জীবন যেমন-মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন আমার পিতাকে। তার সে ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করেছি কয়েকবার, আত্মজীবনী 'জীবন নদীর উজানে'তে বিধৃত। তাকে উৎসর্গীকৃত সঙ্গীতের ভালোবাসার সাম্পান : 'স্বাধীনতা দিনের গান', দ্বিতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এবার। মস্কোতে দু'ঘণ্টা গান শুনিয়েছি রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমানের বাসায়,
একেকটি গান গাইছি, আর তার চোখের অশ্রু বাঁধ মানছে না।
রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন আমাদের ভালোবাসার
প্রথম পুরুষ
গত শনিবার ছিল মনে রাখার মতো দিন। ওই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়েছি। সবার ভাগ্যে এমনটি হয় না। কার্ড পেলাম, সঙ্গে টেলিফোন_ যেন আমি অতি অবশ্য আসি। না গেলে অনেকখানি মিস করতাম। বঙ্গবন্ধু, যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, তার কন্যাকে মুহূর্তে খুঁজে পেলাম, সেই সহজ সুন্দর ব্যবহার, যেটি ছিল তার পিতার একান্তই আপন সম্পদ। ওই দিন সহসাই শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক গায়ক লেখক সবাই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে তার নিজরূপে দেখতে পেয়ে সাংঘাতিক খুশি।
আমাকে দেখে আসাদুজ্জামান নূর বললেন, আব্বাসী ভাই, আজ একটা গান গাইতে হবে। বললাম, সুযোগ এলে নিশ্চয়ই হবে। এর মধ্যে আসর মাত করলেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া, বাঁশিয়াল বারি, শাকিল, মিতা খান। কয়েকজন সুন্দর গলায় আবৃত্তি করলেন। ইতিমধ্যে আড্ডায় এসে পেঁৗছলেন শেখ হাসিনা। সবার সঙ্গে কথা বলছেন যেন আত্মীয়ের মতো। ভাবলাম আমাদের জন্য বোধ হয় আর সময় হবে না। তা তো নয়, কয়েকজনের জন্য নির্ধারিত বসার জায়গা। ফেরদৌসীকে বললেন, যখনই আপনার অনুষ্ঠান, প্রাণ ভরে দেখি। বহুদিনের ইচ্ছা দু'ভাইবোনকে খানিকক্ষণের জন্য কাছে পাব। আজ আল্লাহতায়ালা সে ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আমাকে বললেন, কই আব্বাসী ভাই, আপনার কাছে গান শেখা আমার আর হলো না। প্রতিদিন বক্তৃতা দিয়ে গানের কণ্ঠটি দিয়েছি বিসর্জন, আর কি হবে? এই বলে আবার হারিয়ে গেলেন ভিড়ে। আমার আর উত্তর দেওয়া হলো না। খানিক পরেই হবে ভঙ্গ মিলনমেলার।
দেখি ডাক পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী একদিকে, আরেকদিকে মীর্ণা ও আমি। যথারীতি মীর্ণার সঙ্গেই তার আলাপ জমে উঠেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আবার বললেন, আমার কি হবে? বললাম, হবে যদি এখুনি একটি গানে কণ্ঠ মেলান। ডেকে নিলাম ফেরদৌসী, সামিরার সহপাঠিনী ডাক্তার দীপু মনি, মতিয়া চৌধুরী, ফকির আলমগীর, মিতা খান ও আবদুল জব্বারকে। শেখ হাসিনা সহাস্যে যোগদান করলেন যখন ধরি দ্বিজেন্দ্রলালের ফেলে আসা গান সঞ্চারী থেকে : 'ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ, ও মা তোমার চরণ দু'টি বক্ষে আমার ধরি'/'আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি'।
শুধু কণ্ঠ ছুঁয়ে নয় এ গান, প্রবাহিত হৃদয় কন্দর থেকে। সবাই এ দেশের, এক মায়ের সন্তান আমরা। স্নেহের রঙ এক, কেন আলাদা থাকব আমরা? বঙ্গবন্ধুকন্যার উচ্চারণে তার সততসঞ্চরণশীল মমতা। চিঠি লিখেছিলাম তিন বছর আগে, হয়তো সে চিঠি তার কাছে পেঁৗছেনি। লিখেছিলাম : আপনি আবির্ভূত হন মাতৃরূপে, মাতৃরূপ ভুল হতে পারে না। একই আবহে গেয়েছি এই গান, দূর থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল-পুত্র দিলীপ কুমার রায় হাসছিলেন মিটিমিটি আমার দিকে চেয়ে, কারণ গাইছিলাম দিলীপেরই সুরে। অনেকেরই জানা নেই, এটি ঈষৎ হেলান সুরে, আরও মধুময়।
গণভবনের লনে এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা অভাবিত। পিঠা-পুলি, সমুসা-শিঙ্গাড়া, কাবাব-পরাটা, চিকেন রোস্ট-লুচি, কয়েক রকম ফল, পেঁপে-সফেদা-আনারস-কলা, সবই ছিল। তবু সেটি সব নয়। আসল কথা হলো, মাঝে মধ্যে মিলিত হওয়া, সবার কাছে নিজকে পেঁৗছে দেওয়া। ড. আজাদ চৌধুরীকে কফি বানিয়ে খাওয়ালাম। পাশে বসে থাকা ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা মনোয়ার, ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামানকে পেয়ে খুশি। সুযোগ পেয়ে পদধূলি নিলাম, কারণ আল্লাহ বলেছেন, একদিনের বড় যদি কাউকে সম্মান করো, আমাকেই সম্মান জানালে। শ' পাঁচেক আমন্ত্রিত অতিথি। চিন্তা করুন, প্রটোকল, সিকিউরিটির সিঁড়ি ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদারক করছেন, কে কোনটা পছন্দ করবেন। মেহমানদারি কীভাবে করতে হয়, তার কাছেই
শিখতে হয়।
বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন আমার পিতাকে। তার সে ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করেছি কয়েকবার, আত্মজীবনী 'জীবন নদীর উজানে'তে বিধৃত। তাকে উৎসর্গীকৃত সঙ্গীতের ভালোবাসার সাম্পান : 'স্বাধীনতা দিনের গান', দ্বিতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এবার। মস্কোতে দু'ঘণ্টা গান শুনিয়েছি রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমানের বাসায়, একেকটি গান গাইছি, আর তার চোখের অশ্রু বাঁধ মানছে না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন আমাদের ভালোবাসার
প্রথম পুরুষ।
বিগত শনিবার সেই স্মৃতিগুলো মনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বললাম, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় স্থান আর হয় না, সে কথা সবাই জানে। কিন্তু আমরা যারা গান গাই, কিছু লিখি, ছবি আঁকি, নৃত্য করি, কিছু বাজাই, আবৃত্তি করি, তাদের কাছে এর চেয়েও বড় সম্মানের চোখে তাকাই আমরা আপনার দিকে। তা হলো : বঙ্গবন্ধুকন্যা। জায়গাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। সন্ধ্যাবেলা আজান হলো। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আমি এত আড্ডার মধ্যেও তার কাছে নত হয়েছি।
৫ মার্চ, ২০১২
মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.com
রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন আমাদের ভালোবাসার
প্রথম পুরুষ
গত শনিবার ছিল মনে রাখার মতো দিন। ওই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়েছি। সবার ভাগ্যে এমনটি হয় না। কার্ড পেলাম, সঙ্গে টেলিফোন_ যেন আমি অতি অবশ্য আসি। না গেলে অনেকখানি মিস করতাম। বঙ্গবন্ধু, যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, তার কন্যাকে মুহূর্তে খুঁজে পেলাম, সেই সহজ সুন্দর ব্যবহার, যেটি ছিল তার পিতার একান্তই আপন সম্পদ। ওই দিন সহসাই শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক গায়ক লেখক সবাই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে তার নিজরূপে দেখতে পেয়ে সাংঘাতিক খুশি।
আমাকে দেখে আসাদুজ্জামান নূর বললেন, আব্বাসী ভাই, আজ একটা গান গাইতে হবে। বললাম, সুযোগ এলে নিশ্চয়ই হবে। এর মধ্যে আসর মাত করলেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া, বাঁশিয়াল বারি, শাকিল, মিতা খান। কয়েকজন সুন্দর গলায় আবৃত্তি করলেন। ইতিমধ্যে আড্ডায় এসে পেঁৗছলেন শেখ হাসিনা। সবার সঙ্গে কথা বলছেন যেন আত্মীয়ের মতো। ভাবলাম আমাদের জন্য বোধ হয় আর সময় হবে না। তা তো নয়, কয়েকজনের জন্য নির্ধারিত বসার জায়গা। ফেরদৌসীকে বললেন, যখনই আপনার অনুষ্ঠান, প্রাণ ভরে দেখি। বহুদিনের ইচ্ছা দু'ভাইবোনকে খানিকক্ষণের জন্য কাছে পাব। আজ আল্লাহতায়ালা সে ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আমাকে বললেন, কই আব্বাসী ভাই, আপনার কাছে গান শেখা আমার আর হলো না। প্রতিদিন বক্তৃতা দিয়ে গানের কণ্ঠটি দিয়েছি বিসর্জন, আর কি হবে? এই বলে আবার হারিয়ে গেলেন ভিড়ে। আমার আর উত্তর দেওয়া হলো না। খানিক পরেই হবে ভঙ্গ মিলনমেলার।
দেখি ডাক পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী একদিকে, আরেকদিকে মীর্ণা ও আমি। যথারীতি মীর্ণার সঙ্গেই তার আলাপ জমে উঠেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আবার বললেন, আমার কি হবে? বললাম, হবে যদি এখুনি একটি গানে কণ্ঠ মেলান। ডেকে নিলাম ফেরদৌসী, সামিরার সহপাঠিনী ডাক্তার দীপু মনি, মতিয়া চৌধুরী, ফকির আলমগীর, মিতা খান ও আবদুল জব্বারকে। শেখ হাসিনা সহাস্যে যোগদান করলেন যখন ধরি দ্বিজেন্দ্রলালের ফেলে আসা গান সঞ্চারী থেকে : 'ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ, ও মা তোমার চরণ দু'টি বক্ষে আমার ধরি'/'আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি'।
শুধু কণ্ঠ ছুঁয়ে নয় এ গান, প্রবাহিত হৃদয় কন্দর থেকে। সবাই এ দেশের, এক মায়ের সন্তান আমরা। স্নেহের রঙ এক, কেন আলাদা থাকব আমরা? বঙ্গবন্ধুকন্যার উচ্চারণে তার সততসঞ্চরণশীল মমতা। চিঠি লিখেছিলাম তিন বছর আগে, হয়তো সে চিঠি তার কাছে পেঁৗছেনি। লিখেছিলাম : আপনি আবির্ভূত হন মাতৃরূপে, মাতৃরূপ ভুল হতে পারে না। একই আবহে গেয়েছি এই গান, দূর থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল-পুত্র দিলীপ কুমার রায় হাসছিলেন মিটিমিটি আমার দিকে চেয়ে, কারণ গাইছিলাম দিলীপেরই সুরে। অনেকেরই জানা নেই, এটি ঈষৎ হেলান সুরে, আরও মধুময়।
গণভবনের লনে এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা অভাবিত। পিঠা-পুলি, সমুসা-শিঙ্গাড়া, কাবাব-পরাটা, চিকেন রোস্ট-লুচি, কয়েক রকম ফল, পেঁপে-সফেদা-আনারস-কলা, সবই ছিল। তবু সেটি সব নয়। আসল কথা হলো, মাঝে মধ্যে মিলিত হওয়া, সবার কাছে নিজকে পেঁৗছে দেওয়া। ড. আজাদ চৌধুরীকে কফি বানিয়ে খাওয়ালাম। পাশে বসে থাকা ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা মনোয়ার, ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামানকে পেয়ে খুশি। সুযোগ পেয়ে পদধূলি নিলাম, কারণ আল্লাহ বলেছেন, একদিনের বড় যদি কাউকে সম্মান করো, আমাকেই সম্মান জানালে। শ' পাঁচেক আমন্ত্রিত অতিথি। চিন্তা করুন, প্রটোকল, সিকিউরিটির সিঁড়ি ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদারক করছেন, কে কোনটা পছন্দ করবেন। মেহমানদারি কীভাবে করতে হয়, তার কাছেই
শিখতে হয়।
বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন আমার পিতাকে। তার সে ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করেছি কয়েকবার, আত্মজীবনী 'জীবন নদীর উজানে'তে বিধৃত। তাকে উৎসর্গীকৃত সঙ্গীতের ভালোবাসার সাম্পান : 'স্বাধীনতা দিনের গান', দ্বিতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এবার। মস্কোতে দু'ঘণ্টা গান শুনিয়েছি রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমানের বাসায়, একেকটি গান গাইছি, আর তার চোখের অশ্রু বাঁধ মানছে না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন আমাদের ভালোবাসার
প্রথম পুরুষ।
বিগত শনিবার সেই স্মৃতিগুলো মনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বললাম, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় স্থান আর হয় না, সে কথা সবাই জানে। কিন্তু আমরা যারা গান গাই, কিছু লিখি, ছবি আঁকি, নৃত্য করি, কিছু বাজাই, আবৃত্তি করি, তাদের কাছে এর চেয়েও বড় সম্মানের চোখে তাকাই আমরা আপনার দিকে। তা হলো : বঙ্গবন্ধুকন্যা। জায়গাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। সন্ধ্যাবেলা আজান হলো। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আমি এত আড্ডার মধ্যেও তার কাছে নত হয়েছি।
৫ মার্চ, ২০১২
মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.com
No comments