জনজীবন-কুড়িগ্রামে বন্যা শেষের দুর্ভোগ by মমিনুল ইসলাম মঞ্জু

দিনমজুরিই কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর অভ্যন্তরের দ্বীপচর এবং তীরবর্তী চরের অধিবাসীদের আয়ের প্রধানতম উৎস। তাদের বেশির ভাগই কৃষিনির্ভর কাজে দিনমজুরি করেন। বছরের ৬ মাসের মতো পর্যায়ক্রমে তারা জেলার অভ্যন্তরে এবং জেলার বাইরে গিয়ে দিনমজুরি করে যা আয় করেন_ তা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে-না খেয়ে সারাবছর চলতেন।


ফলে দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিনগুলো পাড়ি দেওয়া ছিল তাদের নিয়তি।
মাত্র কয়েক বছর আগে থেকে এই চিরাচরিত চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি-কলাকৌশল আর নতুন নতুন জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় চরের জমিতে ধান, পাট, চিনা, কাউন, তিল, তিসি, ভুট্টা, মাষকলাই, চিনাবাদাম, শাকসবজি এবং কলার আবাদ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় চরবাসী সচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু এবার উপর্যুপরি তিন দফা বন্যায় দ্বীপচর, নদ-নদী তীরবর্তী চর এবং নিম্নাঞ্চলের রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ তছনছ হয়ে গেছে। বন্যায় কুশি এবং থোড় আসার পর্যায়ে রোপা আমন ক্ষেত, মাষকলাই, চিনাবাদাম, মসলা জাতীয় ফসল এবং কলার বাগান নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দফতরের দেওয়া হিসাব মতে দুই লক্ষাধিক চাষির ২০০ কোটি টাকার মতো বীজতলা, পাট এবং আমনসহ অন্যান্য ফসল তিন দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় এবার ১ লাখ ১৪ হাজার ৩৩২ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ জন্য ৭ হাজার ৮১২ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়। কিন্তু উপর্যুপরি দুই দফা বন্যায় চর এবং নিম্নাঞ্চলের ১ হাজার ১৪৮ হেক্টর বীজতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। তার পরও জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছিল।
এ অবস্থায় তৃতীয় দফা বন্যার পানিতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তলিয়ে থাকায় চর এবং নিম্নাঞ্চলের ১ লাখ ৫৯ হাজার চাষির ২৯ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন, ৩৮২ হেক্টর সবজি, ৩১২ হেক্টর চিনাবাদাম, ৪৬৫ হেক্টর মাষকলাই, ৫ হেক্টর মসলা জাতীয় ফসলের ক্ষেত এবং ৬ হেক্টর কলার বাগান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া চলতি মৌসুমে জুন ও জুলাই মাসে দু'দফা বন্যায় প্রায় ৪৫ হাজার চাষির ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ৩ হাজার হেক্টরের মতো পাটক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এতে জেলায় এবার স্বাভাবিকভাবেই আমনসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এই অভিমত স্থানীয় কৃষি বিভাগের।
এদিকে এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতিতে পড়া চাষিদের বেশির ভাগই চরের হওয়ায় এবার খাবার কিংবা অর্থকরী হিসেবে কোনো ফসল তাদের ঘরে উঠবে না। এখন বন্যায় বিধ্বস্ত চরগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিকভাবে হওয়া কিছু কাশবন। এই কাশবন এখন মুষ্টিমেয় চরবাসীর ভরসা। ঘর ছাওয়ানোর জন্য এগুলো বিক্রি করে যেটুকু আয় হবে তাই দিয়ে যে ক'দিন চলা যায়। যাদের এটুকুও নেই তাদের অবস্থা আরও করুণ। ফলে সামনের দিনগুলোতে শুধু দিনমজুরির আয়ের ওপর তাদের নির্ভর করতে হবে। দিনমজুরিও এখন জুটবে না। জুটবে আমন কাটা-মাড়াই যখন শুরু হবে, তখন। এ জন্য আগামী ফসল আবাদ এবং সে আবাদ ঘরে না তোলা পর্যন্ত চরম অভাব মোকাবেলা করে দিন কাটাতে হবে তাদের।
শুধু তাই নয়, বন্যায় তাদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলে যে আঘাত এসেছে তাতে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে চরবাসীর। আবার নতুন করে উঠে দাঁড়াতে পারবেন তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ জন্য তাদের সহায়তা দরকার।
এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত চরবাসীর মধ্যে বন্যাকালে দু'দফায় ১০ কেজি করে ২০ কেজি চাল সরকারি ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় অনেকের ভাগ্যে এই সহায়তা জোটেনি। এ ছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো কেন জানি এবার বন্যার্তদের সহায়তায় মাঠে নামেনি। এখন সরকারি আর কোনো সহায়তা মিলবে কি-না এবং উন্নয়ন সংগঠনগুলো সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসবে কি-না, তা স্পষ্ট নয়। তাহলে কী হবে চরবাসীর?
দূর থেকে শরতের কাশফুলে ভরা চরগুলোকে যতই সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখা যাক না কেন, তার ভেতরে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে এ মুহূর্তে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ছাড়া বিকল্প নেই_ এ কথা নিদ্বর্িধায় বলা যায়।

মমিনুল ইসলাম মঞ্জু :সমকাল
প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.