবর্গ ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একাদশের মধ্যে সচেতন বা অসচেতনভাবে আছে বলেই আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করি, যে মহান ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা ঝাঁসির রানি, তিতুমীর, ভগৎ সিং, সূর্য সেন, বাঘা যতীন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু অথবা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, খান আবদুল গাফফার খান প্রমুখ। এসব নেতার কোনো কোনো ভূমিকা নিয়ে হয়তো কারোর সমালোচনা থাকতে পারে। কোনো রাজনৈতিক নেতাই সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। কিন্তু তাঁরা সবাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যোদ্ধা হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধেয় এবং আমাদের ঐতিহ্যের অংশ।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। পাকিস্তান আমলে লেখক খন্দকার ইলিয়াস একটি বহুল প্রচারিত ও বহুল প্রশংসিত বই লিখেছিলেন 'ভাসানী যখন ইউরোপে'। আইয়ুব সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার হাইকোর্টে রিট হয়েছিল, হাইকোর্ট অবশ্য নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছিলেন। হাইকোর্টের বিচারক নিষিদ্ধ রাখার পক্ষে যেসব যুক্তি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সূর্য সেনের প্রসঙ্গটি এসেছিল। বিচারকের মতে, সূর্য সেন ছিলেন ডাকাত ও হত্যাকারী, উপরন্তু হিন্দু। যে বইয়ে সূর্য সেনের প্রশংসা করা হয়েছে, সেই বই নাকি পাকিস্তানে চলতে দেওয়া যায় না। বইটির এক স্থানে মওলানা ভাসানী দেশপ্রেমিক সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন, লেখক নিজেও শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। এটাই ছিল অপরাধ। এটাই ছিল পাকিস্তানি মানসিকতা। বর্তমানে এতটা সোচ্চার না হলেও সেই পাকিস্তানি মানসিকতা কি একবারে শেষ হয়ে গেছে? আমার সন্দেহ আছে। অন্যথায় বীরকন্যা স্বাধীনতার যোদ্ধা প্রীতিলতা কেন মিডিয়ায় এতটা উপেক্ষিত হবেন? কেন দেখতে পাই না জন্মশতবর্ষে রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান? প্রীতিলতার নামে ও সূর্য সেনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থাকলেও কেন নেই সেখানে তাঁদের কোনো আবক্ষ মূর্তি। যে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে প্রীতিলতা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, চট্টগ্রামের সেই ইউরোপিয়ান ক্লাবটিকে কেন এখনো মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়নি। এটি এখন একটি সরকারি অফিস। অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় আছে। প্রীতিলতার বা সংগ্রামের চিহ্নমাত্র নেই।
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের একটি মূর্তি আছে, জে এম সেন হলের পাশে তাও আবার খাঁচার মধ্যে বন্দি অবস্থায়। ছি! ছি! এ যে কত বড় লজ্জার কথা। লিখতেও সংকোচ বোধ হচ্ছে।
আশা করি, আমরা যেন ব্রিটিশবিরোধী ঐতিহ্যপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাসকে খণ্ডিত না করি অথবা ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা না করি কিংবা সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে বিকৃত করার চেষ্টা না করি।
ঝাঁসির রানি, তিতুমীর, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, কানাই লাল, বাঘা যতীন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার যে মহান ঐতিহ্য তৈরি করে গেছেন, আমরা যেন তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও যেন স্থান পান এসব জাতীয় বীর। আমাদের শিশুরা যেন গড়ে ওঠে তাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। মহীয়সী বীর নারী ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অকুতোভয় যোদ্ধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি সশস্ত্র সালাম ও শ্রদ্ধা।
No comments