ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট- ফিরবে কি আর সেই দিন! by আরিফুল ইসলাম

৩৩ বছর পর বিশ্বকাপ, আট বছর পর একটি বৈশ্বিক শিরোপা জয়। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে শোনা যাচ্ছে নতুন দিনের গান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে? আশির দশকের স্বর্ণসময়ে ফেরা আর হয়তো সম্ভব নয়, তবে পারে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় শক্তি হয়ে উঠতে।


লিখেছেন আরিফুল ইসলাম প্রেমাদাসার উজ্জ্বল আলোয় হাজার হাজার মলিন লঙ্কান মুখের সামনে যখন গ্যাংনামের নানা রূপ আর বিচিত্র সব উদ্যাপন দেখাচ্ছিলেন ক্রিস গেইলরা, কোর্টনি ব্রাউন তখন কী করছিলেন? স্মৃতিকাতর না হয়ে পারেনই না! বারবাডোজের বাড়িতে বা কোনো পাবে বসে ব্রাউন হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন আট বছর আগে...।
২০০৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর শেষ বিকেলের মরে আসা আলোয় এমনই পাগলপারা উচ্ছ্বাসে মেতেছিল একদল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার। গ্যাংনাম তখন ছিল না, কিন্তু উদ্যাপনে ক্যারিবিয়ান বৈচিত্র্যের প্রদর্শনী ঠিকই ছিল। মধ্যমণি ছিলেন ব্রাউন। ২১৮ রান তাড়ায় ধুঁকতে থাকা ক্যারিবিয়ানদের শেষ ভরসা শিবনারায়ণ চন্দরপল (৪৭) যখন ফিরে গেলেন, স্কোরবোর্ডে ৮ উইকেটে ১৪৭। ইংল্যান্ডের প্রথম বৈশ্বিক শিরোপা তখন মনে হচ্ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু অষ্টম উইকেটে ৭১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সেদিন অভাবনীয় এক জয় এনে দিয়েছিলেন ব্রাউন ও ইয়ান ব্র্যাডশ। ব্রায়ান লারা আর রায়ান হাইন্ডস ছুটে গিয়ে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন, নিঃসন্দেহে ব্রাউনের আক্ষেপে ভরা ক্যারিয়ারের স্মরণীয়তম মুহূর্ত।
ক্রিকেটের গতিপ্রবাহে আট বছর যথেষ্ট লম্বা সময়। পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। ওভাল উৎসবের মাত্র দুজনই ছিলেন প্রেমাদাসার উৎসবে—গেইল ও ডোয়াইন ব্রাভো। আর সেই ব্রাউন এখন নির্বাচক! সেদিনের নায়ক তাই এবারের সাফল্যেরও পরোক্ষ অংশীদার। শুধু শিরোপা জয়ের মুহূর্তটায় নয়, ব্রাউন আট বছর আগে ফিরে যেতে পারেন শিরোপা জয়ের পরের ঘটনাপ্রবাহেও। আবার উন্মাতাল জ্যামাইকা থেকে গায়ানা। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে পুরো ক্রিকেট-বিশ্বে আবারও আশার বুনন, এবার কি সুদিনের পথে হাঁটা শুরু হবে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের!
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, ২০০৪ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জয়ের পর কী হয়েছিল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে। কোচ গাস লগি চাকরি হারিয়েছিলেন টুর্নামেন্ট শেষেই। লগির পর বর্তমান কোচ ওটিস গিবসনের আগে আর কোনো ক্যারিবিয়ান কোচ পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই ফাইনাল জয়ের দুই নায়ক ব্রাউন ও ব্র্যাডশ দল থেকে বাদ পড়ে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল দুই বছরের মধ্যে। ওই দলের তরুণেরা পারেননি নিজেদের সেভাবে মেলে ধরতে, সিনিয়ররা পারেননি তরুণদের পথ দেখাতে। ২০০৭ বিশ্বকাপ আসতে আসতেই দল প্রায় ভিন্ন চেহারায়! বিশ্বকাপ শেষে অধিনায়ক ব্রায়ান লারার অবসর, আরেক দফা ভাঙাগড়া। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট থেকে গেছে অতলেই। পরিসংখ্যানের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবটা দেখুন—২০০৪ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর এ পর্যন্ত ৭১ টেস্টের মাত্র আটটি জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, হার ৩৭টিতেই। জয়-পরাজয়ের হারে (০.২১) কেবল বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের ওপরে। ওয়ানডের চিত্রটা আরও হতাশাজনক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ওয়ানডেতে জয়-পরাজয়ের হারে এই সময়কালে বাংলাদেশেরও (০.৬৭) নিচে উইন্ডিজ (০.৬৩), ১৭২টি ওয়ানডেতে জয় মাত্র ৬৩। টি-টোয়েন্টিকে ক্যারিবিয়ানদের আদর্শ সংস্করণ মনে করা হয়, কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে জয়-পরাজয়ের হারে এটিতেও কেবল বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের ওপরে তারা। স্রেফ একটি বৈশ্বিক শিরোপা জয় তাই কোনোভাবেই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সুদিন ফেরার ইঙ্গিত নয়।
ওটা গ্লাসের খালি অংশ। ভরা অংশটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এবারের বিশ্ব টি-টোয়েন্টির শিরোপা জয়ের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থা ছিল ২০০৪-এর চেয়েও বাজে। তখন মাঠের ক্রিকেটের ক্রম অধোগতিই ছিল মূল সমস্যা। ব্রায়ান লারার ট্রফি উঁচিয়ে ধরা তাই চমকে দিয়েছিল অনেককেই। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মাঠের ক্রিকেটের দুর্দশা তো চলছেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে মাঠের বাইরের হাজারো সমস্যা। গত দুই-তিন বছরের মতো টালমাটাল সময় ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ইতিহাসেই সম্ভবত আর আসেনি। এই টালমাটাল সময়েরও সূত্রপাত একটি সাফল্যের পর। ২০০৯ সালে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর পরই বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে খেলোয়াড় বিদ্রোহ। ফলাফল—দ্বিতীয় সারির দল নামিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই। এরপর রামনরেশ সারওয়ানের সঙ্গে বোর্ডের ঝামেলা, শিবনারায়ণ চন্দরপলের সঙ্গে বোর্ড ও কোচের দ্বন্দ্ব, বারবার অধিনায়ক বদল, দলে জায়গা নিশ্চিত নয় এমন একজনকে অধিনায়ক করা, ক্লাব বনাম দেশ দ্বন্দ্ব, সর্বশেষ গেইলকে নিয়ে এক বছরের টানাপোড়েন। বোর্ড আর ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের ‘যুদ্ধ’ তো এখনো তরতাজা। এত কিছু পেরিয়ে এবারের জয়—নিশ্চিতভাবেই এটা ২০০৪-এর জয়ের চেয়ে মধুর ও আশা-জাগানিয়া।
স্বপ্ন দেখার ভিত্তিটা এবার আরেকটু বেশি মজবুত দলটার কারণেও। হ্যাঁ, এই দলে একজন ব্রায়ান লারা নেই, শিবনারায়ণ চন্দরপলের ক্যারিয়ার গোধূলিতে, সারওয়ানের ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তার নৌকায়। তার পরও দলটাকে নিয়ে আশা করা যায়। কাগজে-কলমে দলটার দিকে তাকান। শুধু সংক্ষিপ্ত সংস্করণে নয়, সঠিক নির্দেশনা আর ব্যবস্থাপনায় দলটা সফল হতে পারে সব সংস্করণেই। রোমাঞ্চকর ও সম্ভাবনাময় সব ব্যাটসম্যান যেমন আছেন, আছেন রহস্য স্পিনার, লেগ স্পিনার, বাঁহাতি স্পিনার, দারুণ সব ফাস্ট বোলার। টুর্নামেন্ট জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণখোলা বিচিত্র সব উদ্যাপনে গেইল বুঝিয়ে দিয়েছেন মেরুন জার্সিতেও এখন তিনি সুখী। আর সুখী গেইল মানেই বিপজ্জনক গেইল, বিপজ্জনক গেইল মানেই বিপজ্জনক ওয়েস্ট ইন্ডিজ! আছেন দলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারার মতো অধিনায়ক। ড্যারেন স্যামি একাদশে জায়গা পাওয়ার যোগ্য কি না, সেই প্রশ্ন তাঁর সঙ্গী অধিনায়ক হওয়ার দিন থেকেই। যত দিন অধিনায়ক আছেন, তত দিনই সম্ভবত থাকবে প্রশ্নটা। কিন্তু স্যামির চরম নিন্দুকও একটা কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, হুপার-লারা-চন্দরপল-সারওয়ান-গেইল যা পারেননি, সেটা পেরেছেন স্যামি। দলকে এককাট্টা করতে পেরেছেন, যেকোনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়কের জন্য যা সবচেয়ে বড় পরীক্ষা! অনেক দিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মনে হচ্ছে সুখী এক দল। নিজের উপভোগের মন্ত্র দলের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন স্যামি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ছিল যেটা, ‘বিনোদন’, এই দলের মাঝে সেটা দেখা যাচ্ছে। মাঝে বেশ কিছু বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাঠে-মাঠের বাইরে মনে হতো বিষণ্ন একটা দল। তাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি-পদ্ধতি-ধরনে কোথাও যে গলদ আছে, চোখে পড়ত স্পষ্ট। কিন্তু স্যামির দল যেন খেলাটা উপভোগ করছে, আর ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের হারানো বিনোদনটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
সম্ভাবনার হাত ধরাধরি করে আছে শঙ্কাও। গেইল-পোলার্ড-ব্রাভো-নারাইনরা ফ্রিল্যান্স ক্রিকেটার, বোর্ডের চুক্তিতে সই করেননি। বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে এত অর্থের ছড়াছড়ি যে ক্লাব-দেশ দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। বোর্ড আর ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পর্কও এখন শীতল। সব মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথটা এখনো কণ্টকাকীর্ণ। ড্যারেন স্যামি যেমন ভীষণ সতর্ক, ‘মোটেও বলা যাবে না আমাদের সুদিন ফিরেছে, তবে এই শিরোপা প্রমাণ করছে, আমরা সঠিক পথেই আছি।’ এই বোধটাই আশা-জাগানিয়া। স্যামি যদি বোধটা ছড়িয়ে দিতে পারেন দলের সবার মাঝে, পথের শেষটাও খুঁজে পাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তবে ‘সুদিন ফিরবে’ কথাটার ব্যাখ্যা দাবি রাখে। সত্তর-আশির দশকের মতো আবার অপরাজেয় হয়ে উঠবে উইন্ডিজ, এই ভাবনা সম্ভবত ভুল। ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য; শুধু ক্রিকেট নয়, বিশ্বক্রীড়াতেই। ফায়ার ইন ব্যাবিলন চলচ্চিত্রে মাইকেল হোল্ডিং যেমন বলেছেন, ‘বিশ্বের কোথাও আর কোনো খেলার কোনো দল ১৫ বছর ধরে রাজত্ব করতে পারেনি।’ উদ্ধত দাবি মনে হতে পারে, কিন্তু নির্ভেজাল সত্য। ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে অসাধারণত্ব ছিল শক্তির রসদে। স্রেফ ১১ জন বা ১৫ জন দুর্দান্ত ক্রিকেটারের গড়া একটি দল নয়, ক্যারিবিয়ানের ছোট্ট দ্বীপগুলোর বেশ কটি তখন একাই বিশ্ব-ক্রিকেটের অন্যতম শক্তি হতে পারত। ১৯৮৪ সালে মার্শাল-গার্নার-ড্যানিয়েলরা যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে অস্ট্রেলিয়ায়, ঠিক একই সময়ে বিতর্কিত সফরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফাস্ট বোলিংয়ের ঝড় তুলেছেন সিলভেস্টার ক্লার্ক, ফ্রাঙ্কলিন স্টিফেনসন, হার্টলি অ্যালেইন ও এজরা মোজলি। এঁরা সবাই জায়গা পেতে পারতেন বিশ্বের যেকোনো দলে। অথচ সবারই কিন্তু একই দ্বীপ থেকে উঠে আসা—বারবাডোজ! ছোট্ট দ্বীপটি তখন ক্রিকেটারের খনি, সামর্থ্য ছিল বিশ্বের যেকোনো দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলার। ক্রিকেটার ‘উৎপাদনে’ কাছাকাছি ছিল আরও বেশ কটি দ্বীপ। ওই দিনগুলোতে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ফেরা বোধ হয় সম্ভব নয়।
তা ছাড়া টি-টোয়েন্টির যুগে আর বিশ্ব-ক্রিকেটের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তত নিকট ভবিষ্যতে কোনো দলই দীর্ঘ সময় রাজত্ব করতে পারবে না। গত কিছুদিন টেস্ট ক্রিকেটের শীর্ষস্থানের বারবার হাতবদল, শীর্ষ দলগুলোর পারফরম্যান্সের ওঠা-নামাই সেটার প্রমাণ। কারণটা ব্যাখ্যা করতে প্রয়োজন আরেকটা বড় লেখা। তবে আজকের প্রেক্ষাপটেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবার হয়তো পারে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা দলগুলোর একটি হতে, আবার পারে ক্রিকেট বিনোদনের সবচেয়ে বড় খোরাক হতে। স্যামিরা পারবেন কি না, উত্তরটা কেবল সময়েরই জানা।

No comments

Powered by Blogger.