কল্পকথার গল্প-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির যন্ত্র চাই by আলী হাবিব
যাপিত জীবনে যন্ত্রণার শেষ নেই। ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি- এ চিত্র এখন পুরনো। উল্টো এটাই যেন নিয়ম। এমন অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে, বউয়ের চোখ রাঙানি না দেখলে যাদের কাছে জীবনটা পানসে মনে হয়। সারাদিন কাটে অস্বস্তিতে। কী একটা জরুরি কাজ যেন বাকি রয়ে গেছে, কী একটা যেন করা হয়নি- এ রকম মনে হয়।
মনে হয়, প্রতিদিনের রুটিন থেকে কী একটা যেন বাদ থেকে গেল। নিন্দুকরা এটাকে বলবেন নিগ্রহ। যদিও এভাবে নিগৃহীত হতে আগ্রহী পুরুষের সংখ্যা কিন্তু পৃথিবীতে কম নয়। নিগ্রহের ভেতর দিয়ে অথবা নিগৃহীত হওয়ার ভেতর দিয়ে প্রেমের প্রকাশ! ঘরের কথা বাইরে বলে লাভ নেই। ব্যাপারটা বিশ্বজনীন। আজ থেকে প্রায় ৪২২ বছর আগে শেকসপিয়র লিখেছিলেন, মুখরা রমণী বশীকরণ।
কাজেই ঘরের কথা চার দেয়ালে বন্দি রেখে বাইরের কিছু ব্যাপার নিয়ে বরং কথা বলা যাক। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আপনি ঘরকে দূরে ঠেলে দিতে পারেন না! চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। প্রথম পাঠশালা। ঘর আপনাকে টানবেই। এ কালে তো তেমন বন নেই যে ইচ্ছে করলেই 'ভোলে বাবা'টি সেজে ধ্যানস্থ হয়ে যাবেন! ঘরে যাঁদের যন্ত্রণা, তাঁরা যদি ভাবেন যে বাইরে কোথাও শান্তি খুঁজবেন- ভুল ধারণা। ঘরের বাইরেও যন্ত্রণা কম নেই। হয়তো ঘর থেকে বের হতেই এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, যাকে আপনি এড়িয়ে চলতে চান। দেখামাত্র আপনিও এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলেন। গায়ে পড়ে তিনিই এসে আলাপ শুরু করে দিলেন। সেই আলাপের সবটুকু জুড়ে কেবল তাঁর নিজের কথাই বলে গেলেন ভদ্রলোক। হে হে করে হাসলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আপনার কিছুই করার নেই। আপনার অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে জাহির করে তিনি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে' দেওয়ার মতো বলে গেলেন, 'আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। আজকাল প্রাণ খুলে কথা বলার মতো লোকের খুব অভাব। আপনাকে তবু পাওয়া গেল। প্রাণ খুলে দুটো কথা বলতে পারলাম।'
এমন লোকের পাল্লায় পড়লে কী করবেন? অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় তো হাতে নেই। ভদ্রলোক বিদায় হতেই একটু যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, তার উপায় নেই। একের পর এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু হয়ে যাবে। ধরুন, আপনি যাচ্ছেন আপনার অফিসের দিকে। পাবলিক বাসে উঠবেন। সেখানে একপ্রস্থ যুদ্ধ। উঠলেন। সিটে বসলেন। তার পরও যে নিরিবিলি যেতে পারবেন, সে উপায় কি আছে! সেখানেও দেখবেন নানা জ্ঞানে জ্ঞানী মানুষের সমাবেশ। এক একজন এক এক বিষয়ে 'সবজান্তা শমসের'। বিশেষজ্ঞ বচন শুনতে শুনতে অফিসে পেঁৗছেও কি রেহাই আছে? অফিস কলিগরাও তো কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। আপনি যখন নিজের ঘর-সংসার, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাবছেন, তখন তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বরাজনীতির পোস্টমর্টেম করছেন। করবেন টা কী? চরম বিরক্তি নিয়ে ভাবতে পারেন, এঁদের জিহ্বা বশে রাখার মতো কোনো মন্ত্র জানা থাকলে সেটা কাজে লাগানো যেত। মন্ত্র পড়ে সবাইকে বশীভূত করে রাখতে পারলে অনেক অবাঞ্ছিত কথা শুনতে হতো না। শ্রবণেন্দ্রিয় অন্তত কিছুটা হলেও বিশ্রাম পেত। কিন্তু যন্ত্রের যুগে এই মন্ত্র কতটা কার্যকর, সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে। অথবা ঘরে ও বাইরের নিগ্রহ সয়ে বিগ্রহের মতো অনুভূতিহীন হয়ে থাকাটাই উত্তম। তাতে ঘরেও শান্তি বজায় থাকে। কিন্তু সেটা তো হওয়ার জো নেই। শব্দ হলে কান সচকিত হবেই। অতএব মুখ বশ করতে হবে।
আমরা বশ করি কী করে? তাবিজ করা যেতে পারে। আজকাল আবার গুণীনের অভাব। স্বাভাবিক কারণেই বশীকরণ তাবিজ জোটানো মুশকিল হয়ে গেছে। সে আমলে গুণীনদের দেখা পাওয়া গেছে। পারতেন তাঁরা। হাড় মড়মড়ি ব্যারাম থেকে শুরু করে হাজারটা ব্যারাম সারিয়ে তুলতে তাঁদের জুড়ি ছিল না। আর একটা উপায় হতে পারে ওষুধ। ওষুধ তো আমরা আকসারই সেবন করে থাকি। কত রকমের ওষুধ যে বেরিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ওষুধের কিংবা অসুখের গুণেই হোক, আমরা ঘরে ঘরে ডাক্তার হয়ে গেছি। নিজেরা নিজেদের ওপর ওষুধ তো প্রয়োগ করেই থাকি। অন্যকে বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র দিতেও পিছপা হই না। সর্দি বন্ধের ওষুধ আছে। জ্বর সারানোর ওষুধ আছে। ব্যথা কমানোর ওষুধ আছে। ঘরে-বাইরে কথার জ্বালায় জ্বলছি যখন, কথা কমানোর ওষুধ থাকবে না কেন? থাকতেও তো পারে। তেমন ওষুধ আদৌ কি আছে? কী এক ওষুধ নাকি বেরিয়েছে, যেটা খাইয়ে দিলে মানুষ আর মিথ্যে কথা বলতে পারে না। তো তেমন একটা ওষুধ বের করা কি খুব কঠিন কাজ? একলব্য বাণ মেরে কুরুপাণ্ডবদের কুকুরের কণ্ঠরোধ করে দিয়েছিলেন। এখন তো আর একলব্যের সময় নয়। আর ওসব বাণ-টান উঠে গেছে। এখন সময় হচ্ছে ড্রোনের। কাজেই সে চিন্তা বাদ দিতে হবে। ওষুধ নিয়েই ভাবা যেতে পারে। ধন্বন্তরির মতো আয়ুর্বেদ থাকলে বোধহয় এ নিয়ে ভাবতে হতো না। ধন্বন্তরি ছিলেন দেবতাদের চিকিৎসক। রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে তাঁর ওষুধ ছিল অব্যর্থ। দেবতা ও অসুরদের সম্মিলিত আয়োজনে সমুদ্রমন্থনে অমৃতভাণ্ড হাতে তাঁর আবির্ভাব। এটা হচ্ছে পুরাণের কিসসা।
কিন্তু এখন? সে দিন হয়েছে বাসি! শর নিক্ষেপ করে মুখ বন্ধ করার উপায় নেই। বশীকরণ তাবিজ দেওয়ার মতো গুণীন নেই। উপরন্তু সময়টা নিয়েও তো ভাবতে হবে। কারো বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ তো আর এখন নেই। আমরা এখন অপারগ হয়ে বসে আছি। না হয়েও যেন উপায় নেই! মানুষ এখন চাঁদে যাচ্ছে। মহাশূন্যে কোথায় কী হচ্ছে, তার খোঁজ রাখছে নিজের ঘরে বসে। নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয়। আমাকে, আপনাকে ঘরে ও বাইরে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যের বকবকানি শুনতে হচ্ছে। সেটা হজম করতে হচ্ছে। ডুবতে ডুবতে খড়কুটো আশ্রয় করে বেঁচে যাওয়ার মতো একটু আশার আলো দেখতে পাওয়া গেল একটা ছোট খবরে। সে খবরে বলা হচ্ছে, মানুষের বকবকানি বন্ধের একটা যন্ত্র নাকি আবিষ্কার হয়ে গেছে। জাপানের বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যে যন্ত্র মানুষের বকবকানি বন্ধ করে দেবে। এমনকি শরনিক্ষেপের মতো কারো কারো বাকশক্তি রহিত করে দেওয়ার ক্ষমতাও নাকি সে যন্ত্রটার আছে। কী সাংঘাতিক! এটা হলে তো ঘরে ঘরে বিপ্লব ঘটে যাবে। মুখরা রমণী বশীকরণ শুধু নয়, মুখর পুরুষ বশ করতেও ব্যবহৃত হবে যন্ত্রটি। হাতে হাতে চলে যাবে যন্ত্র। আমরা সবাই যন্ত্র হাতে ঘুরব। আমাদের সামনে কেউ বেশি কথা বললে আমরা যন্ত্রটি চালু করে দেব। কথা বন্ধ হয়ে যাবে। ঘরে ঘরে ঝগড়া থেমে যাবে। মাঠে মাঠে বাহাস হবে না। 'মানি না, মানব না' জাতীয় স্লোগানও কি বন্ধ হয়ে যাবে এই যন্ত্রের প্রভাবে?
শুধু কথা বন্ধ হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল! মুখ দিয়ে আমরা কথা বলি। প্রয়োজনীয় কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথাও বলি অনেক সময়। কথা বলতে গিয়ে নিজেরা যেমন বিব্রত হই, অন্যকেও বিব্রত করি। এখন জাপানি বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার হয়তো বিব্রতকর অনেক পরিস্থিতি থেকে আমাদের মুক্তি দেবে। এই যন্ত্র কি বাকসর্বস্ব রাজনীতির বাকচাতুর্য থেকে মুক্তি দেবে আমাদের? আশা করতে বাধা নেই। কিন্তু মুখ ছাড়াও তো আরো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে আমাদের। প্রতিটি মানুষেরই দুটো হাত আছে। হাত যখন আছে, তখন হাতাহাতির পাশাপাশি হাতিয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতাও সমাজে লক্ষণীয়। অযাচিত হস্তক্ষেপের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হলে বেশ হতো। আবার ধরা যাক, আমাদের পা আছে। পা অর্থাৎ পদ। কবি মোফাজ্জল করিমের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করি, 'পদ আছে তাই পদাঘাতের জন্য/পৃষ্ঠদেশও হন্যে হয়ে খোঁজেন/পদ আছে তাই পদাধিকার বলে/ত্রিকালজ্ঞ, সকল কিছুই বোঝেন।' কবিতা ছেড়ে পায়ে পড়া যাক। পায়ের জন্য যদি একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা যেত, তাহলে হয়তো অনেকের পদক্ষেপ সম্পর্কে আগাম জানা যেত।
এমন অভিনব সব যন্ত্র, যদি হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, জীবন হবে যন্ত্রণামুক্ত। তাই যন্ত্রের যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণা মুক্তির যন্ত্র চাই।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
কাজেই ঘরের কথা চার দেয়ালে বন্দি রেখে বাইরের কিছু ব্যাপার নিয়ে বরং কথা বলা যাক। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আপনি ঘরকে দূরে ঠেলে দিতে পারেন না! চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। প্রথম পাঠশালা। ঘর আপনাকে টানবেই। এ কালে তো তেমন বন নেই যে ইচ্ছে করলেই 'ভোলে বাবা'টি সেজে ধ্যানস্থ হয়ে যাবেন! ঘরে যাঁদের যন্ত্রণা, তাঁরা যদি ভাবেন যে বাইরে কোথাও শান্তি খুঁজবেন- ভুল ধারণা। ঘরের বাইরেও যন্ত্রণা কম নেই। হয়তো ঘর থেকে বের হতেই এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, যাকে আপনি এড়িয়ে চলতে চান। দেখামাত্র আপনিও এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলেন। গায়ে পড়ে তিনিই এসে আলাপ শুরু করে দিলেন। সেই আলাপের সবটুকু জুড়ে কেবল তাঁর নিজের কথাই বলে গেলেন ভদ্রলোক। হে হে করে হাসলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আপনার কিছুই করার নেই। আপনার অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে জাহির করে তিনি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে' দেওয়ার মতো বলে গেলেন, 'আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। আজকাল প্রাণ খুলে কথা বলার মতো লোকের খুব অভাব। আপনাকে তবু পাওয়া গেল। প্রাণ খুলে দুটো কথা বলতে পারলাম।'
এমন লোকের পাল্লায় পড়লে কী করবেন? অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় তো হাতে নেই। ভদ্রলোক বিদায় হতেই একটু যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, তার উপায় নেই। একের পর এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু হয়ে যাবে। ধরুন, আপনি যাচ্ছেন আপনার অফিসের দিকে। পাবলিক বাসে উঠবেন। সেখানে একপ্রস্থ যুদ্ধ। উঠলেন। সিটে বসলেন। তার পরও যে নিরিবিলি যেতে পারবেন, সে উপায় কি আছে! সেখানেও দেখবেন নানা জ্ঞানে জ্ঞানী মানুষের সমাবেশ। এক একজন এক এক বিষয়ে 'সবজান্তা শমসের'। বিশেষজ্ঞ বচন শুনতে শুনতে অফিসে পেঁৗছেও কি রেহাই আছে? অফিস কলিগরাও তো কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। আপনি যখন নিজের ঘর-সংসার, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাবছেন, তখন তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বরাজনীতির পোস্টমর্টেম করছেন। করবেন টা কী? চরম বিরক্তি নিয়ে ভাবতে পারেন, এঁদের জিহ্বা বশে রাখার মতো কোনো মন্ত্র জানা থাকলে সেটা কাজে লাগানো যেত। মন্ত্র পড়ে সবাইকে বশীভূত করে রাখতে পারলে অনেক অবাঞ্ছিত কথা শুনতে হতো না। শ্রবণেন্দ্রিয় অন্তত কিছুটা হলেও বিশ্রাম পেত। কিন্তু যন্ত্রের যুগে এই মন্ত্র কতটা কার্যকর, সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে। অথবা ঘরে ও বাইরের নিগ্রহ সয়ে বিগ্রহের মতো অনুভূতিহীন হয়ে থাকাটাই উত্তম। তাতে ঘরেও শান্তি বজায় থাকে। কিন্তু সেটা তো হওয়ার জো নেই। শব্দ হলে কান সচকিত হবেই। অতএব মুখ বশ করতে হবে।
আমরা বশ করি কী করে? তাবিজ করা যেতে পারে। আজকাল আবার গুণীনের অভাব। স্বাভাবিক কারণেই বশীকরণ তাবিজ জোটানো মুশকিল হয়ে গেছে। সে আমলে গুণীনদের দেখা পাওয়া গেছে। পারতেন তাঁরা। হাড় মড়মড়ি ব্যারাম থেকে শুরু করে হাজারটা ব্যারাম সারিয়ে তুলতে তাঁদের জুড়ি ছিল না। আর একটা উপায় হতে পারে ওষুধ। ওষুধ তো আমরা আকসারই সেবন করে থাকি। কত রকমের ওষুধ যে বেরিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ওষুধের কিংবা অসুখের গুণেই হোক, আমরা ঘরে ঘরে ডাক্তার হয়ে গেছি। নিজেরা নিজেদের ওপর ওষুধ তো প্রয়োগ করেই থাকি। অন্যকে বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র দিতেও পিছপা হই না। সর্দি বন্ধের ওষুধ আছে। জ্বর সারানোর ওষুধ আছে। ব্যথা কমানোর ওষুধ আছে। ঘরে-বাইরে কথার জ্বালায় জ্বলছি যখন, কথা কমানোর ওষুধ থাকবে না কেন? থাকতেও তো পারে। তেমন ওষুধ আদৌ কি আছে? কী এক ওষুধ নাকি বেরিয়েছে, যেটা খাইয়ে দিলে মানুষ আর মিথ্যে কথা বলতে পারে না। তো তেমন একটা ওষুধ বের করা কি খুব কঠিন কাজ? একলব্য বাণ মেরে কুরুপাণ্ডবদের কুকুরের কণ্ঠরোধ করে দিয়েছিলেন। এখন তো আর একলব্যের সময় নয়। আর ওসব বাণ-টান উঠে গেছে। এখন সময় হচ্ছে ড্রোনের। কাজেই সে চিন্তা বাদ দিতে হবে। ওষুধ নিয়েই ভাবা যেতে পারে। ধন্বন্তরির মতো আয়ুর্বেদ থাকলে বোধহয় এ নিয়ে ভাবতে হতো না। ধন্বন্তরি ছিলেন দেবতাদের চিকিৎসক। রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে তাঁর ওষুধ ছিল অব্যর্থ। দেবতা ও অসুরদের সম্মিলিত আয়োজনে সমুদ্রমন্থনে অমৃতভাণ্ড হাতে তাঁর আবির্ভাব। এটা হচ্ছে পুরাণের কিসসা।
কিন্তু এখন? সে দিন হয়েছে বাসি! শর নিক্ষেপ করে মুখ বন্ধ করার উপায় নেই। বশীকরণ তাবিজ দেওয়ার মতো গুণীন নেই। উপরন্তু সময়টা নিয়েও তো ভাবতে হবে। কারো বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ তো আর এখন নেই। আমরা এখন অপারগ হয়ে বসে আছি। না হয়েও যেন উপায় নেই! মানুষ এখন চাঁদে যাচ্ছে। মহাশূন্যে কোথায় কী হচ্ছে, তার খোঁজ রাখছে নিজের ঘরে বসে। নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয়। আমাকে, আপনাকে ঘরে ও বাইরে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যের বকবকানি শুনতে হচ্ছে। সেটা হজম করতে হচ্ছে। ডুবতে ডুবতে খড়কুটো আশ্রয় করে বেঁচে যাওয়ার মতো একটু আশার আলো দেখতে পাওয়া গেল একটা ছোট খবরে। সে খবরে বলা হচ্ছে, মানুষের বকবকানি বন্ধের একটা যন্ত্র নাকি আবিষ্কার হয়ে গেছে। জাপানের বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যে যন্ত্র মানুষের বকবকানি বন্ধ করে দেবে। এমনকি শরনিক্ষেপের মতো কারো কারো বাকশক্তি রহিত করে দেওয়ার ক্ষমতাও নাকি সে যন্ত্রটার আছে। কী সাংঘাতিক! এটা হলে তো ঘরে ঘরে বিপ্লব ঘটে যাবে। মুখরা রমণী বশীকরণ শুধু নয়, মুখর পুরুষ বশ করতেও ব্যবহৃত হবে যন্ত্রটি। হাতে হাতে চলে যাবে যন্ত্র। আমরা সবাই যন্ত্র হাতে ঘুরব। আমাদের সামনে কেউ বেশি কথা বললে আমরা যন্ত্রটি চালু করে দেব। কথা বন্ধ হয়ে যাবে। ঘরে ঘরে ঝগড়া থেমে যাবে। মাঠে মাঠে বাহাস হবে না। 'মানি না, মানব না' জাতীয় স্লোগানও কি বন্ধ হয়ে যাবে এই যন্ত্রের প্রভাবে?
শুধু কথা বন্ধ হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল! মুখ দিয়ে আমরা কথা বলি। প্রয়োজনীয় কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথাও বলি অনেক সময়। কথা বলতে গিয়ে নিজেরা যেমন বিব্রত হই, অন্যকেও বিব্রত করি। এখন জাপানি বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার হয়তো বিব্রতকর অনেক পরিস্থিতি থেকে আমাদের মুক্তি দেবে। এই যন্ত্র কি বাকসর্বস্ব রাজনীতির বাকচাতুর্য থেকে মুক্তি দেবে আমাদের? আশা করতে বাধা নেই। কিন্তু মুখ ছাড়াও তো আরো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে আমাদের। প্রতিটি মানুষেরই দুটো হাত আছে। হাত যখন আছে, তখন হাতাহাতির পাশাপাশি হাতিয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতাও সমাজে লক্ষণীয়। অযাচিত হস্তক্ষেপের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হলে বেশ হতো। আবার ধরা যাক, আমাদের পা আছে। পা অর্থাৎ পদ। কবি মোফাজ্জল করিমের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করি, 'পদ আছে তাই পদাঘাতের জন্য/পৃষ্ঠদেশও হন্যে হয়ে খোঁজেন/পদ আছে তাই পদাধিকার বলে/ত্রিকালজ্ঞ, সকল কিছুই বোঝেন।' কবিতা ছেড়ে পায়ে পড়া যাক। পায়ের জন্য যদি একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা যেত, তাহলে হয়তো অনেকের পদক্ষেপ সম্পর্কে আগাম জানা যেত।
এমন অভিনব সব যন্ত্র, যদি হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, জীবন হবে যন্ত্রণামুক্ত। তাই যন্ত্রের যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণা মুক্তির যন্ত্র চাই।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments