রবীন্দ্র-ভাবনায় বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও পরিবেশ by কানন পুরকায়স্থ
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, 'আমি বিজ্ঞানের সাধক নই, সে কথা বলা বাহুল্য, কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর এই লোভের সন্ধান পাই ১২ বছর বয়সে লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে।
এই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, 'গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি'। এই প্রবন্ধ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। অনেকের মতে এই বৈজ্ঞানিক রচনাটি রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত প্রথম গদ্য রচনা। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশ নিয়ে রবীন্দ্র-ভাবনার ভাস্কর্য যেভাবে নির্মিত হয়, তার নির্যাস উপস্থাপন করা এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
বিজ্ঞান : শৈশবে রবীন্দ্রনাথের কাছে সৌরজগৎ ছিল একটি আকর্ষণের বিষয়। এই সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর ভাবনা সুস্পষ্ট হয় 'গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি' প্রবন্ধে। তিনি উল্লেখ করেন, 'এই পার্থিব গ্রহ তিনটি-বুধ, শুক্র ও মঙ্গল। ইহারা সৌরজগতের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য গ্রহ অপেক্ষা সূর্য হইতে কম দূরে অবস্থিত হইয়া তাহার চতুর্দিকে পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে পরিক্রমণ করে।' তিনি আরো উল্লেখ করেন যে 'পরম কারুণিক পরমেশ্বর পৃথিবীকে আমাদের বাস করিবার জন্য বিবিধ প্রকার পরস্পর উপযোগী ব্যবস্থা সকল পূর্ব হইতে নিরুপিত করিয়া দিয়াছেন।' এখানে বালক রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতবর্ষের অধ্যায় ভাবনার ধারায় বিজ্ঞানের অন্বেষণ করার চেষ্টা করছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দুই বছর আগে ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের 'অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ' গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) এবং অভিযোজনের (adaptation) মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণের অভিব্যক্তি (evaluation) ঘটেছে বলে জানিয়েছেন। ডারউইন ঈশ্বর ভাবনা সম্পর্কে 'ভষবীরনষব' ছিলেন। 'অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের সর্বশেষ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, '...having been originally breathed into a few forms or into one.' কিন্তু ১৮৬০ সালের ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে তাঁর ক্যাথলিক পাঠকদের সুবিধার্থে ডারউইন 'by the creator' শব্দ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় সংস্করণের সর্বশেষ অনুচ্ছেদে ডারউইন লেখেন, '...having been originally breathed by the creator into a few forms or into one.' ঈশ্বরীয় ভাবনার সঙ্গে অভিব্যক্তির ধারণার যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা ডারউইন করেছেন, তা রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান-ভাবনায় ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন বিজ্ঞানের ভাবনার সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বের যোগসূত্র খোঁজা এবং এর স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টা করেছেন।
প্রথম বৈজ্ঞানিক রচনা প্রকাশের ৬৪ বছর পর ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ 'বিশ্বপরিচয়' লেখেন। এই বইটিতে বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত পরিচয় মেলে। এই গ্রন্থে আমরা 'অভিব্যক্তি'র ধারণারও সন্ধান পাই। তা ছাড়া পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং অণু-পরমাণুর গঠন ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। রবীন্দ্রযুগের পর আধুনিক বিজ্ঞান ধাপে ধাপে অনেক এগিয়ে গেছে। তাই 'বিশ্বপরিচয়'-এ বর্ণিত কিছু তথ্য কালের ব্যবধানে অপ্রচলিত ধারণা বলে মনে হতে পারে। তবে রবীন্দ্র-মননে তৎকালীন নানা বৈজ্ঞানিক ধারণা যে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল তা 'বিশ্বপরিচয়' পড়লে বোঝা যায়। বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, 'বুদ্ধিকে মোহমুক্তি ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার।...জ্ঞানের এই পরিবেশন কার্যে পাণ্ডিত্য যথাসাধ্য বর্জনীয় মনে করি।' 'বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায় বিভাজনে আমরা এই 'পাণ্ডিত্য বর্জিত পরিবেশন কার্যে'র আস্বাদন পাই। বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও তথ্যকে 'পরমাণুলোক', 'নক্ষত্রলোক', 'সৌরজগৎ', 'ভূলোক' এবং 'উপসংহার'_এভাবে ভাগ করা হয়েছে। অত্যন্ত সহজ ভাষায় এবং অনেক ক্ষেত্রে নতুন পরিভাষা তৈরি করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থটি।
বিশ্বপর্যায়ের রবীন্দ্রনাথের বাইরে আমরা আরেক রবীন্দ্রনাথকে পাই তাই গান ও কবিতার মাধ্যমে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব বির্মূত ভাবনায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমন কবির একটি গানের কয়েকটি লাইন এইরূপ_'তব নাম লয়ে চন্দ্রতারা, অসীম শূন্যে ধাইছে, রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম গ্রহ হতে গ্রহে চাইছে।' আধুনিক বিজ্ঞানের বিগ ব্যাং তত্ত্ব 'চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে'_এই ধারণাকে সমর্থন করে। মনে রাখতে হবে, বিগ ব্যাং তত্ত্বের আবিষ্কার হয় রবীন্দ্রনাথের এই রচনার অনেক পরে, 'তব নাম লয়ে'_এর সঙ্গে যুক্ত হলো 'সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের' ধারণা। ভারতবর্ষের অধ্যাত্ম ভাবনার সঙ্গে এক অনুপম মেলবন্ধন ঘটল আধুনিক বিজ্ঞানের। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
প্রযুক্তি : আমাদের ইন্দ্রিয় প্রাচ্য বাস্তবতার বাইরে যে জগৎ রয়েছে, যে জগতের সন্ধান লিউয়েনহুক পান তাঁর অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা, গ্যালিলিও পান টেলিস্কোপ দ্বারা, সেই জগতের বিনির্মাণ করে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এক নতুন মূর্ত বাস্তবতার সন্ধান দিয়েছে। বিজ্ঞানের প্রয়োগ প্রযুক্তির মধ্যে নিহিত। ফ্রান্সিস বেকন যখন বলেছেন, 'জ্ঞানই শক্তি', তখন তিনি বিজ্ঞানের প্রয়োগের কথাই বলেছেন। এই 'শক্তি'র ধারণা আমরা রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা' গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রচনা 'The Problem of Evil'-এর মধ্যে পাই। যেখানে কবি বলেছেন, '...through the help of science, as we come to know more of the laws of nature, we gain in power... steam and electricity become our nerve and muscle.' ১৯২৫ সালের এক সময়ে অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'বৈজ্ঞানিক হাতিয়ারের যুগে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বড় ও সংখ্যায় বহুল হয়েছে, অর্থাৎ মানুষ হয়েছে Giant, কিন্তু স্বয়ং মানুষ তাতে বড় হয়নি।' আধুনিক প্রযুক্তিকে কবি স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার ভাবনাও তাঁকে তাড়িত করেছে বারবার।
তিনি বলেছেন, 'বাষ্পের যোগে যেখানে রেলগাড়ি চলে, সেখানে clever-কে দেখি perfect-কে দেখিনে।' এতে মনে হয় প্রযুক্তির ওপর রবীন্দ্রনাথ ততটা আগ্রহী ছিলেন না, যতটা বিজ্ঞানের রসাস্বাদনে লোভী ছিলেন। প্রযুক্তি যেন একজন ব্যক্তির ভূমিকাকে খর্ব না করে সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সচেতন।
পরিবেশ : রবীন্দ্র-ভাবনায় পরিবেশ প্রাচীন ভারতের 'তপোবন'-এর পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহাকবি কালীদাস উজ্জয়িনীতে বসে বৈদিকযুগের তপোবন তথা বিশিষ্ট মুনির আশ্রমের যে বর্ণনা দেন, তাতে দেখা যায় সে সময় তপোবনগুলোর পরিবেশ ছিল মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গাছপালাকে বাদ দিয়ে কোনো জীবনই টিকে থাকতে পারে না। এই ধারণাসজ্জাত বোধ রবীন্দ্র-ভাবনায় পরিলক্ষিত হয়। কলকাতার নগরায়ণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন প্রায় ১০০ বছর আগে। আমরা তাঁর কবিতায় তাই দেখি-'ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট,/নাইকো ভালবাসা, নাইকো খেলা।'
রবীন্দ্রনাথ তপোবনের সাধনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'সেই অরণ্যবাস নিঃসৃত সভ্যতার ধারা সমস্ত ভারতবর্ষকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে এবং আজ পর্যন্ত তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়নি।' শান্তিনিকেতনের আশ্রম ও তার পরিবেশ পর্যালোচনা করলে আমরা রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ-চিন্তার যে স্বরূপ লক্ষ করি, তা হলো এই যে কবি চেয়েছিলেন 'এখনকার কালের বিদ্যা ও তখনকার কালের প্রকৃতি।' তবে এটা সত্য যে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শ এবং আধুনিকতার মধ্যে সাযুজ্য বিধানের সঙ্গে সঙ্গে এক করণের অভিযোজনের চিন্তা-ভাবনাও করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-চিন্তায় ছিল পরিবেশ ও প্রকৃতি। তাই তাঁর কবিতায় লক্ষ করি বৃক্ষকে বন্দনা করার কথা। যেমন-
'অন্ধ ভূমি গর্ভ হতে শুনেছিলাম সূর্যের আহ্বান,/প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ।'/'আহবান' নামের কবিতায় কবি উল্লেখ করেন-/'শিশু কালের থেকে/আকাশ আমার মুখে চেয়ে একলা গেছে ডেকে।' এই কবিতায় লক্ষ করি, পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথ কতটা উন্মুখ ছিলেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশের মধ্যে যে ত্রয়ী সম্পর্ক রয়েছে, রবীন্দ্র-ভাবনায় তা প্রাচীন ভারতের অধ্যাত্ম-ভাবনার সঙ্গে মিশে এক চতুর্মাত্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। আইনস্টাইনের চতুর্মাগ হচ্ছে 'সময়' বা 'কাল'। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চতুর্থতা হচ্ছে ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক জীবনের সমন্বয়ের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ করেছেন। সমন্বয়ের রবীন্দ্র-দর্শন থেকে আমরা পেতে পারি প্রাণ ও অপ্রাণের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান।
লেখক : পরিবেশবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাজ্যের দি ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের ফেলো
বিজ্ঞান : শৈশবে রবীন্দ্রনাথের কাছে সৌরজগৎ ছিল একটি আকর্ষণের বিষয়। এই সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর ভাবনা সুস্পষ্ট হয় 'গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি' প্রবন্ধে। তিনি উল্লেখ করেন, 'এই পার্থিব গ্রহ তিনটি-বুধ, শুক্র ও মঙ্গল। ইহারা সৌরজগতের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য গ্রহ অপেক্ষা সূর্য হইতে কম দূরে অবস্থিত হইয়া তাহার চতুর্দিকে পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে পরিক্রমণ করে।' তিনি আরো উল্লেখ করেন যে 'পরম কারুণিক পরমেশ্বর পৃথিবীকে আমাদের বাস করিবার জন্য বিবিধ প্রকার পরস্পর উপযোগী ব্যবস্থা সকল পূর্ব হইতে নিরুপিত করিয়া দিয়াছেন।' এখানে বালক রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতবর্ষের অধ্যায় ভাবনার ধারায় বিজ্ঞানের অন্বেষণ করার চেষ্টা করছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দুই বছর আগে ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের 'অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ' গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) এবং অভিযোজনের (adaptation) মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণের অভিব্যক্তি (evaluation) ঘটেছে বলে জানিয়েছেন। ডারউইন ঈশ্বর ভাবনা সম্পর্কে 'ভষবীরনষব' ছিলেন। 'অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের সর্বশেষ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, '...having been originally breathed into a few forms or into one.' কিন্তু ১৮৬০ সালের ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে তাঁর ক্যাথলিক পাঠকদের সুবিধার্থে ডারউইন 'by the creator' শব্দ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় সংস্করণের সর্বশেষ অনুচ্ছেদে ডারউইন লেখেন, '...having been originally breathed by the creator into a few forms or into one.' ঈশ্বরীয় ভাবনার সঙ্গে অভিব্যক্তির ধারণার যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা ডারউইন করেছেন, তা রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান-ভাবনায় ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন বিজ্ঞানের ভাবনার সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বের যোগসূত্র খোঁজা এবং এর স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টা করেছেন।
প্রথম বৈজ্ঞানিক রচনা প্রকাশের ৬৪ বছর পর ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ 'বিশ্বপরিচয়' লেখেন। এই বইটিতে বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত পরিচয় মেলে। এই গ্রন্থে আমরা 'অভিব্যক্তি'র ধারণারও সন্ধান পাই। তা ছাড়া পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং অণু-পরমাণুর গঠন ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। রবীন্দ্রযুগের পর আধুনিক বিজ্ঞান ধাপে ধাপে অনেক এগিয়ে গেছে। তাই 'বিশ্বপরিচয়'-এ বর্ণিত কিছু তথ্য কালের ব্যবধানে অপ্রচলিত ধারণা বলে মনে হতে পারে। তবে রবীন্দ্র-মননে তৎকালীন নানা বৈজ্ঞানিক ধারণা যে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল তা 'বিশ্বপরিচয়' পড়লে বোঝা যায়। বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, 'বুদ্ধিকে মোহমুক্তি ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার।...জ্ঞানের এই পরিবেশন কার্যে পাণ্ডিত্য যথাসাধ্য বর্জনীয় মনে করি।' 'বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায় বিভাজনে আমরা এই 'পাণ্ডিত্য বর্জিত পরিবেশন কার্যে'র আস্বাদন পাই। বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও তথ্যকে 'পরমাণুলোক', 'নক্ষত্রলোক', 'সৌরজগৎ', 'ভূলোক' এবং 'উপসংহার'_এভাবে ভাগ করা হয়েছে। অত্যন্ত সহজ ভাষায় এবং অনেক ক্ষেত্রে নতুন পরিভাষা তৈরি করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থটি।
বিশ্বপর্যায়ের রবীন্দ্রনাথের বাইরে আমরা আরেক রবীন্দ্রনাথকে পাই তাই গান ও কবিতার মাধ্যমে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব বির্মূত ভাবনায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমন কবির একটি গানের কয়েকটি লাইন এইরূপ_'তব নাম লয়ে চন্দ্রতারা, অসীম শূন্যে ধাইছে, রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম গ্রহ হতে গ্রহে চাইছে।' আধুনিক বিজ্ঞানের বিগ ব্যাং তত্ত্ব 'চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে'_এই ধারণাকে সমর্থন করে। মনে রাখতে হবে, বিগ ব্যাং তত্ত্বের আবিষ্কার হয় রবীন্দ্রনাথের এই রচনার অনেক পরে, 'তব নাম লয়ে'_এর সঙ্গে যুক্ত হলো 'সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের' ধারণা। ভারতবর্ষের অধ্যাত্ম ভাবনার সঙ্গে এক অনুপম মেলবন্ধন ঘটল আধুনিক বিজ্ঞানের। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
প্রযুক্তি : আমাদের ইন্দ্রিয় প্রাচ্য বাস্তবতার বাইরে যে জগৎ রয়েছে, যে জগতের সন্ধান লিউয়েনহুক পান তাঁর অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা, গ্যালিলিও পান টেলিস্কোপ দ্বারা, সেই জগতের বিনির্মাণ করে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এক নতুন মূর্ত বাস্তবতার সন্ধান দিয়েছে। বিজ্ঞানের প্রয়োগ প্রযুক্তির মধ্যে নিহিত। ফ্রান্সিস বেকন যখন বলেছেন, 'জ্ঞানই শক্তি', তখন তিনি বিজ্ঞানের প্রয়োগের কথাই বলেছেন। এই 'শক্তি'র ধারণা আমরা রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা' গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রচনা 'The Problem of Evil'-এর মধ্যে পাই। যেখানে কবি বলেছেন, '...through the help of science, as we come to know more of the laws of nature, we gain in power... steam and electricity become our nerve and muscle.' ১৯২৫ সালের এক সময়ে অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'বৈজ্ঞানিক হাতিয়ারের যুগে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বড় ও সংখ্যায় বহুল হয়েছে, অর্থাৎ মানুষ হয়েছে Giant, কিন্তু স্বয়ং মানুষ তাতে বড় হয়নি।' আধুনিক প্রযুক্তিকে কবি স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার ভাবনাও তাঁকে তাড়িত করেছে বারবার।
তিনি বলেছেন, 'বাষ্পের যোগে যেখানে রেলগাড়ি চলে, সেখানে clever-কে দেখি perfect-কে দেখিনে।' এতে মনে হয় প্রযুক্তির ওপর রবীন্দ্রনাথ ততটা আগ্রহী ছিলেন না, যতটা বিজ্ঞানের রসাস্বাদনে লোভী ছিলেন। প্রযুক্তি যেন একজন ব্যক্তির ভূমিকাকে খর্ব না করে সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সচেতন।
পরিবেশ : রবীন্দ্র-ভাবনায় পরিবেশ প্রাচীন ভারতের 'তপোবন'-এর পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহাকবি কালীদাস উজ্জয়িনীতে বসে বৈদিকযুগের তপোবন তথা বিশিষ্ট মুনির আশ্রমের যে বর্ণনা দেন, তাতে দেখা যায় সে সময় তপোবনগুলোর পরিবেশ ছিল মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গাছপালাকে বাদ দিয়ে কোনো জীবনই টিকে থাকতে পারে না। এই ধারণাসজ্জাত বোধ রবীন্দ্র-ভাবনায় পরিলক্ষিত হয়। কলকাতার নগরায়ণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন প্রায় ১০০ বছর আগে। আমরা তাঁর কবিতায় তাই দেখি-'ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট,/নাইকো ভালবাসা, নাইকো খেলা।'
রবীন্দ্রনাথ তপোবনের সাধনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'সেই অরণ্যবাস নিঃসৃত সভ্যতার ধারা সমস্ত ভারতবর্ষকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে এবং আজ পর্যন্ত তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়নি।' শান্তিনিকেতনের আশ্রম ও তার পরিবেশ পর্যালোচনা করলে আমরা রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ-চিন্তার যে স্বরূপ লক্ষ করি, তা হলো এই যে কবি চেয়েছিলেন 'এখনকার কালের বিদ্যা ও তখনকার কালের প্রকৃতি।' তবে এটা সত্য যে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শ এবং আধুনিকতার মধ্যে সাযুজ্য বিধানের সঙ্গে সঙ্গে এক করণের অভিযোজনের চিন্তা-ভাবনাও করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-চিন্তায় ছিল পরিবেশ ও প্রকৃতি। তাই তাঁর কবিতায় লক্ষ করি বৃক্ষকে বন্দনা করার কথা। যেমন-
'অন্ধ ভূমি গর্ভ হতে শুনেছিলাম সূর্যের আহ্বান,/প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ।'/'আহবান' নামের কবিতায় কবি উল্লেখ করেন-/'শিশু কালের থেকে/আকাশ আমার মুখে চেয়ে একলা গেছে ডেকে।' এই কবিতায় লক্ষ করি, পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথ কতটা উন্মুখ ছিলেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশের মধ্যে যে ত্রয়ী সম্পর্ক রয়েছে, রবীন্দ্র-ভাবনায় তা প্রাচীন ভারতের অধ্যাত্ম-ভাবনার সঙ্গে মিশে এক চতুর্মাত্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। আইনস্টাইনের চতুর্মাগ হচ্ছে 'সময়' বা 'কাল'। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চতুর্থতা হচ্ছে ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক জীবনের সমন্বয়ের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ করেছেন। সমন্বয়ের রবীন্দ্র-দর্শন থেকে আমরা পেতে পারি প্রাণ ও অপ্রাণের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান।
লেখক : পরিবেশবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাজ্যের দি ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের ফেলো
No comments