রামুর আয়না-প্রাণের উচ্ছ্বাস ও আবেগের উৎসবে by অজয় দাশগুপ্ত
শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু ২০ অক্টোবর। বিজয়া দশমী ২৪ অক্টোবর। পূজা শেষ হতে না হতেই কোরবানির ঈদ_ ঈদুল আজহা। বলা যায়, গোটা দেশ টানা প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য উৎসবে মেতে থাকবে। সবাইকে এ উৎসব উপলক্ষে আগাম শুভেচ্ছা।
কয়েকদিন আগে রাজধানী ঢাকার শারদীয় পূজার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল সেকাল ও একালের দুর্গাপূজা নিয়ে। তিনি জানালেন, পাকিস্তানের গোড়ার দিকে পঞ্চাশের দশকে এ মন্দিরে পূজার সময় লোকসমাগম তেমন হতো না। প্রধানত হিন্দুরা আসতেন। অল্পসংখ্যক মুসলিম পুরুষও দর্শনার্থী হিসেবে আসতেন। মাইক বাজাতে হলে পুলিশের অনুমতি নিতে হতো। চারদিকে যেন এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ। ছয় দশকে কতই না পার্থক্য। এখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজার দিনগুলোতে মানুষের ঢল নামে। যারা আসেন_ 'হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন'_ এটাই বাস্তবতা। সব ধর্মের নারী-শিশু আসে দলে দলে। প্রশাসনের দিক থেকে মেলে পূর্ণ সহায়তা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় হাসিমুখে।
তবুও মনে রয়ে যায় শঙ্কা। ১৯৫০ সালে দুষ্কৃতকারীরা এ মন্দিরে আগুন দিয়েছে। লুট করেছে। ১৯৬৪ সালে একই ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই ফের সন্ত্রাস। ১৯৯০ সালেও দুষ্কৃতকারীদের আগুনে দগ্ধ মন্দির। কোনো অপরাধের বিচার হয়নি। অপরাধীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি ধিক্কার জানানোর আহ্বান জানানো হয়নি। এদিক থেকে কক্সবাজারের রামুর ঘটনা ব্যতিক্রম। দারুণ ব্যতিক্রম। সেখানে সংঘটিত অপরাধের মাত্রা ভয়ঙ্কর। সভ্যতার নিদর্শন পুড়েছে, মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের সবার চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিল_ যে পথে কেউ কেউ চলতে চাইছে সেটা ভয়ঙ্কর। আমাদের অবশ্যই সে পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা রুখতে হবে। অন্যথায় বিশ্ব সমাজ থেকে আমরা একঘরে হয়ে পড়ব।
রামুর ঘটনার নিন্দায় উচ্চকিত গোটা দেশ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশের অপচেষ্টার প্রতিবাদে দলমত-নির্বিশেষে সবাই একজোট। কত প্রতিনিধি দলই না রামু যাচ্ছে। অনেক অনেক বছর এমন দেখা যায় না। 'ওরা আসেনি'_ এমন কারও সম্পর্কে বলা যাবে না। এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর বরং সেখানে ছুটে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। আমাদের এ ভূখণ্ডে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যেসব অপচেষ্টা হয়েছে, তখন এমনটি দেখা যায়নি কেন, সে প্রশ্ন নিয়ে আমরা ভারাক্রান্ত হতে চাই না। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই চাই এমন প্রতিক্রিয়া এবং অপশক্তিকে নিবৃত্ত রাখার এটাই একমাত্র পথ। তারা জাগ্রত সমাজকে বড়ই ভয় পায়।
দৈনিক প্রথম আলো ২৩ ফেব্রুয়ারি খ্যাতিমান সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেনের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল 'হাটহাজারী : শুভবুদ্ধির জয় হোক'। তিনি লিখেছেন_ '৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি (২০১২) চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট ও হাটহাজারী উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেসব আক্রমণ হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ বেশির ভাগ সংবাদপত্রে আসেনি। সম্ভবত এসব পত্রিকা বিষয়টির নাজুক বাস্তবতা এবং অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া ও পরিণতির কথা ভেবে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে খবরটি ফলাও করে প্রচার করতে চায়নি। সরকারের দিক থেকেও একই রকম ভাবনা ও অনুরোধ ছিল।' তিনি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে আরও লিখেছেন_ 'বরাবরই আমার ভেতর একটা গভীর বেদনা ও অপরাধবোধ কাজ করে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরপর থেকে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় কীভাবে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছে তা সংখ্যাগুরু মুসলিম সমাজ সঠিকভাবে উপলব্ধি করেনি বা করতে ততটা আগ্রহী নয় বলে। তাদের এই ঔদাসীন্যের ফলে ক্রমেই সমাজের ভূমি ও স্থাবর সম্পত্তিলোভী ক্ষমতাবান মানুষের আগ্রাসনেরও শিকার হয়ে চলেছে সমাজের দুর্বল অংশ, যার সিংহভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। এ দেশে সত্যিকার অর্থে দাঙ্গা হয় না। দাঙ্গা অর্থে খুনোখুনি ধরলে ১৯৬৪-এর পর আর হয়নি, কিন্তু সেও ছিল একতরফা_ সংখ্যালঘুই আক্রান্ত হয়েছিল। ... ১৯৯০-৯২ সালের বাবরি-মসজিদ-পরবর্তী উত্তেজনায় একশ্রেণীর মুসলমানের প্রতিক্রিয়ায় চোট পোহাতে হয় এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে।'
কী ঘটেছিল হাটহাজারীতে তার বিবরণ বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাই এভাবে : ১০ ফেব্রুয়ারি জুমা নাগাদ উত্তেজনা বেড়েছে, সাম্প্রদায়িক স্লোগান উঠেছে, মারমুখী জনসমাগম মারাত্মক পর্যায়ে বেড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও প্রশাসনিক বাধাকে তুচ্ছ করে ব্যাপকভাবে আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল। এই হামলায় ১০টি মন্দির, ১৫টি দোকান এবং চার-পাঁচটি বসতঘর পুড়েছে, ভাংচুর হয়েছে, লুণ্ঠিত হয়েছে। মন্দিরে আসা দর্শনার্থীদের গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে।
এ ঘটনার দেড় মাস পর সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার চাকদহ গ্রামে হিন্দুদের ৭টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুন নেভাতে কেউ যেন এগিয়ে আসতে না পারে সে জন্যও তৎপরতা ছিল। এ সময়ে লুটপাটও হয়। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দমনে ব্যর্থতার জন্য সাতক্ষীরার এসপি এবং কালীগঞ্জ থানার ওসিকে ক্লোজ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা ও হাটহাজারীর ঘটনা কেন ঘটেছে এবং কার কতটা দায় সেটা জানার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি, যেটা দেখছি রামুর ক্ষেত্রে। আমাদের সবার জানা যে, কারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না। এ কারণটি যথার্থ হতে পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু দেশের নাগরিকদের কেউ যেন কারও অন্যায় হামলার শিকার নয়, সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা ঘটিয়েছে তাদেরও কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া নয়। সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামে সেটা ঘটতে আমরা দেখিনি। এখানে শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমাজেরও ব্যর্থতা। আরও বড় ব্যর্থতা_ এ ঘটনা জানার পর যথাযথ ক্রোধ প্রকাশে এমনকি সমাজের সচেতন অংশেরও বেশির ভাগের নিশ্চুপ থাকা। তারা কেন এটা করেনি বা করতে চায়নি, সে প্রশ্ন কমই শোনা যায়। এক অর্থে বলা যায়, তারা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়নি। কেউ হয়তো তাদের সেটা করাতেও চায়নি। কিংবা গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে সহিংসতার খবর না আসায় ভালো করে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিতও হতে পারেনি।
৪ আগস্ট, ২০১২ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছিল। আরও উদ্বেগের ঘটনা ছিল, চিরিরবন্দরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রশিদুল মান্নাফ কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ_ তিনি সন্ত্রাসীদের উসকানি দিয়েছেন। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক জামাল উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, '৩৫টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আকস্মিকভাবে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায় এবং হামলা শুরু করে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত থাকায় হত্যার মতো কোনো অঘটন ঘটেনি।'
সম্ভবত জেলা প্রশাসকের কাছে মনে হয়েছে_ আগুন দিয়ে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া কিংবা লুটপাট তেমন ভয়ঙ্কর অপরাধের কিছু নয়। এ যেন 'মানুষটা মরে গেছে গুলিতে, ভাগ্য ভালো যে চোখটা বেঁচে গেছে!' প্রাণহানি যে ঘটেনি!
এ তিনটি ঘটনার সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। ঘটনার পেছনে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকানি ছিল, সেটা স্পষ্ট। এ অপশক্তি আওয়ামী লীগকে এক মুহূর্তের জন্য ক্ষমতায় রাখতে চায় না। প্রতিটি এলাকাতেই আক্রান্তদের অভিযোগ, স্থানীয়রা নয়, বরং বাইরে থেকে অচেনা লোকেরা এসে হামলায় অংশ নিয়েছে।
এসব ঘটনা থেকে বলা যায়, দেশের নানা স্থানে এ ধরনের সংগঠিত বাহিনী প্রস্তুত হয়ে আছে_ যাদের সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা যায়। বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটানোর ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। তারা প্রথমে গুজব রটায় এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানা কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বও গুজবে বিশ্বাস করে 'কান ছেড়ে চিলের পেছনে ছোটে'। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে, ঘটনা ঘটার আগে কেন স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিটি স্থানেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে? তবে কি ভূত তাড়ানোর সরিষায় ভূতের আছর ঘটে চলেছে?
কক্সবাজারের রামুতেও আমরা একই ঘটনা ঘটতে দেখি। তবে অন্য এলাকাগুলোর তুলনায় পার্থক্যও প্রকট_ বিশেষভাবে সেটা লক্ষণীয় ঘটনা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়। রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক বসবাস করে। তবে সেখানকার জনসংখ্যার তুলনায়ও তারা নিতান্ত সংখ্যালঘু। গোটা দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মোট জনসংখ্যার এক শতাংশও হবে না। তাদের বসবাসের এলাকাও মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় সীমিত। রামুতে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশনে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। হাটহাজারীর ঘটনা নিয়ে আবুল মোমেন যেমন লিখেছিলেন, 'এসব সংবাদপত্র বিষয়টির নাজুক বাস্তবতা এবং অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া ও পরিণতির কথা ভেবে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে খবরটি ফলাও করে প্রচার করতে চায়নি।' কিন্তু রামুর ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। সব ধরনের গণমাধ্যম_ পত্রিকা, বেতার ও টিভি বিষয়টির ফলাও প্রচার করেছে এবং তার পরিণতিতে অপরাধীদের প্রতিই সর্বমহল থেকে এসেছে ধিক্কার। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে বলেও কেউ বলছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে সবাই বলছেন_ এ হামলা অনুচিত ও নিন্দনীয়। বাংলাদেশের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গ বাদে সচরাচর দেশীয় কোনো ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না। এমনকি যে হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম থেকে তার গ্রামীণ ব্যাংকের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানের সংলগ্ন নন্দীরহাট ও হাটহাজারী সদরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের গুরুতর ঘটনার পরও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। রামুর ঘটনার পর তিনি বিবৃতিতে বলেছেন, 'রামু, পটিয়া এবং উখিয়া উপজেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নৃশংস হামলা চালিয়ে তাদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমি তার তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করছি। আমি এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কময় ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে।' তিনি আরও বলেছেন, 'আমি ভাবতেই পারি না আমার দেশের মানুষ তার প্রতিবেশীর প্রতি এরকম জঘন্য মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটাতে পারে।'
রামু-উখিয়ার ঘটনা নিয়ে ৪ অক্টোবর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতি দিয়েছে। তারা এথনিক মাইনরিটিদের সুরক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ দাবি করেছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রকাশ্যে নিন্দা করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিও তারা আহ্বান জানিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে রামু-উখিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সবাই নিন্দা করছে এবং তা সংখ্যালঘুদের সাহস ও ভরসা জোগাবে। এমনটি যদি ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার পরে ঘটত, যদি হাটহাজারী-সাতক্ষীরা-চিরিরবন্দরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরপরই ঘটত, যদি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ একযোগে সোচ্চার কণ্ঠে বলতে পারত আর নয় সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হানাহানি_ তাহলে এ দেশটি কিন্তু প্রকৃতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে পরিণত হতে পারে। সাড়ে চার দশক ধরে 'শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের' প্যাঁচে ফেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে অসহনীয় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ চাপিয়ে রাখা হয়েছে তার অবসানের দাবিতে যদি এমন সম্মিলিত আওয়াজ উঠত, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এমন অবস্থায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা নির্ভাবনায় দেশের জন্য নিজেদের আরও উৎসর্গের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে পারত। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে যখন অবাধ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকে তখন দেখা যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের মেধা-যোগ্যতা-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারছে। তাদের পড়াশোনায় আগ্রহ আছে, শ্রমের মর্যাদার প্রতি তারা আস্থাশীল। মাতৃভূমির প্রতি রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা ও দরদ। তারা যেন ম্রিয়মাণ না থাকে, বিশেষ প্রটেকশন দিয়ে তাদের প্রহরা দিতে না হয়, বরং প্রাণের উচ্ছ্বাস ও আবেগে যেন পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের গণ্ডিতে নিরলস কাজ করে যেতে পারে তেমন পরিবেশ সৃষ্টি ও বজায় রাখাই প্রত্যাশিত।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
তবুও মনে রয়ে যায় শঙ্কা। ১৯৫০ সালে দুষ্কৃতকারীরা এ মন্দিরে আগুন দিয়েছে। লুট করেছে। ১৯৬৪ সালে একই ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই ফের সন্ত্রাস। ১৯৯০ সালেও দুষ্কৃতকারীদের আগুনে দগ্ধ মন্দির। কোনো অপরাধের বিচার হয়নি। অপরাধীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি ধিক্কার জানানোর আহ্বান জানানো হয়নি। এদিক থেকে কক্সবাজারের রামুর ঘটনা ব্যতিক্রম। দারুণ ব্যতিক্রম। সেখানে সংঘটিত অপরাধের মাত্রা ভয়ঙ্কর। সভ্যতার নিদর্শন পুড়েছে, মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের সবার চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিল_ যে পথে কেউ কেউ চলতে চাইছে সেটা ভয়ঙ্কর। আমাদের অবশ্যই সে পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা রুখতে হবে। অন্যথায় বিশ্ব সমাজ থেকে আমরা একঘরে হয়ে পড়ব।
রামুর ঘটনার নিন্দায় উচ্চকিত গোটা দেশ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশের অপচেষ্টার প্রতিবাদে দলমত-নির্বিশেষে সবাই একজোট। কত প্রতিনিধি দলই না রামু যাচ্ছে। অনেক অনেক বছর এমন দেখা যায় না। 'ওরা আসেনি'_ এমন কারও সম্পর্কে বলা যাবে না। এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর বরং সেখানে ছুটে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। আমাদের এ ভূখণ্ডে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যেসব অপচেষ্টা হয়েছে, তখন এমনটি দেখা যায়নি কেন, সে প্রশ্ন নিয়ে আমরা ভারাক্রান্ত হতে চাই না। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই চাই এমন প্রতিক্রিয়া এবং অপশক্তিকে নিবৃত্ত রাখার এটাই একমাত্র পথ। তারা জাগ্রত সমাজকে বড়ই ভয় পায়।
দৈনিক প্রথম আলো ২৩ ফেব্রুয়ারি খ্যাতিমান সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেনের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল 'হাটহাজারী : শুভবুদ্ধির জয় হোক'। তিনি লিখেছেন_ '৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি (২০১২) চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট ও হাটহাজারী উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেসব আক্রমণ হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ বেশির ভাগ সংবাদপত্রে আসেনি। সম্ভবত এসব পত্রিকা বিষয়টির নাজুক বাস্তবতা এবং অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া ও পরিণতির কথা ভেবে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে খবরটি ফলাও করে প্রচার করতে চায়নি। সরকারের দিক থেকেও একই রকম ভাবনা ও অনুরোধ ছিল।' তিনি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে আরও লিখেছেন_ 'বরাবরই আমার ভেতর একটা গভীর বেদনা ও অপরাধবোধ কাজ করে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরপর থেকে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় কীভাবে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছে তা সংখ্যাগুরু মুসলিম সমাজ সঠিকভাবে উপলব্ধি করেনি বা করতে ততটা আগ্রহী নয় বলে। তাদের এই ঔদাসীন্যের ফলে ক্রমেই সমাজের ভূমি ও স্থাবর সম্পত্তিলোভী ক্ষমতাবান মানুষের আগ্রাসনেরও শিকার হয়ে চলেছে সমাজের দুর্বল অংশ, যার সিংহভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। এ দেশে সত্যিকার অর্থে দাঙ্গা হয় না। দাঙ্গা অর্থে খুনোখুনি ধরলে ১৯৬৪-এর পর আর হয়নি, কিন্তু সেও ছিল একতরফা_ সংখ্যালঘুই আক্রান্ত হয়েছিল। ... ১৯৯০-৯২ সালের বাবরি-মসজিদ-পরবর্তী উত্তেজনায় একশ্রেণীর মুসলমানের প্রতিক্রিয়ায় চোট পোহাতে হয় এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে।'
কী ঘটেছিল হাটহাজারীতে তার বিবরণ বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাই এভাবে : ১০ ফেব্রুয়ারি জুমা নাগাদ উত্তেজনা বেড়েছে, সাম্প্রদায়িক স্লোগান উঠেছে, মারমুখী জনসমাগম মারাত্মক পর্যায়ে বেড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও প্রশাসনিক বাধাকে তুচ্ছ করে ব্যাপকভাবে আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল। এই হামলায় ১০টি মন্দির, ১৫টি দোকান এবং চার-পাঁচটি বসতঘর পুড়েছে, ভাংচুর হয়েছে, লুণ্ঠিত হয়েছে। মন্দিরে আসা দর্শনার্থীদের গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে।
এ ঘটনার দেড় মাস পর সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার চাকদহ গ্রামে হিন্দুদের ৭টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুন নেভাতে কেউ যেন এগিয়ে আসতে না পারে সে জন্যও তৎপরতা ছিল। এ সময়ে লুটপাটও হয়। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দমনে ব্যর্থতার জন্য সাতক্ষীরার এসপি এবং কালীগঞ্জ থানার ওসিকে ক্লোজ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা ও হাটহাজারীর ঘটনা কেন ঘটেছে এবং কার কতটা দায় সেটা জানার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি, যেটা দেখছি রামুর ক্ষেত্রে। আমাদের সবার জানা যে, কারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না। এ কারণটি যথার্থ হতে পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু দেশের নাগরিকদের কেউ যেন কারও অন্যায় হামলার শিকার নয়, সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা ঘটিয়েছে তাদেরও কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া নয়। সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামে সেটা ঘটতে আমরা দেখিনি। এখানে শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমাজেরও ব্যর্থতা। আরও বড় ব্যর্থতা_ এ ঘটনা জানার পর যথাযথ ক্রোধ প্রকাশে এমনকি সমাজের সচেতন অংশেরও বেশির ভাগের নিশ্চুপ থাকা। তারা কেন এটা করেনি বা করতে চায়নি, সে প্রশ্ন কমই শোনা যায়। এক অর্থে বলা যায়, তারা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়নি। কেউ হয়তো তাদের সেটা করাতেও চায়নি। কিংবা গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে সহিংসতার খবর না আসায় ভালো করে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিতও হতে পারেনি।
৪ আগস্ট, ২০১২ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছিল। আরও উদ্বেগের ঘটনা ছিল, চিরিরবন্দরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রশিদুল মান্নাফ কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ_ তিনি সন্ত্রাসীদের উসকানি দিয়েছেন। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক জামাল উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, '৩৫টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আকস্মিকভাবে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায় এবং হামলা শুরু করে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত থাকায় হত্যার মতো কোনো অঘটন ঘটেনি।'
সম্ভবত জেলা প্রশাসকের কাছে মনে হয়েছে_ আগুন দিয়ে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া কিংবা লুটপাট তেমন ভয়ঙ্কর অপরাধের কিছু নয়। এ যেন 'মানুষটা মরে গেছে গুলিতে, ভাগ্য ভালো যে চোখটা বেঁচে গেছে!' প্রাণহানি যে ঘটেনি!
এ তিনটি ঘটনার সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। ঘটনার পেছনে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকানি ছিল, সেটা স্পষ্ট। এ অপশক্তি আওয়ামী লীগকে এক মুহূর্তের জন্য ক্ষমতায় রাখতে চায় না। প্রতিটি এলাকাতেই আক্রান্তদের অভিযোগ, স্থানীয়রা নয়, বরং বাইরে থেকে অচেনা লোকেরা এসে হামলায় অংশ নিয়েছে।
এসব ঘটনা থেকে বলা যায়, দেশের নানা স্থানে এ ধরনের সংগঠিত বাহিনী প্রস্তুত হয়ে আছে_ যাদের সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা যায়। বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটানোর ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। তারা প্রথমে গুজব রটায় এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানা কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বও গুজবে বিশ্বাস করে 'কান ছেড়ে চিলের পেছনে ছোটে'। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে, ঘটনা ঘটার আগে কেন স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিটি স্থানেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে? তবে কি ভূত তাড়ানোর সরিষায় ভূতের আছর ঘটে চলেছে?
কক্সবাজারের রামুতেও আমরা একই ঘটনা ঘটতে দেখি। তবে অন্য এলাকাগুলোর তুলনায় পার্থক্যও প্রকট_ বিশেষভাবে সেটা লক্ষণীয় ঘটনা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়। রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক বসবাস করে। তবে সেখানকার জনসংখ্যার তুলনায়ও তারা নিতান্ত সংখ্যালঘু। গোটা দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মোট জনসংখ্যার এক শতাংশও হবে না। তাদের বসবাসের এলাকাও মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় সীমিত। রামুতে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশনে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। হাটহাজারীর ঘটনা নিয়ে আবুল মোমেন যেমন লিখেছিলেন, 'এসব সংবাদপত্র বিষয়টির নাজুক বাস্তবতা এবং অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া ও পরিণতির কথা ভেবে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে খবরটি ফলাও করে প্রচার করতে চায়নি।' কিন্তু রামুর ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। সব ধরনের গণমাধ্যম_ পত্রিকা, বেতার ও টিভি বিষয়টির ফলাও প্রচার করেছে এবং তার পরিণতিতে অপরাধীদের প্রতিই সর্বমহল থেকে এসেছে ধিক্কার। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে বলেও কেউ বলছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে সবাই বলছেন_ এ হামলা অনুচিত ও নিন্দনীয়। বাংলাদেশের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গ বাদে সচরাচর দেশীয় কোনো ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না। এমনকি যে হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম থেকে তার গ্রামীণ ব্যাংকের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানের সংলগ্ন নন্দীরহাট ও হাটহাজারী সদরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের গুরুতর ঘটনার পরও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। রামুর ঘটনার পর তিনি বিবৃতিতে বলেছেন, 'রামু, পটিয়া এবং উখিয়া উপজেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নৃশংস হামলা চালিয়ে তাদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমি তার তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করছি। আমি এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কময় ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে।' তিনি আরও বলেছেন, 'আমি ভাবতেই পারি না আমার দেশের মানুষ তার প্রতিবেশীর প্রতি এরকম জঘন্য মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটাতে পারে।'
রামু-উখিয়ার ঘটনা নিয়ে ৪ অক্টোবর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতি দিয়েছে। তারা এথনিক মাইনরিটিদের সুরক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ দাবি করেছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রকাশ্যে নিন্দা করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিও তারা আহ্বান জানিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে রামু-উখিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সবাই নিন্দা করছে এবং তা সংখ্যালঘুদের সাহস ও ভরসা জোগাবে। এমনটি যদি ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার পরে ঘটত, যদি হাটহাজারী-সাতক্ষীরা-চিরিরবন্দরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরপরই ঘটত, যদি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ একযোগে সোচ্চার কণ্ঠে বলতে পারত আর নয় সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হানাহানি_ তাহলে এ দেশটি কিন্তু প্রকৃতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে পরিণত হতে পারে। সাড়ে চার দশক ধরে 'শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের' প্যাঁচে ফেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে অসহনীয় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ চাপিয়ে রাখা হয়েছে তার অবসানের দাবিতে যদি এমন সম্মিলিত আওয়াজ উঠত, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এমন অবস্থায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা নির্ভাবনায় দেশের জন্য নিজেদের আরও উৎসর্গের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে পারত। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে যখন অবাধ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকে তখন দেখা যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের মেধা-যোগ্যতা-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারছে। তাদের পড়াশোনায় আগ্রহ আছে, শ্রমের মর্যাদার প্রতি তারা আস্থাশীল। মাতৃভূমির প্রতি রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা ও দরদ। তারা যেন ম্রিয়মাণ না থাকে, বিশেষ প্রটেকশন দিয়ে তাদের প্রহরা দিতে না হয়, বরং প্রাণের উচ্ছ্বাস ও আবেগে যেন পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের গণ্ডিতে নিরলস কাজ করে যেতে পারে তেমন পরিবেশ সৃষ্টি ও বজায় রাখাই প্রত্যাশিত।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments