পুতিনবাদের তৃতীয় যুগ by ব্রিজেট কেনডাল

রাশিয়ার নির্বাচনে বুথফেরত জরিপের আভাস অনুযায়ী ফল মিলেছে। ভ্লাদিমির পুতিন ৬০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত করেছেন। তার এই বিজয়ে রাশিয়ার অনেক মানুষই বিস্মিত হননি। যারা তাকে সমর্থন করেছেন তারা এখন বলার সুযোগ পাবেন যে, স্ট্রংম্যান স্টাইল ও অভিজ্ঞতার কারণে অন্য প্রার্থীর চেয়ে


তার স্বতন্ত্র ইমেজ গড়ে ওঠে এবং তারই প্রতিফলন দেখা গেছে এবার নির্বাচনী ফলে। অন্যদিকে তার বিরোধীরা বলতে পারেন যে, ক্রেমলিন যেমনটা চেয়েছে ঠিক সেভাবেই নির্বাচনী ফলাফল যাতে অর্জিত হয় ম্যানিপুলেশনসহ সব ধরনের পন্থাই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তারই প্রকাশ ঘটেছে নির্বাচনী ফলে। এই ফলাফলের মাধ্যমে দেশের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে বলেও বিরোধীরা মনে করতে পারেন।
এদিকে ভোটের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ এসেছে। বিরোধী নেতাকর্মী এবং স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ করেন যে, বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে অনেক ভোটারকে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে একজনে একাধিক ভোট দিতে দেখা যায়। রাশিয়ার কর্মকর্তারা অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, বিরোধী নেতাকর্মীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফলকে খাটো করার চেষ্টা করছেন।
নির্বাচনী ফলাফল পুরোপুরি না আসার আগেই অবশ্য পুতিন সমর্থকরা তাদের প্রার্থীর বিজয় উদযাপন শুরু করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা পুতিনবাদের তৃতীয় যুগ যে শুরু হয়ে গেছে সেটা জানান দিল।
ক্রেমলিনের সামনে বিজয় উৎসবরত পুতিন সমর্থকরা টেলিভিশনের সামনে তাদের 'আদর্শ' প্রার্থীর বিজয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। তাদের অনেকের হাতে ছিল রাশিয়ার পতাকা। সমবেত হর্ষোৎফুল্ল জনতাকে বিজয়ের জন্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট উভয়েই অভিনন্দন জানান। সাধারণত পুতিনকে নিজের আবেগ সংযত রাখতে দেখা যায়। কিন্তু রোববার বিজয় উৎসবে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তার আবেগকে ধরে রাখতে পারেননি। তার চোখে আনন্দাশ্রু দেখা যায়। পুতিন সমবেত জনতার উদ্দেশে নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে বলেন, 'এটা রাশিয়ার জনগণের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এবং কেউ বা কোনো কিছুই আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যেতে পারবে না।' ক্ষমতা জবরদখল করার জন্য তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে রাশিয়ার জনগণ তাদের সে উদ্দেশ্য কখনও সফল হতে দেবে না বলে তিনি ঘোষণা করেন। সমবেত উৎফুল্ল জনতার সামনে তিনি তার বিজয়ের কথা ঘোষণা করে বলেন, 'আমরা জিতেছিলাম, জিতেছি, জিতব।'
নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিরোধ কিন্তু এর ফলে শেষ হয়ে গেল, তা কিন্তু নয়। নির্বাচনী বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগ ছাড়াও বিভিন্ন পরাজিত প্রার্থীর অভিযোগ তো রয়েছেই। নির্বাচন সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টি প্রার্থী জুগানভ বলেন, তারা এই নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না এবং তারা এটাকে অবৈধ, পক্ষপাতদুষ্ট ও অস্বচ্ছ বলে মনে করেন। আগেকার নির্বাচনগুলোতে দেখা যেত, ক্রেমলিনের পছন্দের প্রার্থীর বিপক্ষে জুগানভ ছাড়া আর যারা প্রার্থী হতেন তারা তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতেন। আসলে তারা প্রার্থী ছিলেন না। তবে এবার কিছু প্রার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পুতিনের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ান এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকেন।
এবার পরিস্থিতিটা ভিন্ন। অনেক প্রার্থীই প্রকাশ্যে জনগণের সামনে তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন এবং গণমাধ্যমও এবার নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনামূলক অবস্থান নিয়েছিল। আরও যেটা নজর কেড়েছে সেটা হলো, এবার সরকারি টিভি চ্যানেলের নির্বাচনী প্রোগ্রামে পুতিনবিরোধী অনেক চাঁচাছোলা বক্তব্যও সম্প্রচারিত হয়েছে।
কোটিপতি ব্যবসায়ী মিখাইল প্রোখোরভ ভোটে অনিয়মের অভিযোগ সরকারিভাবে তদন্ত করার আহ্বান জানান। এসব অভিযোগ একত্র করে একটি ডসিয়ার বানিয়ে প্রয়োজনবোধে আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলেও ঘোষণা করেন। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে মারাত্মক অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা জুগানভের বক্তব্য আরও আকর্ষণীয়। সাধারণত উত্তেজিত হন না এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জুগানভ তার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি। তিনি পুতিনকেই রাশিয়ার প্রতি প্রকৃত হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন। মাফিয়া ধরনের একটি চক্রের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ, আদালত এবং এসব নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত চেয়ারম্যান_ এসব এই চক্রের পকেটে রয়েছে। বিজয়ীকে অভিনন্দন জানাবেন কি-না মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি না-সূচক জবাব দেন এবং নির্বাচনকে অবৈধ ও প্রতারণামূলক বলে উল্লেখ করেন।
একটি অপ্রত্যাশিত দিক থেকে পুতিনের ওপর বিস্ময়কর আক্রমণ এসেছে। এতে অতীতের চাইতেও ক্রেমলিনবিরোধী শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে এবার এক ধরনের ঐক্য নজরে আসছে। আজই বিরোধীরা নির্বাচনী ফলাফলের বিরুদ্ধে মস্কোতে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। তার অর্থ নির্বাচন নিয়ে বিরোধ শেষ হয়ে যায়নি। পুতিনকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে, গোটা দেশ সত্যিই তার পেছনে আছে।

ব্রিজেট কেনডাল :বিবিসি সাংবাদিক
ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.