কালের আয়নায়-দাঙ্গার পেছনের অর্থনৈতিক কারণ দূর না করলে কেবল দমননীতি কাজ দেবে কি? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

তাতে সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতোই সিভিল সোসাইটি এবং সিভিল লিবার্টির ক্ষতি বাড়তে থাকবে। ব্রিটিশ গণতন্ত্র সুনাম হারাবে। ক্যামেরন সরকারের বর্তমান ব্যবস্থায় কঠোরতা থাকতে পারে, বাস্তবতা কতটা আছে, ভবিষ্যতের ইতিহাসই সে কথা বলবে


গত বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত কয়েকদিনের ন্যাশনাল রায়ট (জাতীয় দাঙ্গা) নিয়ে জরুরি বৈঠক হয়েছে। ব্রিটিশ মিডিয়াতেই এবারের দাঙ্গাকে জাতীয় দাঙ্গা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ন্যাশনাল এমারজেন্সি (জাতীয় জরুরি অবস্থা) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এবারের দাঙ্গা কেবল লন্ডন বা অন্য কোনো একটি শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটেনের অধিকাংশ বড় বড় শহরে। অবশ্য ব্রিটেনের এবারের দাঙ্গার কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র ছিল না। সবাই স্বীকার করেছেন, এমনকি পুলিশও, এটা বর্ণদাঙ্গা (ৎধপব ৎরড়ঃ) নয়। তাহলে এটা কি ইউরোপব্যাপী একটার পর একটা অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উদ্ভূত দাঙ্গা? ব্রিটিশ টোরি এস্টাবলিশমেন্ট সে কথা স্বীকার করতে চাইবেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বৃহস্পতিবারের জরুরি সভাতেও সে কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির সাহায্যে এই দাঙ্গা ব্রিটেনের সর্বত্র দ্রুত ছড়াতে পেরেছে। এই 'সোস্যাল মিডিয়ার' সাহায্যে দ্রুত 'সোস্যাল আনরেস্ট' যে সৃষ্টি করা যায় এবং ছড়ানো যায়, ব্রিটেনের দাঙ্গাকারী যুবকরা তার শিক্ষা নিয়েছে কিছুকাল আগে আরব দেশগুলোতে সংঘটিত 'আরব স্প্রিং' থেকে। এই আরব স্প্রিংয়ের একটা লক্ষ্য ছিল_ বহু যুগের স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা। কিন্তু ব্রিটেনের গত কয়েকদিনের দাঙ্গাকারীদের উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি। লুটপাট, অরাজকতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টির মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল।
কোনো কোনো সমাজ-বিশেষজ্ঞ বলেছেন, 'উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোনো কিছুই ঘটে না। মনের অবরুদ্ধ ক্ষোভ, অসন্তোষ প্রকাশের জন্য মানুষ অনেক সময় ধ্বংসাত্মক কাজে নামে। সে নিজেও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক সময় সচেতন থাকে না। দেরিতে হলেও যখন সে সচেতন হয়, তখন সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে, তার উদ্দেশ্য বোঝা যায়। ব্রিটেনের সাম্প্রতিক দাঙ্গা সম্পর্কেও এই সমাজবিদদের কারও কারও ধারণা, এটা ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপে ক্রমাগত অর্থনৈতিক মন্দা ও ধসের ফল। এই দেশগুলোতে ক্যাপিটালিস্ট এস্টাবলিশমেন্ট এই মন্দা রোধের জন্য বিত্তবানদের গায়ে হাত না দিয়ে যত বেশি সাধারণ মানুষের ওপর করের দুর্বহ বোঝা চাপাচ্ছেন, আর্থিক কৃচ্ছ্রতার নামে যত বেশি জনকল্যাণমূলক সার্ভিসগুলোর অর্থ বরাদ্দ ক্রমাগত ছাঁটাই করছেন, তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক রোষ ও ক্ষোভ তত বেশি বেশি জমা হচ্ছে নিম্নবিত্ত সমাজের তরুণ অংশের মধ্যেই। শিক্ষায় কাটছাঁট, কর্মসংস্থানের অভাব এবং এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ সামনে নিয়ে এই তরুণরা যদি উদ্দেশ্য না জেনেই দাঙ্গাকারীতে পরিণত হয় এবং লুটপাট, অরাজকতা সৃষ্টিতে রত হয় তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই বলে এই সমাজতাত্তি্বকদের অনেকেই মনে করেন।
কোনো দেশে যদি এই ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধে, তাহলে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে স্বভাবদুর্বৃত্তরা সক্রিয় হয় এবং দুর্বৃত্ত নয় এমন বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে এসে মেশে এবং লুটপাটে মত্ত হয়, পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এক কথায় পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। লন্ডনে এবং ব্রিটেনের অন্যান্য শহরে গত কয়েকদিনে তাই ঘটতে দেখা গেছে। এবারের দাঙ্গার বৈশিষ্ট্য ছিল পুলিশের ক্যামেরায় ধরা না পড়ার জন্য দাঙ্গাকারী যুবকদের হুডে মুখ ঢেকে রাখা। তাতে স্বভাবদুর্বৃত্তরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে অরাজকতা সৃষ্টির আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে।
বৃহস্পতিবারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের জরুরি বৈঠকে সরকারি ও বিরোধী দলের আলোচনায় এই দাঙ্গার কারণ, উৎপত্তি সব কিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এর কারণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যেসব কথা বলেছেন এবং সরকার যে প্রতিকার ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছেন, তাতে সমস্যার গোড়ায় হাত দেওয়া হয়নি এবং সঠিক প্রতিকার পন্থা গ্রহণ করা হয়নি বলেও অনেকেই মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী এই দাঙ্গার জন্য 'সমাজের কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষকে' (ঝরপশ চবড়ঢ়ষব) দায়ী করেছেন এবং তাদের কঠোর শাস্তি দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ভাবছেন।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট, পশ্চিমা দেশগুলোর তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতারা তাদের 'ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব করার' যে ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করছেন, তাতে সমাজে যে বিক্ষোভ, অসন্তোষ, বিরোধ দেখা দিচ্ছে, সে কারণগুলোকে চিহ্নিত না করে দোষ চাপাচ্ছেন ঢালাওভাবে ক্রিমিনালদের ওপর এবং তাদের ক্রাইম দমনের নামে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার ক্রমাগত কাটছাঁট করে চলেছেন। টোরি সরকার তাদের অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে যথেচ্ছভাবে ওয়েলফেয়ার স্টেট ধ্বংস করার ক্রমাগত ব্যবস্থা গ্রহণ দ্বারা যে অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন, তার দায় ক্রিমিনালদের ও পুলিশের ব্যর্থতার ওপর চাপিয়ে দিয়ে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো (যে অধিকার তারা বহু শতাব্দীর সংগ্রাম দ্বারা অর্জন করেছে) যেভাবে অনবরত হরণ করে চলেছেন, তা থেকে তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
ব্রিটেনে এই পাঁচ-ছয় দিনের অর্থনৈতিক রায়টের পর কিছু দাঙ্গাকারী ও দুর্বৃৃত্ত অবশ্যই সাজা পাবে, কিন্তু সবচেয়ে বড় সাজা পাবে ব্রিটিশ গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে এই দাঙ্গার পেছনের আসল কারণগুলো চাপা রেখে সমাজে ধ পঁষঃঁৎব ড়ভ ভবধৎ (ভীতির রাজত্ব) দূর করার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন, তাতে ব্রিটেনে ভীতির রাজত্ব কতটা দূর হবে জানি না, কিন্তু দেশটির শতাব্দী প্রাচীন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যগুলো বিপন্ন হবে। সমাজে আইনের ভিত্তিকে শক্তিশালী না করে পুলিশের শক্তি বাড়িয়ে অরাজকতা দূর করা যায়, এই তত্ত্ব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও সত্য প্রমাণিত হয়নি।
ব্রিটেনের এবারের দাঙ্গার চরিত্র ছিল সম্পূর্ণভাবে সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বিক্ষোভ, দাঙ্গা, অরাজকতার সমতুল্য। এই দাঙ্গার ব্যাপারে ক্যামেরন সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখাল তাও তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলোর মতোই। অর্থাৎ পুলিশের শক্তি বাড়িয়ে, দমননীতি তীব্র করে, জননিরাপত্তার নামে জনসাধারণের নাগরিক অধিকারগুলো খর্ব করে তারা সমস্যার সমাধান করবেন বলে পার্লামেন্টে দর্প প্রকাশ করেছেন। এদিকে একই সরকার ব্রিটিশ পুলিশের আর্থিক বরাদ্দ ও সংখ্যাশক্তি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে বিরোধী লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের আর্থিক বরাদ্দ ও সংখ্যা হ্রাস না করার আবেদন জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেই আবেদনে কান না দিয়ে সংখ্যাল্প পুলিশের হাতে কেবল দমননীতি প্রয়োগের আরও ব্যাপক ক্ষমতা বাড়িয়ে মুশকিল আসানের কথা ভাবছেন। অথচ বর্তমান দাঙ্গায়ও উদ্ভব, পুলিশের হাতে দেওয়া স্টপ অ্যান্ড সার্চের ক্ষমতার বলে তাদের গুলিতে একজন কালো যুবকের মৃত্যুর ঘটনায়।
পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন দম্ভভরে সিভিল লিবার্টির উপরে সিকিউরিটি ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, ব্রিটেনে এই দাঙ্গা পরিস্থিতি তিনি বরদাশত করবেন না। আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং কমিউনিটিগুলোকে পুনর্গঠনের (জবনঁরষফ ড়ঁৎ পড়সসঁহরঃরবং) জন্য তিনি যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রাথমিকভাবে এই ব্যবস্থাগুলো কী? পুলিশকে আরও ক্ষমতা দেওয়া হবে। তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো লোকের মুখের আবরণ_ হুড মুখোশ, ঢাকনা ইত্যাদি খুলে সার্চ চালাতে পারবে। ক্রাউড কন্ট্রোল ব্যবস্থা হিসেবে কারফিউ জারির ব্যাপক ক্ষমতাদানের কথাও সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। ফেসবুক এবং টুইটার_ এই সামাজিক সার্ভিসগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উচ্ছৃঙ্খল যুবাদের দ্বারা এগুলোর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ (ঈঁঃ ড়ভভ ঃড় ুড়নং) করার কথা বিবেচনাধীন রয়েছে। তিনি ক্রাউড কন্ট্রোলের আরও কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। তার মধ্যে রয়েছে রাজপথে সৈন্য নামানোর চিন্তা।
মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান টিম গডউইন অবশ্য রাজপথে উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে সৈন্য নামানোর ব্যবস্থাটি না করার সুপারিশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার পরামর্শ শুনবেন বলে আভাস দিলেও পার্লামেন্টে প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, 'সেনাবাহিনী রাজপথে পাহারাদারের দায়িত্ব (মঁধৎফ ফঁঃরবং) পালন করবে। তাতে পুলিশ দাঙ্গা দমনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারবে।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যেই স্পষ্ট, ব্রিটেনের মতো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশও এখন সাবেক তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলোর মতো সিভিল আনরেস্ট দমনেও সামরিক শক্তি ব্যবহারের কথা ভাবছে। বাংলাদেশে তো এক সময় ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধারের জন্যও সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্রিটেনের এই দাঙ্গাকে 'ড়িৎংঃ ৎরড়ঃ রহ ষরারহম সবসড়ৎু' (স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ দাঙ্গা) বলা হয়েছে। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সাহায্যদান ও ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু রোগের কারণ নির্ণয় না করে ক্ষতের ওপর মলম লাগিয়ে যেমন রোগ দূর করা যায় না, তেমনি স্মরণকালের এই সবচেয়ে খারাপ দাঙ্গার আসল কারণ নির্ণয় এবং সেই কারণগুলো দূর করার ব্যবস্থা না করে কেবল পুলিশের ক্ষমতা বাড়িয়ে বা দমননীতি আরও কঠোর করে তুলে টোরি সরকার সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তাতে সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতোই সিভিল সোসাইটি এবং সিভিল লিবার্টির ক্ষতি বাড়তে থাকবে। ব্রিটিশ গণতন্ত্র সুনাম হারাবে। ক্যামেরন সরকারের বর্তমান ব্যবস্থায় কঠোরতা থাকতে পারে, বাস্তবতা কতটা আছে, ভবিষ্যতের ইতিহাসই সে কথা বলবে।
লন্ডন, ১২ আগস্ট ২০১১, শুক্রবার
 

No comments

Powered by Blogger.