ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনঃ ত্যাগ-শুভেচ্ছা-উপদেশে রাজধানী সয়লাব by অমিতোষ পাল ও পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
দলীয় সমর্থন পাওয়ার আগেই নিজেদের প্রার্থী হিসেবে জাহির করে ব্যানার-পোস্টারে রাজধানীর আনাচ-কানাচ ঢেকে ফেলছেন ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের অনেক নেতা। কেউ কেউ দলীয় সমর্থন চেয়ে নানা বাণী ও স্লোগান দিয়ে নিজ দল ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি এর ফলে সৌন্দর্যহানি হচ্ছে নগরীর।
জানা গেছে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের জন্য এখনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামেনি। প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেনি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নেই বলে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। তাই আগাম দৌড়ে এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দৌরাত্ম্যই বেশি। তাঁদের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে নানা উপদেশ, রাজনৈতিক দলের জন্য তাঁদের ত্যাগের গুণগান, ঢাকা সিটিকে বিভক্ত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারকে শুভেচ্ছা এবং বিভিন্ন দিবসভিত্তিক শুভেচ্ছা নগরীর একটু পর পর নজরে পড়ছে। এমনকি রাজধানীতে চলাচলকারী লোকাল বাসগুলোর গা-ও পোস্টারে সয়লাব।
শুধু রাজনৈতিক দলের নামেই নয়, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জন্য প্রচারণার জোয়ার শুরু হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নামেও। অনেকের মতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাঁদের নির্বাচনী ব্যয়ের অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে এপ্রিলে তফসিল ও ২৪ মে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করায় প্রচারণার ঝনঝনানি আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে দেয়াললিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ পাস হয়েছে, যাতে দেয়াললিখন ও পোস্টার লাগানোর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তবে আইনটি কার্যকর না হওয়ার কারণে প্রচারণা চালানোর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামছে না।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে দলের এক ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে নেমেছেন। বিগত তিনটি সিটি নির্বাচন- চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর এবার তারা রাজধানী দখল করতে মরিয়া। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন না করায় স্থির থাকলে আওয়ামী লীগের এই আশা সহজে অর্জিত হবে বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা।
ঢাকা সিটির উত্তর ভাগে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে মাঠে আছেন দলের ঢাকা মহানগর সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এই ভাগে আওয়ামী লীগের আর কোনো শক্ত মনোনয়নপ্রত্যাশী না থাকলেও দলটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না নির্বাচন করার ব্যাপারে আগ্রহী এবং তিনি প্রচারণাও চালাচ্ছেন। দক্ষিণে ক্ষমতাসীন দলটির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রচারণায় নেমেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন মহানগরের সহসভাপতি ফয়েজ উদ্দিন মিয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খোকন।
তবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ইমেজ এবং পুরান ঢাকার লোক হিসেবে সাঈদ খোকন অন্যদের তুলনায় এগিয়ে আছেন। আর ঢাকা উত্তরে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন অন্যদের তুলনায়।
তবে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের কর্মপন্থা বা প্রার্থী মনোনয়নের কাজ শুরু হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান শেখ হাসিনা এই নির্বাচন জোটগতভাবে করা হবে না বলে শরিক দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও মহাজোট থেকেই এই নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা অনেক হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মহাজোটভুক্ত দলগুলোর নিজেদের প্রার্থীদের মধ্যে।
জাতীয় পার্টির এরশাদ গত শনিবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিভক্ত সিটি করপোরেশনের একটির প্রার্থী তাঁর দল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। ক্ষমতাসীন মহাজোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক জাতীয় পার্টি অবশ্য ইতিমধ্যেই বিভক্ত সিটির দুই অংশে দুজন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাঁরা হলেন উত্তরে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন আহম্মেদ বাবুল এবং দক্ষিণে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর দক্ষিণের সভাপতি কাজী ফিরোজ রশীদ। তাঁরা ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন এবং জোরকদমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের পোস্টারও দেখা যাচ্ছে।
এ ছাড়া শরিক দলগুলোর মধ্যে জাসদের পক্ষে ডিসিসি উত্তরে মীর হোসাইন আখতার এবং দক্ষিণে শিরীন আখতারের পক্ষে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে প্রচারণা দেখা গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি পোস্টার, বিলবোর্ড ও প্রচারণায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনপ্রত্যাশী সাঈদ খোকন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাজি মোহাম্মদ সেলিম, আওলাদ হোসেন, স্বতন্ত্র ড. তুহিন মালিক ও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে বিশাল বিলবোর্ড বসানো হয়েছে সাঈদ খোকনের পক্ষে। সেখানে তাঁর ছবিসহ রয়েছে ছোট একটি শিশুরও ছবি। স্লোগান হিসেবে লেখা হয়েছে, 'আসুন শিশু ও সুস্থ বিকাশে সহায়ক নগরী গড়ে তুলি/আলহাজ সাঈদ খোকন'। তেমনি নিজের ছবিসংবলিত হাজি মোহাম্মদ সেলিমের পোস্টারে লেখা রয়েছে, 'বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি বিশ্বাসে বিশ্বাসী/হাজি মোহাম্মদ সেলিম'। সম্মিলিত নাগরিক সমাজের ব্যানারে ড. তুহিন মালিকের পোস্টারে লেখা রয়েছে, 'সৎ ও যোগ্য মেয়র পদে নতুন প্রজন্মের নতুন সিদ্ধান্ত ড. তুহিন মালিক/প্রচারে সম্মিলিত নাগরিক সমাজ'। এ রকম শত বক্তব্য ও স্লোগান নিয়ে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার-ব্যানার। পুরান ঢাকার সদরঘাট থেকে উত্তরা, শনির আখড়া থেকে গাবতলী- সর্বত্রই একই অবস্থা।
আসন্ন এই নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আওয়ামী লীগ এখনো ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর, দক্ষিণ) নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচনে যদি দলীয় প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে তফসিল ঘোষণার পর আগ্রহী প্রার্থীদের সঙ্গে বসে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এর আগে তারা কী করল না করল, সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় না।'
ঢাকা দক্ষিণে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাঈদ খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, নির্বাচনের জন্য আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং প্রচারণা ও গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছি।' দলীয় সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সাঈদ খোকন বলেন, 'এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ এখতিয়ার দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার। তিনি যাঁকে মনোনয়ন দেবেন, তিনিই হবেন দলের প্রার্থী। তবে আমার বিশ্বাস, তিনি আমাকেই বেছে নেবেন। এ জন্যই প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছি।'
ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণে জাতীয় পার্টি থেকে ঘোষিত প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দক্ষিণে যেসব প্রার্থী আছেন, তাদের মধ্যে আমি এগিয়ে। মানুষ ভোট দেওয়ার সময় দল বিবেচনায় রাখবে। সেই হিসাবে জাতীয় পার্টি মানুষের এখন প্রথম পছন্দ। তারাই আমার নামে পোস্টার-ব্যানার টাঙাচ্ছে। আমিও জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।'
No comments