মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সেই বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন by নাসির আহমেদ
আমাদের প্রজন্মের সকলে নয়, অনেকেই হয়তো স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব দেখবেন। কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্রমাগত সাফল্যে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ২০২১ সালে যদি বেঁচে থাকি, তাহলে কোন বাংলাদেশ দেখব। কেমন হবে নয় বছর পরে এদেশের চেহারা-চরিত্র। যদি না থাকি তাহলে সন্তানদের রেখে যাব কেমন বাংলাদেশে?
উত্তরটা জানা গেলে স্বস্তি পেতাম। কারণ এক অস্থির, অনিশ্চিত আর অবাঞ্ছিত বাস্তবতায় এগিয়ে চলেছি। যদিও 'ঠরংরড়হ ২০২১' নিয়ে ক্ষমতাসীন জোট নির্বাচনী অঙ্গীকারে আশা জাগানিয়া কিছু পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বিপুল সংখ্যক তরুণ ভোটার যে গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রমাণ ২০০৮-এর নির্বাচনে মহাজোটের বিশাল বিজয়। সেই তরুণ ভোটারদের স্বপ্ন এবং বাস্তবতা যে এক হয়নি, তার আলামত সমাজের চারপাশেই দৃশ্যমান। সুশাসনের পথে পদে পদে অন্তরায়। দুর্নীতি করতে কুণ্ঠিত নন 'চমৎকার' ইমেজের ব্যক্তিও। জনগোষ্ঠীর শতকরা এক ভাগেরও কম যারা, সেই শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধরাও আক্রান্ত হলো! জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, দুর্নীতি, ছোবলের পর ছোবল মারছে দেশটাকে। এমনকি গণতন্ত্রও চলছে না মসৃণ পথে। সংবাদমাধ্যমেও চিত্রিত এসব। যা ভবিষ্যতের তথ্য দলিল। দলীয় মুখপত্র দু-একটি দৈনিক বা চিহ্নিত টেলিভিশন চ্যানেলের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে। না হলে গ্রহণযোগ্যতা থাকে না পাঠক ও দর্শকের কাছে। কিন্তু কোনোদিনই ক্ষমতাসীনরা রবীন্দ্রনাথের মতো সাহসী হন না। তারা কেমন করে ভালোবাসবেন 'কঠিন সত্য'কে? তারা বোঝেন না_ 'সত্য যে কঠিন... সে কখনো করে না বঞ্চনা'। বঞ্চনার প্রধান উৎস তো স্তাবকতা। স্তাবকদের মিথ্যে প্রশংসা সব সময় ক্ষমতাধরদের কাছে প্রিয়।
প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা সরে গেলাম হয়তো। যে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানি আর নৃশংসতায় করুণ কারবালা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ড, সেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মতো বড় আনন্দের জাতির জীবনে আর কী আছে? অশ্রু আর রক্তে লেখা স্বাধীনতার ৫০ বছরে কেমন থাকবে বাংলাদেশের চেহারা-চরিত্র, জানি না। তবে একাত্তরের স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ থেকে আজ আমরা বহু দূরে। শোষণ, সামরিকতা, দুঃশাসন, গণতন্ত্রহীনতা আর সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির জন্যই তো ছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতায় যে আমাদের মুক্তি ছিল না, তা বুঝতে এক বছরও লাগেনি। ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকরা আমাদের মাতৃভাষার গায়ে হাত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের দুঃশাসনের অবসান হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের যে অসাধারণ প্রগতিশীল, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ সুশাসনের সহায়ক সংবিধান, সেই সংবিধান তো রক্ষা করতে পারিনি। তছনছ করে ফেলেছি অনৈক্যে, ক্ষমতার লিপ্সায়। সাম্প্রদায়িকতায়, পাকিস্তানি চেতনায় আবার সামরিকায়ন হয়েছে। 'নষ্টদের অধিকারে' চলে গেছে রাজনীতির বৃহত্তর অংশ। সুশাসনের জায়গা দখল করেছে দুঃশাসন, দুর্নীতি আর অবিচার। প্রশাসন-আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সর্বত্র আছর লেগেছে পাকিস্তানি ভূতের। এই বাস্তবতা কোথায় নিয়ে ঠেকিয়েছে অনেক আকাঙ্ক্ষার সেই প্রগতিশীল বাংলাদেশকে! এমনকি তরুণ প্রজন্মকেও আমরা গড়ে তোলার কথা ভাবলাম না! যা কিছু গৌরবের, সেই ইতিহাসও কি পেঁৗছাতে পেরেছি আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে? ছাত্র রাজনীতি হারিয়েছে তার গৌরবের ঐতিহ্য। এমনকি ইতিহাসও অজ্ঞাত। তাদের কাছে দেশপ্রেমের বোধটাই তো সঞ্চার করা যায়নি। মেধা-মনন নয়, রাজনীতিতে আসার যোগ্যতা অর্থ আর পেশিশক্তি। ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও তা-ই। শিক্ষার্থীরাও রাজনীতিবিমুখ আজ।
এই অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দিনে দিনে অবক্ষয়ে পচন ধরেছে রাজনীতিতে, শিক্ষাঙ্গনে, ক্যাডার সার্ভিসে, আইন-বিচারসহ সমাজের সবক্ষেত্রে। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও অন্ধ দলীয় রাজনীতিতে নিমজ্জিত। ক্লাসে পাঠদানের চেয়ে কোচিংয়ে আগ্রহ বেশি। শিক্ষা পরিণত হয়েছে বাণিজ্যে। চিকিৎসকরাও ব্যতিক্রম নন। 'বিচারপতি'র মতো শীর্ষ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব যখন নৈতিক স্খলনে পড়েন, জাল-জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত হন_ তখন আর ভরসার জায়গাটা কোথায়? এমন বাস্তবতার কারণেই দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অনেক স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও সাহসী হয়ে নির্মোহ নিরপেক্ষা ভূমিকা পালন করছে না। রাষ্ট্রপতির মতো 'সর্বজনমান্য দলনিরপেক্ষ একটি শীর্ষ চেয়ার'ও কীভাবে কলুষিত হয়ে যান, দলীয় প্রধানের আজ্ঞাবহ পুতুল হয়ে পড়েন, রাষ্ট্রে এমন দুর্যোগ ডেকে আনেন যে, গণতন্ত্র বিপন্ন করতে অগণতান্ত্রিক শক্তি চলে আসে ক্ষমতার পাশে! এইসব পাপ সঙ্গে করেই তো যেতে হচ্ছে আগামীর কাছে।
২০২১ সালের দিকে যেতে যেতে এই নির্মম সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের প্রধান সমস্যা স্বার্থান্ধতা। গণতন্ত্র চাই, কিন্তু পরমতসহিষ্ণু নই। গণতন্ত্রের লড়াই করি, কিন্তু দলের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই। বিস্ময়কর হলেও এটাই বাস্তবতা। আর যে দুটি সমস্যা আমাদের পথের বাধা, তা হলো দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব। আইন সবার জন্য এখনও সমান নয়।
দেশের সর্বত্র দুর্নীতি। কোথাও কম, কোথাও বেশি। বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে ফেলার দশা। শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা আরও শোচনীয়। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সার্টিফিকেট কেনাবেচা চলছে। কর্মমুখী, জ্ঞানভিত্তিক নয় পাঠ্যসূচিও। শিক্ষার্থীদের সুকুমারবৃত্তি জাগায় না, সৃজনশীলও করে না। শিক্ষা ভবন দুর্নীতির দুর্গ। আইনের রক্ষকরা নির্যাতক। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে? আইন প্রভাবশালীর জন্য এক রকম, সাধারণের জন্য অন্যরকম। উৎপাদনশীলতার স্বপ্ন কেউ দেখে না, দেখানোও হয় না। বাংলাদেশ যেন দোকানদারের দেশ। সাইকেলের একটা চাকা কিংবা স্টু্ক্রও কেউ উৎপাদনে আগ্রহী? অথচ প্রতিবেশী ভারত দীর্ঘকাল দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারে আমদানি এড়িয়ে চলেছে। তারা আজ এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে স্বনির্ভর হতে পারে শতকোটি মানুষের একটি দেশ।
অথচ আমরা? আমাদের প্রযুক্তি নিয়েও আমরা চুরি করি। ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা করে প্রভাবশালীদের স্বজনরা। কোটি কোটি টাকার ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। আমাদের কৃষি, কুটির শিল্প, পর্যটন, বস্ত্রশিল্প, পাটশিল্প, চামড়া ও চাশিল্প বিশাল সম্ভাবনা সত্ত্বেও ধুঁকছে। ধুঁকছে পরিকল্পনা আর নেতৃত্বের অভাবে। দাতাদের পরামর্শে আদমজীর মতো এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় আমাদের 'গণতান্ত্রিক সরকার'! কৃষিতে বিপ্লব সম্ভব। দুগ্ধ খামার, মৎস্য ও পশু পালনে কী বিপুল সম্ভাবনা এখনও। কারখানা স্থাপন করে ফলের রস থেকে শুরু করে বহু রফতানিযোগ্য কৃষিখাদ্য উৎপাদন এখনও সম্ভব।
এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও রিক্ততায় পরনির্ভর আমরা, এই বাস্তবতা সঙ্গী করেই তো চলেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিকে। এখন থেকে যদি দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান আর আইন সবার জন্য সমান, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাছবিচারমুক্ত প্রতিরোধ গড়া যায়, তাহলে এদেশ দাঁড়াবেই। তরুণরা অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাদের। শিশু-কিশোর, যুব-তরুণদের যদি যথাযথ কর্মসূচি নিয়ে দেশপ্রেমের মূল্যবোধে গড়ে তোলা যায়, তাহলে ৯ বছর পরে আমরা দেশকে সাফল্যে পুষ্পিত দেখতে পারি। বিদেশে আমাদের তরুণ-তরুণীরা অসাধারণ কৃতিত্বে উজ্জ্বল। দেশে কেন পারছেন না? যুব-ক্রীড়া, নারী ও শিশুসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জনস্ফীতি রোধ, প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ এখনই প্রয়োজন। দেশের প্রাণশক্তি যে কৃষক আর গ্রাম, তার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্য, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর। উপজেলা চেয়ারম্যানরা কাজ করতে পারছেন না। এমপিরা আইন প্রণয়নে তুষ্ট নন, তারা গ্রামের উন্নয়ন কাজেরও দায়িত্ব চান! অথচ কাজটা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে কেন মেধাবী তরুণরা আজ হিযবুত তাহ্রীরের মতো মৌলবাদী সংগঠনে ভিড়ছে! কেন জঙ্গিবাদ এ পর্যায়ে সবার জানা। ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছে কারা? আমরা কি জঙ্গিবাদ সঙ্গী করেই পেঁৗছাব রক্তমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে? আমরা যেন মোষ তাড়াতে গিয়ে হিংস্র নেকড়ের অরণ্যে পরিণত না করি এই দেশটাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত পরিবেশেই সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হোক।
নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা সরে গেলাম হয়তো। যে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানি আর নৃশংসতায় করুণ কারবালা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ড, সেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মতো বড় আনন্দের জাতির জীবনে আর কী আছে? অশ্রু আর রক্তে লেখা স্বাধীনতার ৫০ বছরে কেমন থাকবে বাংলাদেশের চেহারা-চরিত্র, জানি না। তবে একাত্তরের স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ থেকে আজ আমরা বহু দূরে। শোষণ, সামরিকতা, দুঃশাসন, গণতন্ত্রহীনতা আর সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির জন্যই তো ছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতায় যে আমাদের মুক্তি ছিল না, তা বুঝতে এক বছরও লাগেনি। ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকরা আমাদের মাতৃভাষার গায়ে হাত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের দুঃশাসনের অবসান হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের যে অসাধারণ প্রগতিশীল, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ সুশাসনের সহায়ক সংবিধান, সেই সংবিধান তো রক্ষা করতে পারিনি। তছনছ করে ফেলেছি অনৈক্যে, ক্ষমতার লিপ্সায়। সাম্প্রদায়িকতায়, পাকিস্তানি চেতনায় আবার সামরিকায়ন হয়েছে। 'নষ্টদের অধিকারে' চলে গেছে রাজনীতির বৃহত্তর অংশ। সুশাসনের জায়গা দখল করেছে দুঃশাসন, দুর্নীতি আর অবিচার। প্রশাসন-আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সর্বত্র আছর লেগেছে পাকিস্তানি ভূতের। এই বাস্তবতা কোথায় নিয়ে ঠেকিয়েছে অনেক আকাঙ্ক্ষার সেই প্রগতিশীল বাংলাদেশকে! এমনকি তরুণ প্রজন্মকেও আমরা গড়ে তোলার কথা ভাবলাম না! যা কিছু গৌরবের, সেই ইতিহাসও কি পেঁৗছাতে পেরেছি আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে? ছাত্র রাজনীতি হারিয়েছে তার গৌরবের ঐতিহ্য। এমনকি ইতিহাসও অজ্ঞাত। তাদের কাছে দেশপ্রেমের বোধটাই তো সঞ্চার করা যায়নি। মেধা-মনন নয়, রাজনীতিতে আসার যোগ্যতা অর্থ আর পেশিশক্তি। ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও তা-ই। শিক্ষার্থীরাও রাজনীতিবিমুখ আজ।
এই অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দিনে দিনে অবক্ষয়ে পচন ধরেছে রাজনীতিতে, শিক্ষাঙ্গনে, ক্যাডার সার্ভিসে, আইন-বিচারসহ সমাজের সবক্ষেত্রে। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও অন্ধ দলীয় রাজনীতিতে নিমজ্জিত। ক্লাসে পাঠদানের চেয়ে কোচিংয়ে আগ্রহ বেশি। শিক্ষা পরিণত হয়েছে বাণিজ্যে। চিকিৎসকরাও ব্যতিক্রম নন। 'বিচারপতি'র মতো শীর্ষ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব যখন নৈতিক স্খলনে পড়েন, জাল-জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত হন_ তখন আর ভরসার জায়গাটা কোথায়? এমন বাস্তবতার কারণেই দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অনেক স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও সাহসী হয়ে নির্মোহ নিরপেক্ষা ভূমিকা পালন করছে না। রাষ্ট্রপতির মতো 'সর্বজনমান্য দলনিরপেক্ষ একটি শীর্ষ চেয়ার'ও কীভাবে কলুষিত হয়ে যান, দলীয় প্রধানের আজ্ঞাবহ পুতুল হয়ে পড়েন, রাষ্ট্রে এমন দুর্যোগ ডেকে আনেন যে, গণতন্ত্র বিপন্ন করতে অগণতান্ত্রিক শক্তি চলে আসে ক্ষমতার পাশে! এইসব পাপ সঙ্গে করেই তো যেতে হচ্ছে আগামীর কাছে।
২০২১ সালের দিকে যেতে যেতে এই নির্মম সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের প্রধান সমস্যা স্বার্থান্ধতা। গণতন্ত্র চাই, কিন্তু পরমতসহিষ্ণু নই। গণতন্ত্রের লড়াই করি, কিন্তু দলের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই। বিস্ময়কর হলেও এটাই বাস্তবতা। আর যে দুটি সমস্যা আমাদের পথের বাধা, তা হলো দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব। আইন সবার জন্য এখনও সমান নয়।
দেশের সর্বত্র দুর্নীতি। কোথাও কম, কোথাও বেশি। বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে ফেলার দশা। শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা আরও শোচনীয়। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সার্টিফিকেট কেনাবেচা চলছে। কর্মমুখী, জ্ঞানভিত্তিক নয় পাঠ্যসূচিও। শিক্ষার্থীদের সুকুমারবৃত্তি জাগায় না, সৃজনশীলও করে না। শিক্ষা ভবন দুর্নীতির দুর্গ। আইনের রক্ষকরা নির্যাতক। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে? আইন প্রভাবশালীর জন্য এক রকম, সাধারণের জন্য অন্যরকম। উৎপাদনশীলতার স্বপ্ন কেউ দেখে না, দেখানোও হয় না। বাংলাদেশ যেন দোকানদারের দেশ। সাইকেলের একটা চাকা কিংবা স্টু্ক্রও কেউ উৎপাদনে আগ্রহী? অথচ প্রতিবেশী ভারত দীর্ঘকাল দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারে আমদানি এড়িয়ে চলেছে। তারা আজ এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে স্বনির্ভর হতে পারে শতকোটি মানুষের একটি দেশ।
অথচ আমরা? আমাদের প্রযুক্তি নিয়েও আমরা চুরি করি। ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা করে প্রভাবশালীদের স্বজনরা। কোটি কোটি টাকার ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। আমাদের কৃষি, কুটির শিল্প, পর্যটন, বস্ত্রশিল্প, পাটশিল্প, চামড়া ও চাশিল্প বিশাল সম্ভাবনা সত্ত্বেও ধুঁকছে। ধুঁকছে পরিকল্পনা আর নেতৃত্বের অভাবে। দাতাদের পরামর্শে আদমজীর মতো এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় আমাদের 'গণতান্ত্রিক সরকার'! কৃষিতে বিপ্লব সম্ভব। দুগ্ধ খামার, মৎস্য ও পশু পালনে কী বিপুল সম্ভাবনা এখনও। কারখানা স্থাপন করে ফলের রস থেকে শুরু করে বহু রফতানিযোগ্য কৃষিখাদ্য উৎপাদন এখনও সম্ভব।
এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও রিক্ততায় পরনির্ভর আমরা, এই বাস্তবতা সঙ্গী করেই তো চলেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিকে। এখন থেকে যদি দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান আর আইন সবার জন্য সমান, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাছবিচারমুক্ত প্রতিরোধ গড়া যায়, তাহলে এদেশ দাঁড়াবেই। তরুণরা অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাদের। শিশু-কিশোর, যুব-তরুণদের যদি যথাযথ কর্মসূচি নিয়ে দেশপ্রেমের মূল্যবোধে গড়ে তোলা যায়, তাহলে ৯ বছর পরে আমরা দেশকে সাফল্যে পুষ্পিত দেখতে পারি। বিদেশে আমাদের তরুণ-তরুণীরা অসাধারণ কৃতিত্বে উজ্জ্বল। দেশে কেন পারছেন না? যুব-ক্রীড়া, নারী ও শিশুসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জনস্ফীতি রোধ, প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ এখনই প্রয়োজন। দেশের প্রাণশক্তি যে কৃষক আর গ্রাম, তার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্য, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর। উপজেলা চেয়ারম্যানরা কাজ করতে পারছেন না। এমপিরা আইন প্রণয়নে তুষ্ট নন, তারা গ্রামের উন্নয়ন কাজেরও দায়িত্ব চান! অথচ কাজটা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে কেন মেধাবী তরুণরা আজ হিযবুত তাহ্রীরের মতো মৌলবাদী সংগঠনে ভিড়ছে! কেন জঙ্গিবাদ এ পর্যায়ে সবার জানা। ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছে কারা? আমরা কি জঙ্গিবাদ সঙ্গী করেই পেঁৗছাব রক্তমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে? আমরা যেন মোষ তাড়াতে গিয়ে হিংস্র নেকড়ের অরণ্যে পরিণত না করি এই দেশটাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত পরিবেশেই সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হোক।
নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
No comments