প্রতি জেলায় হয়নি খাদ্য আদালত by নাঈমা আমিন

২০০৯ সালের ১ জুন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বনাম বাংলাদেশ, রিট পিটিশন নং ৩২৪/২০০৯ মামলায় হাইকোর্ট সরকারকে প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্য আদালত (ফুড কোর্ট) স্থাপন এবং খাদ্য বিশ্লেষক ও খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন।


এই রায় কার্যকরের জন্য আদালত সরকারকে দুই বছরের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত (ফুড কোর্ট) গঠিত হয়নি। ফলে ভোক্তারা খাদ্যে ভেজাল রোধে আইনের আশ্রয় নিতে এবং বিচারের দুয়ার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উচ্চ আদালত একই রায়ে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ গঠনেরও আদেশ দিয়েছিলেন।
আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন, ‘দেশের জনগণ অসুস্থ থাকিলে রাষ্ট্রের কোনো পরিকল্পনারই অগ্রগতি হইতে পারে না। এই সকল কারণে জনগণের সুস্বাস্থ্যের প্রতিবিধানকরণ প্রাধান্য পাইবার যোগ্য। কারণ ৩২ অনুচ্ছেদে ব্যক্তি জীবনের সুস্থতা ব্যতিরেকে প্রজাতন্ত্রের সকল প্রচেষ্টাই সম্পূর্ণ বিফল হইবে। অতএব সংবিধানে বর্ণিত উপরোক্ত উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিশুদ্ধ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ অতি জরুরি। এই সংক্রান্ত পদক্ষেপ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯-এ বর্ণনা করা হইয়াছে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই যে ইহার কোনো প্রয়োগ দৃশ্যমান নহে। সরকার পক্ষ হইতেও এইরূপ ব্যর্থতা অস্বীকার করিতে পারে নাই।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচপিআরবি) সভাপতি আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘আদালতের রায়ের দুই বছরের মধ্যে সরকারের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্য আদালত স্থাপনের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রতি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে সরকার। তাই আদালত অবমাননার দায়ে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’

কী আছে আইনে
খাদ্যে ভেজাল রোধ এবং খাদ্য উৎপাদন-বিপণন নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে রয়েছে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯। ১৯৫৯ সালের বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ আইনটির সংশোধনী আনা হয় ২০০৫ সালে।
এ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সরকার যেকোনো এলাকায় খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ দেবে। আর এই খাদ্য পরিদর্শক খাদ্য-সংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য জব্দ, ধ্বংসসহ অধ্যাদেশে বর্ণিত যেকোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্যে ভেজাল রোধে এক বা একাধিক খাদ্য আদালত থাকবে। সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এসব আদালত প্রতিষ্ঠা করবে এবং প্রতিটি আদালতের ভৌগোলিক এখতিয়ার নির্ধারণ করবে। প্রতিটি খাদ্য আদালতে বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত বিচারিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯ অনুসারে খাদ্য আদালতকে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন-সংশ্লিষ্ট যেসব অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো:
ভেজাল খাদ্যবস্তু প্রস্তুত, বিক্রি; সঠিক মান বা বিশুদ্ধ নয় এমন খাদ্য প্রস্তুত বা বিক্রি; খাদ্য প্রস্তুত বা বিক্রির স্থানে ভেজাল দ্রব্য রাখা বা রাখার অনুমতি প্রদান; নির্ধারিত লাইসেন্স ব্যতীত সাদা তেল রাখা; রোগগ্রস্ত পশু বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বিক্রি; ভুয়া লেবেল ব্যবহার; ভুয়া প্রচারণা; ভুয়া ওয়ারেন্ট প্রদান; খাদ্যবস্তু ঢেকে রাখতে ব্যর্থতা; কুষ্ঠ, যক্ষ্মা বা ঘোষিত অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক খাদ্যবস্তু প্রস্তুত, বিক্রি বা স্পর্শ করা; খাদ্যবস্তু বিক্রি বা বিশ্লেষণ বা পরীক্ষা করার জন্য নমুনা প্রদানে অস্বীকৃতি; ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বা খাদ্য পরিদর্শককে পরিদর্শন বা প্রবেশে বা জব্দকরণে বাধা প্রদান বা প্রতিরোধকরণ; প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বা খাদ্য পরিদর্শককে জব্দকৃত খাদ্যদ্রব্য, উপাদান, বস্তু এবং পাত্র অপসারণে বাধা প্রদান।
খাদ্য আদালত উপরিউক্ত অপরাধ প্রথমবারের মতো ঘটলে দুই হাজার ৭৫ টাকা জরিমানা এবং দুই থেকে ১২ মাস সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। একই অপরাধ পরের বার ঘটলে ২৫ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং তিন মাস থেকে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। সেই সঙ্গে দোকান, কারখানা ও সরঞ্জামাদি জব্দ করার ক্ষমতা রাখেন।

রয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (দক্ষিণ) খাদ্য আদালত
সারা দেশের মধ্যে একমাত্র ঢাকা সিটি করপোরেশনে (দক্ষিণ) খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিদর্শকেরা যেকোনো এলাকার যেকোনো ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেটেরিয়া, দোকানসহ সব ধরনের খাদ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে পারেন। সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করার জন্য ডিসিসির জনস্বাস্থ্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ওই পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করে তা সংশ্লিষ্ট পরিদর্শককে দেওয়া হয়। সাধারণত কোনো দ্রব্য বা পণ্যে ভেজাল পেলে আইন অনুযায়ী পরিদর্শকেরা বাদী হয়ে মামলা করতে পারেন নগর ভবনের নির্ধারিত খাদ্য আদালতে। আদালতে বিচারকাজ করেন যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক। মামলার সরকারি কৌঁসুলি হিসেবেও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন।

সরাসরি কোনো ভোক্তা ডিসিসি (দক্ষিণ) খাদ্য আদালতে মামলা করতে পারেন না
ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) খাদ্য আদালত সূত্রে জানা যায়, সাধারণত খাদ্যপণ্যে যে ভেজাল আছে, সেটা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরীক্ষণ করা দুষ্কর। যদি কোনো ভোক্তা জানতে পারেন যে তাঁদের এলাকার বা অন্য কোনো স্থানের খাবারের দোকানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি করা হয় কিংবা বাসি, পচা খাবার পরিবেশন করা হয় সে ক্ষেত্রে ভোক্তা ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) স্বাস্থ্য বিভাগে ফোনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আবার সাদা কাগজে ডিসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করে জানাতে পারেন ভেজালবিষয়ক যেকোনো তথ্য। সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত ডিসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত গিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন। উত্তর অথবা দক্ষিণ যে সিটি করপোরেশনের অধীন আপনি হোন না কেন খাদ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সম্পর্কে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) স্বাস্থ্য বিভাগে আবেদন করতে পারবেন কিন্তু সরাসরি কোনো ধরনের মামলা কোনো ভোক্তা করতে পারবেন না।
ঢাকা সিটি করপোরেশন (দক্ষিণ) সূত্রে জানা যায়, খাদ্য আদালতে রয়েছে জনবল এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব। যার কারণে খাদ্যে ভেজাল রোধের কাজটি দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না। কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসনিক পুলিশ ও র‌্যাবের সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন খাদ্যে ভেজাল রোধে।

মতামত
খন্দকার মাহবুব হোসেন
সহসভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
সরকারকে খাদ্যে ভেজাল বন্ধে বৃহৎভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনগতভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার খাদ্য আদালত করার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু জনগণের স্বার্থে খাদ্যে ভেজাল রোধে প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা সরকারের অবশ্যকরণীয়।’

No comments

Powered by Blogger.