সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশে ব্যবসায়ী শ্রেণীর শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা by বদরুদ্দীন উমর
ব্যবসা ও ব্যাংকিং যেহেতু অর্থনীতির শীর্ষদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, সে কারণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও এখন তার সঙ্গে সম্পর্কিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে। জীবিকার সঙ্গে শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক। জ্ঞানচর্চা ও মানসিক বিকাশ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলেও তা কখনও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কহীন হতে পারে না।
ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে এখন বিজ্ঞান অথবা মানববিদ্যা শিক্ষা ও চর্চার থেকে ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষার কদর বেশি। যারা বিজ্ঞান বা মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখায় পড়াশোনা করেন তারাও উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, নয়তো সরকারি পরীক্ষা দিয়ে চাকরির ক্যাডারভুক্ত হয়ে ব্যাংক ইত্যাদিতে যোগদান করেন
কয়েকদিন আগে ঢাকার সংবাদপত্রে বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যাপারে ছাত্রদের অনীহার ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি মোটেই নতুন নয়, কিন্তু কোনো কোনো পুরনো কথা নতুন করে শোনার পর তার দিকে আবার ফিরে তাকানো দরকার হয়। এটি তেমনই এক বিষয়। গুরুত্বের দিক দিয়ে তো অবশ্যই।
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করে, এমনকি এমএসসি পাস করলেও বাংলাদেশে চাকরির বা অন্য কাজের কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকা এবং আগে যেটুকু সুযোগ ছিল সেটাও ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকার ফলে এখন খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রই বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়ায় উৎসাহী। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে ছাত্ররা কোনো স্তরেই উপযুক্তভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করে না। এ কারণে তাদের বিজ্ঞান শিক্ষা ভালোমতো হয় না, তাদের মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে ওঠে না। এই পরিস্থিতিতে ছাত্ররা অধিকতরভাবে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা লাভের পরিবর্তে হিসাব (Accountancy), ব্যবসা ব্যবস্থাপনা (Business Administration), আর্থিক বিষয়(Finance), ব্যাংকিং ইত্যাদি শিক্ষার প্রতিই আগ্রহশীল। এদিকেই তারা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছে এবং এসব বিভাগে ছাত্রসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অর্থ হলো, দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এমনভাবে অবহেলিত হচ্ছে, যা একটি দেশের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপজ্জনক। এ প্রসঙ্গে আরও যা বলা দরকার তা হলো, শুধু বিজ্ঞান চর্চাই নয়, ভাষা, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সাধারণভাবে মানববিদ্যা (Humanities)চর্চার অবস্থাও দাঁড়িয়েছে একই প্রকার। বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে এসব বিষয় চর্চা অবহেলিত ও পরিত্যক্ত হতে থাকায় বিপদ যে কতদূর বৃদ্ধি পেয়েছে এটা যে কোনো সুস্থ বৃদ্ধির লোককে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না।
এই সংকটজনক পরিস্থিতির ওপর আমি আগে অনেক লিখলেও এখন প্রয়োজনবোধে আবার সংক্ষেপে কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করছি। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা দরকার যে, কোনো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই সে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও সাধারণভাবে সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। উপরন্তু তা বিদ্যমান সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। কাজেই বাংলাদেশে এখন বিজ্ঞান থেকে নিয়ে মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখার ছাত্রসংখ্যা কেন কমে আসছে সেটা বোঝার জন্য দেশের অর্থনীতি ও সমাজ ভূমির দিকে তাকানো দরকার।
১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্ক যেভাবে গড়ে উঠেছে ও বিকশিত হয়েছে, তাতে যে শুধু সাধারণ মানুষ বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তাই নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে সংগঠিত হয়েছে যা ভয়াবহভাবে অস্বাস্থ্যকর। এ কারণে বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও প্রকৃত অর্থে শিল্পের বিকাশ বলতে যা বোঝায় সেটা এখানে ঘটেনি। উপরন্তু পাট, সুতা, বস্ত্র, ইস্পাত ইত্যাদি শিল্প সংকুচিত বা ধ্বংস হয়েছে। দেশের প্রধান শিল্প বলতে এখন বোঝায় গার্মেন্ট শিল্প, যাকে আধুনিক বৃহদাকার দর্জি কারখানা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। এই 'শিল্পে' এখন কুড়ি লাখের মতো শ্রমিক ৫ হাজার কারখানায় কর্মরত আছেন, যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই নারী। নারীর কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে এটা খুব উল্লেখযোগ্য হলেও এ ধরনের শিল্প কোনো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড তৈরি করে না। সস্তা শ্রমশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই শিল্পের বাড়বাড়ন্ত হয়। এ কারণে সস্তা শ্রমশক্তির অন্যতম প্রধান অঞ্চল হিসেবে এখানে এই শিল্পের এখন রমরমা অবস্থা। গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের পাশাপাশি এই শিল্প থাকলে দেশের কোনো ক্ষতি হয় না, যেমনটি দেখা গিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু গার্মেন্ট শিল্প এক সময় সেখানে তৈরি বস্ত্রের সব থেকে বড় উৎপাদনকারী হলেও মজুরি বৃদ্ধির কারণে গার্মেন্ট শিল্পের আগের অবস্থা আর দক্ষিণ কোরিয়ায় নেই। বিনিয়োগকারীরা গার্মেন্ট থেকে পুঁজি গুটিয়ে নিয়ে অন্য শিল্পে সরিয়ে নিয়েছেন। দ্রুত শিল্পায়িত হতে থাকা চীনে সস্তা মজুরির জন্য এখনও গার্মেন্ট শিল্প সেখানে আছে। ভিয়েতনামও এখন গার্মেন্ট শিল্পের একটা বড় অঞ্চল। কিন্তু ইউরোপে, আমেরিকায়, জাপানে কোনো গার্মেন্ট কারখানা নেই। কারণ, সেখানে উচ্চ মজুরির জন্য উৎপাদিত তৈরি বস্ত্রের দাম পড়বে এত বেশি যে, সস্তা শ্রমের দেশের গার্মেন্ট শিল্পের তুলনায় তা বহুগুণে বেশি। কাজেই তাদের পক্ষে এ শিল্প অর্থনৈতিক কারণেই সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত অন্য দেশে সস্তা শ্রমে তা তৈরি হতে থাকে এবং তারা তা আমদানি করতে পারে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে না গিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশে এই শিল্পে বিনিয়োগের কারণ শুধু সস্তা শ্রমশক্তিই নয়, এই সস্তা শ্রমশক্তি বেশ নির্বিঘ্নে ও সরকারি সহায়তায় শোষণ করার ব্যবস্থা। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপত্তা বলে বিশেষ কিছু নেই। এটাই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লেগে নিয়মিতভাবে শ্রমিকরা মারা যান এবং তার জন্য প্রকৃতপক্ষে তাদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না। এর কোনো প্রতিকারও হয় না। এর ফলে শ্রমিকরা যতই শোষিত ও বঞ্চিত হোক, মালিকরা অগাধ মুনাফা নিজেদের পকেটে ফেলতে পারে। আগে পাট ছিল এ অঞ্চলের সব থেকে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী। এখন গার্মেন্ট সে স্থান অধিকার করায় এই সস্তা শিল্প এখন এ দেশের শাসক-শোষণ শ্রেণীর সব থেকে আদরের শিল্প। সব থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বলে এই শিল্পকে গৌরবান্বিত করে শাসক মহল থেকে যা বলা হয় তা একটি দেশের হতভাগ্য অবস্থাই নির্দেশ করে। বলা চলে যে, ওষুধ শিল্পই এ দেশে প্রকৃত অর্থে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এটা বাদ দিয়ে এ দেশে কোনো উল্লেখযোগ্য রসায়ন ও ভারী শিল্প নেই। শিল্প বলতে যা আছে তার প্রায় পুরো অংশই হলো ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত। এই অবস্থায় কোনো দেশের শিল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না। কারণ এ ধরনের শিল্প সম্পর্কিতভাবে অন্য শিল্প গড়ে তোলে না। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাবে শ্রমিক রফতানিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের একটা বড় উপায়। যে দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে কর্মক্ষম মানুষ কর্মের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার জন্য অস্থির থাকে, সে দেশের অর্থনীতি কী বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে আছে এটা বোঝার অসুবিধা নেই। শুধু অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত শ্রমিকরাই নয়, ডাক্তার, প্রকৌশলী থেকে নিয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষকরাও বিদেশে চাকরির চেষ্টা করেন এবং চাকরি পেলে চলে যান। অনেকে বেআইনিভাবে বিদেশে চলে গিয়ে কোনোমতে কিছু কর্মসংস্থান করে। এই যেখানে প্রকৃত অবস্থা সেখানে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাই যে এর দ্বারা শুধু প্রভাবিত নয়, নিয়ন্ত্রিত হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে শিল্প পুঁজি মালিক নয়, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের শাসনই কায়েম রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে অর্থনীতি ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া জারি থেকেছে তার ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এই অবস্থা আজ দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা ও ব্যাংকিং যেহেতু অর্থনীতির শীর্ষদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, সে কারণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও এখন তার সঙ্গে সম্পর্কিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে। জীবিকার সঙ্গে শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক। জ্ঞানচর্চা ও মানসিক বিকাশ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলেও তা কখনও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কহীন হতে পারে না। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে এখন বিজ্ঞান অথবা মানববিদ্যা শিক্ষা ও চর্চার থেকে ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষার কদর বেশি। যারা বিজ্ঞান বা মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখায় পড়াশোনা করেন তারাও উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, নয়তো সরকারি পরীক্ষা দিয়ে চাকরির ক্যাডারভুক্ত হয়ে ব্যাংক ইত্যাদিতে যোগদান করেন।
শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের চিত্তের বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতা ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা হচ্ছে না এটা শিক্ষা ব্যবস্থার একটা লক্ষণীয় দিক। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব, পাঠ্যক্রমের নিম্নতা ও দারিদ্র্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে পাঠ্যক্রম বা সিলেবাসের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে, এ অনুযায়ী শিক্ষা লাভ করে একজন ছাত্র খুব ভালো ফল করলেও তার কোনো প্রকৃত শিক্ষা এর দ্বারা হয় না। এ কারণে শুধু নিম্নমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয়, ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেসব বিখ্যাত ও সর্বোচ্চ ভালো ফল করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্ররাও শিক্ষা শেষে বিশেষ কিছুই শেখে না। পাঠ্যক্রমের নিম্নমানের কারণে চিত্তের উপযুক্ত বিকাশ হয় না এবং শিক্ষার উচ্চমান অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এর মধ্যে যে অল্পসংখ্যক ছাত্র ব্যতিক্রম হয় তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশকে কাজের ও বসবাসের উপযুক্ত বিবেচনা না করে বিদেশে পাড়ি জমায়। নিজেদের দেশের পরিবর্তে অন্য দেশের অর্থনীতির বিকাশের জন্য তারা কাজ করে এবং তাদের জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চা বিদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ করে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে যে ভালো শিক্ষকের অভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
এসব থেকেই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা আছে এবং যার অবনতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা দেশের লুণ্ঠনজীবী ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছে। এই শ্রেণীস্বার্থে যতদিন দেশের অর্থনীতি থেকে শিক্ষানীতি পর্যন্ত সবকিছু পরিচালিত হবে, ততদিন এই শিক্ষা ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। এর পরিবর্তন এই শাসকশ্রেণীর পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়।
৫.৩.২০১২
কয়েকদিন আগে ঢাকার সংবাদপত্রে বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যাপারে ছাত্রদের অনীহার ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি মোটেই নতুন নয়, কিন্তু কোনো কোনো পুরনো কথা নতুন করে শোনার পর তার দিকে আবার ফিরে তাকানো দরকার হয়। এটি তেমনই এক বিষয়। গুরুত্বের দিক দিয়ে তো অবশ্যই।
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করে, এমনকি এমএসসি পাস করলেও বাংলাদেশে চাকরির বা অন্য কাজের কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকা এবং আগে যেটুকু সুযোগ ছিল সেটাও ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকার ফলে এখন খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রই বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়ায় উৎসাহী। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে ছাত্ররা কোনো স্তরেই উপযুক্তভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করে না। এ কারণে তাদের বিজ্ঞান শিক্ষা ভালোমতো হয় না, তাদের মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে ওঠে না। এই পরিস্থিতিতে ছাত্ররা অধিকতরভাবে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা লাভের পরিবর্তে হিসাব (Accountancy), ব্যবসা ব্যবস্থাপনা (Business Administration), আর্থিক বিষয়(Finance), ব্যাংকিং ইত্যাদি শিক্ষার প্রতিই আগ্রহশীল। এদিকেই তারা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছে এবং এসব বিভাগে ছাত্রসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অর্থ হলো, দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এমনভাবে অবহেলিত হচ্ছে, যা একটি দেশের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপজ্জনক। এ প্রসঙ্গে আরও যা বলা দরকার তা হলো, শুধু বিজ্ঞান চর্চাই নয়, ভাষা, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সাধারণভাবে মানববিদ্যা (Humanities)চর্চার অবস্থাও দাঁড়িয়েছে একই প্রকার। বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে এসব বিষয় চর্চা অবহেলিত ও পরিত্যক্ত হতে থাকায় বিপদ যে কতদূর বৃদ্ধি পেয়েছে এটা যে কোনো সুস্থ বৃদ্ধির লোককে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না।
এই সংকটজনক পরিস্থিতির ওপর আমি আগে অনেক লিখলেও এখন প্রয়োজনবোধে আবার সংক্ষেপে কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করছি। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা দরকার যে, কোনো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই সে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও সাধারণভাবে সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। উপরন্তু তা বিদ্যমান সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। কাজেই বাংলাদেশে এখন বিজ্ঞান থেকে নিয়ে মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখার ছাত্রসংখ্যা কেন কমে আসছে সেটা বোঝার জন্য দেশের অর্থনীতি ও সমাজ ভূমির দিকে তাকানো দরকার।
১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্ক যেভাবে গড়ে উঠেছে ও বিকশিত হয়েছে, তাতে যে শুধু সাধারণ মানুষ বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তাই নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে সংগঠিত হয়েছে যা ভয়াবহভাবে অস্বাস্থ্যকর। এ কারণে বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও প্রকৃত অর্থে শিল্পের বিকাশ বলতে যা বোঝায় সেটা এখানে ঘটেনি। উপরন্তু পাট, সুতা, বস্ত্র, ইস্পাত ইত্যাদি শিল্প সংকুচিত বা ধ্বংস হয়েছে। দেশের প্রধান শিল্প বলতে এখন বোঝায় গার্মেন্ট শিল্প, যাকে আধুনিক বৃহদাকার দর্জি কারখানা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। এই 'শিল্পে' এখন কুড়ি লাখের মতো শ্রমিক ৫ হাজার কারখানায় কর্মরত আছেন, যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই নারী। নারীর কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে এটা খুব উল্লেখযোগ্য হলেও এ ধরনের শিল্প কোনো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড তৈরি করে না। সস্তা শ্রমশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই শিল্পের বাড়বাড়ন্ত হয়। এ কারণে সস্তা শ্রমশক্তির অন্যতম প্রধান অঞ্চল হিসেবে এখানে এই শিল্পের এখন রমরমা অবস্থা। গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের পাশাপাশি এই শিল্প থাকলে দেশের কোনো ক্ষতি হয় না, যেমনটি দেখা গিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু গার্মেন্ট শিল্প এক সময় সেখানে তৈরি বস্ত্রের সব থেকে বড় উৎপাদনকারী হলেও মজুরি বৃদ্ধির কারণে গার্মেন্ট শিল্পের আগের অবস্থা আর দক্ষিণ কোরিয়ায় নেই। বিনিয়োগকারীরা গার্মেন্ট থেকে পুঁজি গুটিয়ে নিয়ে অন্য শিল্পে সরিয়ে নিয়েছেন। দ্রুত শিল্পায়িত হতে থাকা চীনে সস্তা মজুরির জন্য এখনও গার্মেন্ট শিল্প সেখানে আছে। ভিয়েতনামও এখন গার্মেন্ট শিল্পের একটা বড় অঞ্চল। কিন্তু ইউরোপে, আমেরিকায়, জাপানে কোনো গার্মেন্ট কারখানা নেই। কারণ, সেখানে উচ্চ মজুরির জন্য উৎপাদিত তৈরি বস্ত্রের দাম পড়বে এত বেশি যে, সস্তা শ্রমের দেশের গার্মেন্ট শিল্পের তুলনায় তা বহুগুণে বেশি। কাজেই তাদের পক্ষে এ শিল্প অর্থনৈতিক কারণেই সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত অন্য দেশে সস্তা শ্রমে তা তৈরি হতে থাকে এবং তারা তা আমদানি করতে পারে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে না গিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশে এই শিল্পে বিনিয়োগের কারণ শুধু সস্তা শ্রমশক্তিই নয়, এই সস্তা শ্রমশক্তি বেশ নির্বিঘ্নে ও সরকারি সহায়তায় শোষণ করার ব্যবস্থা। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপত্তা বলে বিশেষ কিছু নেই। এটাই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লেগে নিয়মিতভাবে শ্রমিকরা মারা যান এবং তার জন্য প্রকৃতপক্ষে তাদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না। এর কোনো প্রতিকারও হয় না। এর ফলে শ্রমিকরা যতই শোষিত ও বঞ্চিত হোক, মালিকরা অগাধ মুনাফা নিজেদের পকেটে ফেলতে পারে। আগে পাট ছিল এ অঞ্চলের সব থেকে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী। এখন গার্মেন্ট সে স্থান অধিকার করায় এই সস্তা শিল্প এখন এ দেশের শাসক-শোষণ শ্রেণীর সব থেকে আদরের শিল্প। সব থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বলে এই শিল্পকে গৌরবান্বিত করে শাসক মহল থেকে যা বলা হয় তা একটি দেশের হতভাগ্য অবস্থাই নির্দেশ করে। বলা চলে যে, ওষুধ শিল্পই এ দেশে প্রকৃত অর্থে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এটা বাদ দিয়ে এ দেশে কোনো উল্লেখযোগ্য রসায়ন ও ভারী শিল্প নেই। শিল্প বলতে যা আছে তার প্রায় পুরো অংশই হলো ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত। এই অবস্থায় কোনো দেশের শিল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না। কারণ এ ধরনের শিল্প সম্পর্কিতভাবে অন্য শিল্প গড়ে তোলে না। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাবে শ্রমিক রফতানিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের একটা বড় উপায়। যে দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে কর্মক্ষম মানুষ কর্মের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার জন্য অস্থির থাকে, সে দেশের অর্থনীতি কী বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে আছে এটা বোঝার অসুবিধা নেই। শুধু অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত শ্রমিকরাই নয়, ডাক্তার, প্রকৌশলী থেকে নিয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষকরাও বিদেশে চাকরির চেষ্টা করেন এবং চাকরি পেলে চলে যান। অনেকে বেআইনিভাবে বিদেশে চলে গিয়ে কোনোমতে কিছু কর্মসংস্থান করে। এই যেখানে প্রকৃত অবস্থা সেখানে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাই যে এর দ্বারা শুধু প্রভাবিত নয়, নিয়ন্ত্রিত হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে শিল্প পুঁজি মালিক নয়, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের শাসনই কায়েম রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে অর্থনীতি ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া জারি থেকেছে তার ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এই অবস্থা আজ দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা ও ব্যাংকিং যেহেতু অর্থনীতির শীর্ষদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, সে কারণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও এখন তার সঙ্গে সম্পর্কিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে। জীবিকার সঙ্গে শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক। জ্ঞানচর্চা ও মানসিক বিকাশ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলেও তা কখনও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কহীন হতে পারে না। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে এখন বিজ্ঞান অথবা মানববিদ্যা শিক্ষা ও চর্চার থেকে ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষার কদর বেশি। যারা বিজ্ঞান বা মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখায় পড়াশোনা করেন তারাও উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, নয়তো সরকারি পরীক্ষা দিয়ে চাকরির ক্যাডারভুক্ত হয়ে ব্যাংক ইত্যাদিতে যোগদান করেন।
শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের চিত্তের বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতা ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা হচ্ছে না এটা শিক্ষা ব্যবস্থার একটা লক্ষণীয় দিক। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব, পাঠ্যক্রমের নিম্নতা ও দারিদ্র্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে পাঠ্যক্রম বা সিলেবাসের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে, এ অনুযায়ী শিক্ষা লাভ করে একজন ছাত্র খুব ভালো ফল করলেও তার কোনো প্রকৃত শিক্ষা এর দ্বারা হয় না। এ কারণে শুধু নিম্নমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয়, ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেসব বিখ্যাত ও সর্বোচ্চ ভালো ফল করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্ররাও শিক্ষা শেষে বিশেষ কিছুই শেখে না। পাঠ্যক্রমের নিম্নমানের কারণে চিত্তের উপযুক্ত বিকাশ হয় না এবং শিক্ষার উচ্চমান অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এর মধ্যে যে অল্পসংখ্যক ছাত্র ব্যতিক্রম হয় তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশকে কাজের ও বসবাসের উপযুক্ত বিবেচনা না করে বিদেশে পাড়ি জমায়। নিজেদের দেশের পরিবর্তে অন্য দেশের অর্থনীতির বিকাশের জন্য তারা কাজ করে এবং তাদের জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চা বিদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ করে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে যে ভালো শিক্ষকের অভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
এসব থেকেই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা আছে এবং যার অবনতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা দেশের লুণ্ঠনজীবী ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছে। এই শ্রেণীস্বার্থে যতদিন দেশের অর্থনীতি থেকে শিক্ষানীতি পর্যন্ত সবকিছু পরিচালিত হবে, ততদিন এই শিক্ষা ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। এর পরিবর্তন এই শাসকশ্রেণীর পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়।
৫.৩.২০১২
No comments