আজ থেকে থ্রিজি ফোন-পর্যাপ্ত সেবার প্রস্তুতি নেই by মাসুদ রুমী

মোবাইল ফোনের তৃতীয় প্রজন্মের (থার্ড জেনারেশন-থ্রিজি) প্রযুক্তিতে আজ প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। প্রথম পর্যায়ে টেলিটকের গ্রাহকরা থ্রিজি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। অন্য মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো আগামী বছরের শুরুতে থ্রিজিতে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।


তবে এ প্রযুক্তিতে সব শ্রেণীর গ্রাহকের ব্যবহার করার মতো উপাদান পর্যাপ্ত না থাকায় এর প্রয়োগ সীমিত থেকে যাবে বলে মনে করেন টেলিযোগাযোগ খাতের বিশ্লেষকরা।
সূত্র মতে, আপাতত শুধু রাজধানী ও আশপাশের গ্রাহকরা থ্রিজি সুবিধা পাবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরের চার লাখ গ্রাহক এ সুবিধা পাবে। এ বছরের শেষ নাগাদ চট্টগ্রামে চালু করা হবে থ্রিজি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে আজ রবিবার এর কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এ জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্রিজি চালু হলেও এর সুবিধা সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্থানীয় ভাষায় ব্যবহারের উপযোগী উপাদান (কনটেন্ট) নেই। থ্রিজি উপযোগী কনটেন্টের অভাবে এই উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসবে না বলে তাঁরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, থ্রিজি যদি সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে আটকে যায়, তাহলে এত ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ব্যবসাসফল হবে না। এ জন্য স্থানীয় ভাষায় পর্যাপ্ত কনটেন্ট তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন তাঁরা।
সিটিসেলের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) মেহবুব চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'থ্রি, ফোর বা ফাইভ-জি চালু নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে লাভ নেই, যদি না কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় উপাদান (কনটেন্ট) তৈরি করা না যায়; বা যদি কৃষি, স্বাস্থ্য, ভূমি-সংক্রান্ত সেবা ও তথ্য তাদের কাছে সহজে পৌঁছানো না যায়। যত 'জি'-ই চালু করা হোক, বিভাগীয় শহরের সীমিত কিছু ব্যবহারকারী যদি ইন্টারনেটে সিনেমা ডাউনলোড করে, তবে তা হবে অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় অপচয়।'
মেহবুব চৌধুরী আরো বলেন, 'আমরা ই-মেডিসিন ও স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কথা বলছি। আমরা যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে শহরের শিক্ষকদের দিয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীদের পড়াতে না পারি, তাহলে থ্রি-জি আমাদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে না।' শহর ও পল্লী অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়নের যে বৈষম্য আছে, তা কমানোর লক্ষ্যে ইন্টারনেটকে একটা সেতু হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দেন মেহবুব চৌধুরী।
টেলিটকের থ্রিজি চালুর কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানিয়ে বাংলালিংকের সিনিয়র ডিরেক্টর, মার্কেটিং শিহাব আহমাদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, যেসব মোবাইল গ্রাহকরা টুজি ব্যবহার করছে, তারা ধীরে ধীরে থ্রিজির দিকে যাবে। তবে থ্রিজি সুবিধা দেশের বৃহত্তর জনগণের মধ্যে বিস্তৃত করতে হলে সব মোবাইল অপারেটরকে থ্রিজির লাইসেন্স দিতে হবে। তাহলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সবগুলো অপারেটর থ্রিজি সেবাকে গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারবে। তিনি বলেন, 'যদি অপারেটরদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং থ্রিজির খসড়া গাইডলাইনে শর্ত ও লাইসেন্স ফি সহনীয় রাখা হয়, তাহলে আমরাও গ্রাহকদের কাছে এ সেবা পৌঁছে দিতে পারব।'
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশে যখনই নতুন কোনো প্রযুক্তি আসে তখন তা নিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের আগ্রহ দেখা যায়। যেটা আমরা মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে দেখেছি। কিন্তু থ্রিজি নিয়ে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।' এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, থ্রিজি সাধারণ মানুষকে কী সুবিধা দেবে, তা বুঝানো হয়নি। রবিবার যদিও এ প্রযুক্তির উদ্বোধন হবে, কিন্তু এর দাম কী হবে, কবে সবাই এটি ব্যবহার করতে পারবে- ইত্যাদি বিষয় পরিষ্কার করা হয়নি।
এই প্রযুক্তিতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই উল্লেখ করে মোস্তাফা জব্বার বলেন, 'সারা পৃথিবী যেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নিয়ে লড়াই করছে, সেখানে আমরা তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি- এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। এ প্রযুক্তিতে আমরা ২০০৯ সালেই যেতে পারতাম। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, তার প্রত্যাশার সঙ্গে এটা মেলে না।' 'সবচেয়ে দুঃখের কথা, এখন পর্যন্ত আমরা স্থানীয় চাহিদা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় কনটেন্ট তৈরি করতে পারিনি। আর মাতৃভাষায় কনটেন্ট তৈরির তো বড় কোনো উদ্যোগ নেই। আমি মনে করি, কনটেন্ট আমাদের থ্রিজির অগ্রযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।' যোগ করলেন মোস্তাফা জব্বার।
থ্রিজি প্রযুক্তির আগমনকে স্বাগত জানিয়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আখতারুজামান মঞ্জু বলেন, থ্রিজি উপযোগী মোবাইল সেট ও ডিভাইস সহজলভ্য করতে হবে। কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়েছে, থ্রিজি চালু হলে এই বাজারে আরো কনটেন্ট চলে আসবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা থ্রিজির জন্য অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে যে পরিমাণ মোবাইল প্যানিট্রেশন তার একটি বড় অংশই গ্রামে। যাদের জন্য ইংরেজি ভাষা একটি সমস্যা।' তিনি আরো বলেন, "আমরা আশা করি, থ্রিজি একটি অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে না, বাংলাদেশে ওয়াইম্যাক্সের ক্ষেত্রে যা হয়েছে। থ্রিজি প্রযুক্তি যদি বিভাগীয় শহর অতিক্রম না করে, তাহলে সেটি 'ভায়েবল' হবে না।" থ্রিজির ব্যবহার বাড়াতে স্থানীয় কনটেন্ট বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, যারা পয়সা খরচ করে থ্রিজি ব্যবহার করবে, তাদের এমন কনটেন্ট দিতে হবে- যাতে ব্যবহারকারী বাড়তি পয়সা খরচ করতে রাজি হয়।
থ্রিজি চালু হলে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট গতি বেড়ে যাবে বহুগুণ। ফলে এখন যে কাজটি করতে বেশি সময় লাগে, তখন তা কম সময়ে করা যাবে। এ ছাড়া টেলিভিশন দেখা যাবে। দেওয়া যাবে ভিডিও কলও। এ ছাড়া জিপিএসের মাধ্যমে পথনির্দেশনা লাভ, উচ্চ গতির ইন্টারনেট ব্যবহারসহ ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেওয়া যাবে।
সূত্রে জানা যায়, আগামীকাল সোমবার থেকে রাজধানীর টেলিটকের তিন হাজার রিটেইল পয়েন্ট এবং আটটি বিশেষ গ্রাহক সেবাকেন্দ্র থেকে থ্রিজির সিম বিক্রি শুরু হবে। তা ছাড়া পুরনো সিম থ্রিজিতে রূপান্তর করতে চাইলে গ্রাহক সেবাকেন্দ্রে গিয়ে করাতে হবে।
জানা গেছে, আপাতত পাঁচটি টেলিভিশন চ্যানেল থ্রিজি প্রযুক্তিতে মোবাইল ফোনে দেখা যাবে। এগুলো হলো- বাংলাদেশ টেলিভিশন-বিটিভি, সময় টিভি, জিটিভি (গাজী টিভি), আরটিভি ও মাইটিভি। অন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও এর মধ্যে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
প্রাথমিকভাবে ভয়েস কলের রেট এখন যা আছে থ্রিজিতেও তাই থাকবে বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, টেলিটকের থ্রিজির সব সার্ভিসেই ১০ সেকেন্ড পালস সুবিধা থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.